সেপ্টেম্বর ২১, ২০২৩, ১০:৫৮ পিএম
নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রসহ জীবন ধারণের সব ব্যয় অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পেয়েছে। বাস্তবে অনেক বেশি হলেও শুধু কাগজ-কলমেই প্রায় ১০ শতাংশ মূল্যস্ফীতি ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো। লাগমহীন ঊর্ধ্ব মূল্যস্ফীতি এখন অর্থনীতির মূল চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ সংকট উত্তরণে টাকা ছাপানো বন্ধের তাগিদ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদ ড. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ।
বাজেট ঘাটতি মেটাতে গত অর্থবছরে বিপুল পরিমাণ নতুন টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ঋণ দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। লাগামহীন মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে নানা মহলের সমালোচনার মুখে অর্থনীতিবিদ ও খাতসংশ্লিষ্টদের দারস্থ হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর অংশ হিসেবে গতকাল বৃহস্পতিবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার। পর্যায়ক্রমে খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ, সাংবাদিক, ব্যবসায়ীসহ সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে বৈঠকের পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক।
সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে তিনি বলেন, দেশের অর্থনৈতিক সংকট নিরসনে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ খুবই জরুরি। তাই আমরা অর্থনীতিবিদ ও অন্যান্য স্টেকহোল্ডারের সাথে আলোচনার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। যেসব পরামর্শ আসবে তা পর্যালোচনা করে আগামী মুদ্রানীতি প্রণয়ন করা হবে। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে বিনিময় হার, মূল্যস্ফীতি ও খেলাপি ঋণের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে ড. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদকে অবহিত করা হয়েছে। এ ছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গৃহীত বিভিন্ন পলিসি বিষয়ে তিনি জানতে চেয়েছেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ঋণ না দেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন এ অর্থনীতিবিদ। ইতোমধ্যে আমরা এটি বন্ধ করেছি।’ একই সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংক গৃহীত পলিসি যথাযথ বাস্তবায়নে পদক্ষেপ গ্রহণ ও তদারকি বাড়নোর ওপর জোর দিয়েছেন ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ।
মেজবাউল হক বলেন, আমরা সংকটের মধ্যে আছি, তা সত্য। আমদানি নিয়ন্ত্রণ, রপ্তানি বৃদ্ধি ও রেমিট্যান্স সংগ্রহ বৃদ্ধি করার উদ্যোগ নিয়ে আমরা সংকট মোকাবিলার চেষ্টা করে যাচ্ছি। বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার অল্প সময়ের মধ্যে অনেক বেড়েছে। যেহেতু আমরা আমদানি-নির্ভর দেশ; তাই মূল্যস্ফীতিতে এর প্রভাব পড়েছে। এ সব বিষয় মোকাবিলায় ভবিষ্যতে আরো অর্থনীতিবিদ, ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম, চেম্বার অব কমার্স এবং অর্থনৈতিক খাতের বিভিন্ন ব্যক্তিদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা পর্যায়ক্রমে চলতে থাকবে বলেও জানান তিনি।
