সেপ্টেম্বর ২২, ২০২৩, ১০:৫৯ পিএম
বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের জন্য ভয়াবহ আতঙ্কের নাম র্যাগিং। আগের চেয়ে কিছুটা কমলেও এখনো শূন্যের কোঠায় নামেনি। সাধারণত কাছাকাছি ব্যাচের ‘ভাই’ কর্তৃক বিভিন্ন শিষ্টাচার শেখানোর নামে নবীনদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয়। কিন্তু কয়েক মাস আগে র্যাগিং বিরোধী আইন পাস হওয়ার পর থেকে দেশের অধিকাংশ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা কঠোর অবস্থা নিয়েছেন। এতে প্রতিষ্ঠানসমূহে কমেছে র্যাগিং।
এমনকি কোনো কোনো ক্যাম্পাসে নবীনদের সঙ্গে পরিচয় পর্বও নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কোনো ধরনের ভয়ভীতি ছাড়াই শিক্ষার্থীরা নির্দ্বিধায় অভিযোগ জানাতে পারছেন। অভিযোগ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ব্যবস্থা নিচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। গুরুতর অভিযোগ প্রমাণিত হলে করা হচ্ছে বহিষ্কার। অন্যদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে র্যাগিং বা গেস্টরুম নির্যাতন বেড়েছে। বিভিন্ন নির্যাতনের সঙ্গে নতুন করে যুক্ত হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গতিবিধি পর্যবেক্ষণ। গেস্টরুম নির্যাতন বা র্যাগিং বন্ধে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি ঢাবি প্রশাসন।
জানা যায়, শিক্ষা মন্ত্রণালয় গত ২ মে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ‘বুলিং ও র্যাগিং প্রতিরোধ সংক্রান্ত নীতিমালা-২০২৩’ প্রজ্ঞাপন আকারে প্রকাশ করে। আর গত ২৯ জুন তা গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়। নীতিমালায় মৌখিক, শারীরিক, সামাজিক, সাইবার ও যৌনসংক্রান্ত বুলিং ও র্যাগিংয়ের সংজ্ঞা রয়েছে। এর আগে বিশ্ববিদ্যালয়ে র্যাগিং ও বুলিং বন্ধের জন্য হাইকোর্ট নির্দেশনা দিয়েছে। মূলত ২০১৮ সালে শিক্ষকের অপমানের কারণে ভিকারুননিসার ছাত্রী আত্মহত্যা, ২০১৯ সালে বুয়েটে আবরার হত্যাসহ আরো বেশ কয়েকটি র্যাগিংয়ের ঘটনা দেশজুড়ে চ্যাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। ২০১৮ সালের পর থেকেই র্যাগিংয়ের ব্যাপারে ব্যাপক আকারে আলোচনা সমালোচনা হয়। পরবর্তীতে গত বছর থেকে জোরালো অবস্থানে গেলেও নতুন করে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে র্যাগিং দেখা যায়। এ কারণে র্যাগিংয়ের সাথে জড়িত পাঁচ শিক্ষার্থীকে বহিষ্কার করতে বাধ্য হয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাগিংয়ের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে এ প্রতিবেদক ঢাবি, জবি, জাবি, রাবি, চবি, ইবি, কুবি, খুবি, ববিসহ মোট ৩০টি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধির সঙ্গে কথা বলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) ছাড়া বাকি সব বিশ্ববিদ্যালয়ে র্যাগিং কমার কথা জানিয়েছেন প্রতিনিধিরা। তারা সরেজমিন পর্যবেক্ষণ করে জানান, নতুন শিক্ষার্থীরা আসার আগেই কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন ক্যাম্পাসে র্যাগিংবিরোধী মাইকিং করেছে। অধিকাংশই বিভাগে চিঠি পাঠিয়ে সতর্ক করেছে। বিভাগীয় প্রধানরা শিক্ষকদের মিটিংগুলোতে এ নিয়ে আলোচনা করেছেন। সতর্ক করার উদ্দেশে শিক্ষকরা ক্লাসে ক্লাসে র্যাগিংবিরোধী আলোচনা করেছেন।
