সেপ্টেম্বর ১৫, ২০২৩, ১২:১০ এএম
কৃত্রিম সংকট তৈরি করে ডলারের দাম বৃদ্ধি। বাজারের লাগাম টানতে নিয়ন্ত্রক সংস্থার অভিযান। নির্ধারিত দামে ক্রয়-বিক্রয়ে সংশ্লিষ্টদের অনীহা। ধরপাকড়ের কারণে আতঙ্ক। কেনাবেচা না থাকায় হতাশায় এক্সচেঞ্জ হাউস। আর জরুরি প্রয়োজনে দ্বারে দ্বারে ঘুরেও ডলার না পেয়ে ক্ষুব্ধ বিদেশগামীরা। এটিই ডলারবাজারের বর্তমান চিত্র। তবে রমরমা ব্যবসায় মেতেছে দালালচক্র। উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলায় অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) ও বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বাফেদা) সঙ্গে বৈঠকে বসে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠক কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই শেষ হয়েছে। তাই শিগগিরই ডলারবাজার শান্ত হচ্ছে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
সম্প্রতি নির্ধারিত দামে ডলার কেনাবেচা নিশ্চিত করতে অভিযান শুরু করে বাংলাদেশ ব্যাংক। সঙ্গে যোগ দেন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা। বিশেষ অভিযানে বেশি দামে ডলার বিক্রির অপরাধে বেশকিছু মানিচেঞ্জারের লাইসেন্স স্থগিত ও সিলগালা করা হয়। এমন পরিস্থিতিতে ভয়-আতঙ্কে ডলার বেচাকেনা প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানগুলো। ফলে খোলাবাজারে ডলারের সংকট দেখা দিয়েছে। বিদেশগামী লোকদের নগদ ডলারের প্রধান উৎস এই খোলাবাজার। তবে এখন এসব মানুষ খোলাবাজারে এসে নগদ ডলার পাচ্ছেন না।
গত বুধবার রাজধানীর মতিঝিল, দিলকুশা ও পল্টন এলাকার একচেঞ্জ হাউস ঘুরে দেখা যায়, অলস সময় পার করছে মানিচেঞ্জার প্রতিষ্ঠানগুলো। ক্রয়-বিক্রয়ের দাম লেখা আছে বোর্ডে, কিন্তু ডলার নেই। বিক্রেতারা বলছেন, নির্ধারিত দামে তারা কিনতে পারছেন না, তাই বিক্রিও বন্ধ। তবে কোথাও পাওয়া গেলেও নগদ ডলার কিনতে গ্রাহকদের গুনতে হচ্ছে ১১৮ থেকে ১১৮ টাকা ৫০ পয়সা। কঠোর গোপনীয়তায় এ দরেও কাঙ্ক্ষিত পরিমাণে ডলার দিতে পারছে না মানিচেঞ্জারগুলো। আগের চেয়ে বেশি শিক্ষার্থী, রোগী ও পর্যটক বিদেশে যাওয়ায় নগদ ডলারের চাহিদা হঠাৎ বেড়ে যাওয়ায় মার্কিন মুদ্রাটির দাম বেড়ে গেছে বলে জানান ব্যবসায়ীরা।
জানা যায়, গত মাসের শেষদিকে ইচ্ছামতো দরে ডলার বিক্রি করেছে মানিচেঞ্জারগুলো। নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি ডলার বিক্রি করায় চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্যোগে খোলাবাজারে চলছে অভিযান। ইতোমধ্যে সাত মানিচেঞ্জারের লাইসেন্স স্থগিত করেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা। পাশাপাশি একই কারণে আরও ১০ মানিচেঞ্জারের কাছে ব্যাখ্যা তলব করা হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে মতিঝিল ও দিলকুশার একাধিক মানিচেঞ্জার ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্ধারিত দরে ডলার কিনতে পাওয়া যাচ্ছে না। বাড়তি দর দিলে বিক্রেতারা ডলার বিক্রি করছেন। তাই তাদেরও বেশি দরে বিক্রি করতে হচ্ছে। তারা মনে করেন, এবিবি-বাফেদা নির্ধারিত দরে ডলার ব্যাংকও দিতে পারবে না।
তারা আরও জানান, বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিভিন্ন সংস্থার অভিযানের কারণে ডলার ব্যবসায় ভাটা পড়েছে। ডলার থাকলেও জব্দের ভয়ে ব্যবসায়ীরা ডলার বের করছেন না। অনেকে ফোনে লেনদেন সম্পন্ন করছেন। কোনো বিশ্বস্ত গ্রাহক ফোন করে ডলারের অর্ডার করলে তখন তারা গোপনে বিক্রি করছেন। ফলে প্রয়োজন হলেও পরিচিত ছাড়া বিদেশগামী যাত্রীরা ডলার কিনতে পারছেন না। এমনকি বিদেশফেরতরাও মানি এক্সচেঞ্জে এসে ডলার বিক্রির সাহস পাচ্ছেন না। কারণ, তারা বেশি দাম ছাড়া বিক্রি করবেন না। আর বেশি দামে বিক্রি করলে গোয়েন্দাদের হাতে ধরা পড়ার শঙ্কা রয়েছে। তাই ডলার বেচাকেনা এখন পুরোটাই চলছে কালোবাজারে। দালালচক্রের মাধ্যমে জরুরি প্রয়োজন সারছেন বিদেশগামীরা।