উন্নত দেশগুলোতে সুদের হার বেড়ে যাওয়ায় আমাদের দেশও তার মাশুল গুনছে বলে মন্তব্য করেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র। তিনি বলেন, ‘ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট অর্থনীতির মূল চ্যালেঞ্জ। বর্তমানে এ সূচক নেগেটিভ আছে। এর অন্যতম কারণ উন্নত বিশ্বের পলিসি রেট বৃদ্ধি পাওয়া। সুদহার বেশি হওয়ায় বিদেশি সহায়তা নেয়া সম্ভব হচ্ছে না। রিজার্ভের পতন বিষয়ে প্রশ্নের উত্তরে মুখপাত্র বলেন, ‘আইএমএফের সঙ্গে কমিটমেন্ট কোনো অর্থনৈতিক সূচক নয়।’ রেগে গিয়ে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘ঋণের পাওয়ার জন্য কি কমিটমেন্ট দিয়েছি সেটিকে কেন ইকোনমিক থিওরি ধরে নিচ্ছেন।’ প্রশ্ন রেখে মুখপাত্র বলেন, ‘আইএমএফ কি বলতে পারবে রিজার্ভ ২৪ বিলিয়ন থাকলে বাংলাদেশের ইকোনমি সুন্দর ও সুস্থ? এটি কোনো ইকোনমিক থিওরি নয়। ঋণের বিষয়ে আইএমএফকে আমরা যা বলেছি তা অর্থনৈতিক সূচক নয়।’ এ ছাড়া রিজার্ভের ধারাবাহিক পতন আশঙ্কাজনক নয় বলে মনে করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
উল্লেখ্য, ঋণ চুক্তি অনুযায়ী, চলতি বছরের মার্চ থেকে আইএমএফের বিভিন্ন শর্ত মেনে চলছে সরকার। সংস্থাটির পরিমাণগত কর্মক্ষমতা মানদণ্ড অনুযায়ী, বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ চলতি বছরের জুনে ২৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার, সেপ্টেম্বরে ২৫ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার এবং ডিসেম্বরে ২৬ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলারের নিচে থাকতে পারবে না। অথচ বর্তমানে রিজার্ভ রয়েছে ২১ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ সংস্থাটির শর্তের চেয়ে চার বিলিয়ন ডলার কম রয়েছে রিজার্ভ। অন্যদিকে বর্তমানে বিনিময় মূল্য পুরোপুরো বাজারভিত্তিক আছে দাবি করে মুখপাত্র বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক এবিবি-বাফেদাকে কোনো পরামর্শ দেয় না। তারা নিজেরাই ডলারের দাম ঠিক করে। তিনি বলেন, পাচারের কারণে ডলার খোলাবাজারে ডলারের দাম বাড়ছে। এটি বৈধ দাম নয়।’ কিন্তু ব্যবসায়ীদের দাবি, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের দাম চেপে দিচ্ছে।’ ব্যাংকগুলোতে ডলার না পেয়ে খোলাবাজারে ঘুরছেন শিক্ষার্থী ও চিকিৎসাপ্রার্থীরা। নির্ধারিত দামের চেয়ে ১০টাকা বেশি দরে কিনতে হচ্ছে তবুও পাওয়া যাচ্ছে না।
প্রসঙ্গত, গত জুন ও জুলাই মাসে দেশে মূল্যস্ফীতি সামান্য কমার পর আগস্ট মাসে তা আবার বেড়েছে। গত মাসে মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৯২ শতাংশে। এই সময় দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হঠাৎ অনেকটা বেড়ে গেছে। খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার উঠেছিল ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরামর্শে গত বছরের শেষ প্রান্তিক থেকে বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনকারী ব্যাংকগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) এবং ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের সংগঠন এবিবি ডলারের দাম নির্ধারণ করছে। পণ্য বা সেবার রপ্তানি ও প্রবাসী আয়ের ক্ষেত্রের ডলারের নতুন দাম ১০৯ টাকা ৫০ পয়সা। অন্যদিকে আমদানিকারকদের কাছে এখন ১১০ টাকায় ডলার বিক্রি করছে ব্যাংকগুলো। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে কিছু ব্যাংক প্রতি ডলারে ১১৪-১১৫ টাকা দাম নিচ্ছে। কারণ, প্রবাসী ও রপ্তানি আয় কিনতে হচ্ছে বেশি দামে। না হলে ঋণপত্র খুলতে আগ্রহ দেখাচ্ছে না ব্যাংকগুলো।
অন্যদিকে ধারাবাহিক পতনের মধ্য দিয়ে আইএমএফ স্বীকৃতি বিপিএম-৬ অনুযায়ী গতকাল বৈদেশিক মুদ্রার গ্রস রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ২১ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলার। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজস্ব হিসাবে রিজার্ভ রয়েছে ২৭ দশমিক ৩৩ বিলিয়ন ডলার।