র্যাগিং বন্ধের ব্যাপারে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘করোনার আগে আমাদের কাছাকাছি ব্যাচের ভাইদের কর্তৃক নবীনরা নির্যাতনের শিকার হতেন। পরিচয় জানার নামে বিভিন্নভাবে তাদের র্যাগিং ও বুলিং করা হতো। কিন্তু করোনার পর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন র্যাগিং বন্ধে নির্দেশনা দিলেও খুব একটা মানা হতো না। কোনো না কোনোভাবে শিক্ষার্থীরা র্যাগিংয়ের শিকার হতোই। এবার নবীনরা আসার আগেই বিভাগগুলোর চেয়ারম্যানদের কাছে প্রশাসনের পক্ষ থেকে র্যাগিং বন্ধে চিঠি পাঠানো হয়। এর ফলে প্রায় সব বিভাগেই র্যাগিং বন্ধ হয়। দু’-একটি বিভাগে র্যাগিংয়ের ঘটনায় শিক্ষার্থীরা অভিযোগ জানান। অভিযোগের পরের দিনই ওই ব্যাচের শিক্ষার্থীদের জবাবদিহির সম্মুখীন করেছেন শিক্ষকরা।’
র্যাগিংয়ের দায়ে এ বছর ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচ শিক্ষার্থীকে বহিষ্কার করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়টির বর্তমান অবস্থা জানিয়ে প্রতিনিধি ফারজানা নওশিন তিতলি বলেন, নবীনরা আসার আগে পুরো ক্যাম্পাসে টানা সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত র্যাগিংবিরোধী মাইকিং করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশাসন। র্যাগিংয়ের ব্যাপারে কঠোর থাকার জন্য হল প্রভোস্টদের চিঠিও দেয়া হয়। বর্তমানে নবীনদের এর ফলে এখন জুনিয়রদের সঙ্গে কথা বলতেও সতর্ক থাকছে সিনিয়ররা।’
ঢাবি সূত্রে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে আগের নেয় র্যাগিং বহাল রয়েছে। সামনে নির্বাচনকে সামনে রেখে এখন আরো বেশি তদারকি বাড়িয়েছেন নেতারা। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীদের ফেসবুকের লাইক, কমেন্ট ও পোস্ট নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেন তারা। সরকারবিরোধী কোনো পোস্টে লাইক বা কমেন্ট থাকলে তাদের কাছ থেকে জবাবদিহি করতে বাধ্য করা হয়। কখনো মেরে পুলিশেও দেয়া হয়। অনেক ক্ষেত্রে এ র্যাগিংয়ের সঙ্গে ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের সম্পৃক্তরা রয়েছে বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীদের।’
এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের জহিরুল হক হলের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী বলেন, নবীনরা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার এক সপ্তাহ পর থেকে তাদের গেস্টরুমে ডাকা হয়। রাত ৯ টার পর থেকে ১২টা পর্যন্ত তাদের ইমিডিয়েট সিনিয়ররা তুই তোকারি করে বিভিন্ন ধরনের নির্যাতন করেন। কখনো কখনো সারা রাত তাদের হলের বাইরে থাকতে হয়। নির্যাতনের ধরন সম্পর্কে এ শিক্ষার্থী জানান, কোনো কারণ ছাড়াই অযথা কোনো একটা অজুহাত বের করে তাদের র্যাগিং দেয়া হয়। চড়, থাপ্পড়, গালাগালি এখানে সাধারণ বিষয়। মাসে দুই-তিন বার শিক্ষার্থীদের হল থেকে বের করে দেয়া হয়। ফলে সারা রাত তারা হলের বাইরে থাকতে বাধ্য হন। সদ্য অনার্স পাস করা একজন শিক্ষার্থী বলেন, হলের নির্বাচনের আগে সাধারণ শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশগ্রহণে বাধ্য করা হয়। হলের কমন রুমে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ফেসবুক কার্যক্রমের উপর কঠোর জবাবদিহি নেন হল নেতারা।
গেস্টরুম নির্যাতনের বিষয়ে ঢাবি উপাচার্য ড. আখতারুজ্জামান আমার সংবাদকে বলেন, ‘গেস্টরুমে যেন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা না ঘটে সে জন্য সংশ্লিষ্ট হলের প্রভোস্টদের জানানো হয়েছে। এ বিষয়ে তিনি আর কোনো কথা বলতে রাজি হননি।