সরেজমিন রাজধানীর মতিঝিলে একটি মানিচেঞ্জারের সামনে মারুফ নামে এক শিক্ষার্থীর সঙ্গে আলাপ হয় এ প্রতিবেদকের। তিনি বলেন, ‘চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাব, তাই নগদ কিছু ডলার লাগবে। কিন্তু ব্যাংকে গিয়ে পাইনি। তাই মানিচেঞ্জারে এলাম ডলার কিনতে। কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে ঘুরেও ডলার পেলাম না। পরে একজন দালালের কাছ থেকে ৫০০ ডলার কিনলাম। রেট নিল ১১৮ টাকা ৬০ পয়সা। তবে মানিচেঞ্জারের রেট দেয়া ছিল ১১২ টাকা ৬০ পয়সা। জরুরি প্রয়োজন, তাই নির্ধারিত দামের চেয়ে ছয় টাকা বেশি দরে কিনলাম। তবুও বলতে হয় ভাগ্য ভালো বলে পেয়েছি। প্রথমে ভেবেছিলাম পাবই না।’
মানিচেঞ্জারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের মহাসচিব শেখ হেলাল সিকদার বলেন, বিভিন্ন সংস্থার অভিযানের কারণে মানুষ আতঙ্কে ডলার বিক্রি করতে আসছে না। তাই খোলাবাজারে ডলারের সংকট আরও বেড়েছে। মানিচেঞ্জারে কেউ ঘোষিত দরে ডলার পাচ্ছে না। তাই নির্ধারিত দরে বিক্রিও করতে পারছে না। পরিস্থিতি বিবেচনায় অনেকে ডলার ধরে রেখেছে।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে গতকাল বিকালে এবিবি ও বাফেদার সঙ্গে আলোচনায় বসে বাংলাদেশ ব্যাংক। বৈঠকে এবিবির চেয়ারম্যান সেলিম আর এফ হোসেন এবং বাফেদার চেয়ারম্যান আফজাল করিম সংগঠন দুটির প্রতিনিধিত্ব করেন।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, ডলারের দাম বাজারভিত্তিক ষ এরপর পৃষ্ঠা ১১ কলাম ১ করার লক্ষ্যে আনুষ্ঠানিক দাম আরও বাড়ানোর প্রস্তাব দেয় বাফেদা। এক্ষেত্রে এবিবিরও কিছু প্রস্তাবনা ছিল। কিন্তু টাকার অবমূল্যায়ন ঠেকাতে দাম বাড়াতে রাজি হয়নি বাংলাদেশ ব্যাংক। নির্ধারিত দাম কার্যকরে কৌশন ঠিক করতে পরামর্শ দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এমন প্রেক্ষাপটে কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই বৈঠকটি শেষ হয়। বৈঠকের বিষয়ে আনুষ্ঠানিক মন্তব্য করেনি কোনো পক্ষই। এবিবির চেয়ারম্যান সেলিম আর এফ হোসেন আমার সংবাদকে বলেন, ‘উল্লেখ করার মতো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। যদি এমন কোনো বিষয় থাকত— যা জানানো দরকার, তাহলে অবশ্যই বলতাম।’ মন্তব্যের জন্য একাধিকবার ফোন করলেও বাফেদার চেয়ারম্যান আফজাল করিম ও বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক সাড়া দেননি।
খাত-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ডলারের সংকট সমাধানে এখন পর্যন্ত যেসব উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, তার সবই অস্থায়ী ভিত্তিতে। সংকট কমবে— এমন কোনো কার্যকর পরিকল্পনা নেয়া হচ্ছে না বলে অভিযোগ আছে। ডলার সংকটের জন্য যারা দায়ী, বিশেষত অর্থ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে যথাযথ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার সময় এসেছে। এটা না করে অভিযানের নামে পরিস্থিতি উত্তপ্ত করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, যা সংকট আরও উসকে দিচ্ছে।
গত বছরের শেষ প্রান্তিক (অক্টোবর-ডিসেম্বর) থেকে এখন পর্যন্ত বাফেদা ও এবিবি ডলারের দাম নির্ধারণ করে আসছে। তবে এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুসরণ করতে হচ্ছে। তাই ডলারের বাজারভিত্তিক দর নির্ধারণ হয়নি। নির্ধারিত দর অনুযায়ী চলতি সেপ্টেম্বর থেকে আমদানিকারকদের কাছে ১১০ টাকায় ডলার বিক্রি করছে ব্যাংকগুলো। আগে আমদানি দায় মেটানোর জন্য ব্যাংকগুলো আমদানিকারকদের কাছে প্রতি ডলার ১০৯ টাকা ৫০ পয়সায় বিক্রি করত।
এদিকে পণ্য বা সেবা রপ্তানি ও প্রবাসী আয় কেনায় ডলারের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ১০৯ টাকা ৫০ পয়সা। আগে ব্যাংকগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে প্রবাসীদের প্রতি ডলারের জন্য ১০৯ টাকা এবং রপ্তানিকারকদের প্রতি ডলারের জন্য ১০৮ টাকা ৫০ পয়সা দিত। নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশিতে ডলার কেনাবেচা করায় সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক প্রায় ১০টি ব্যাংকের কাছে ব্যাখ্যা তলব করেছে। এ কারণে গত আগস্টে প্রবাসী আয় ২১ শতাংশের বেশি কমেছে।