Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৪,

হরতালের নামে নৈরাজ্য তাণ্ডব

মো. মাসুম বিল্লাহ

অক্টোবর ২৯, ২০২৩, ১১:৪২ পিএম


হরতালের নামে নৈরাজ্য তাণ্ডব

অবরোধের ঘোষণায় জনমনে উৎকণ্ঠা

  • সংঘর্ষ, পিকেটিং, আগুন ভাঙচুর, মৃত্যু, ধরপাকড়ে হরতালের ইতি

দুদিনে সারা দেশে যানবাহনসহ ৪৫ স্থানে আগুন, পুড়েছে পুলিশ বক্স বিদ্যুৎ অফিস, বাস কাউন্টার রাজনৈতিক দলের কার্যালয় —ফায়ার সার্ভিস

  • মির্জা আব্বাসসহ ৮৪৯ জনের বিরুদ্ধে মামলা, ২৪ মামলার প্রস্তুতি পুলিশের, আসামি ৬৮২

গাড়ি পুড়িয়েছে, স্টাফ হত্যা করেছে, ভবিষ্যতেও এ ধরনের কর্মসূচিতে যান চলাচল স্বাভাবিক রাখব 
—পরিবহন মালিক সমিতি

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে শান্তিপূর্ণ সমাবেশ থেকে সহিংস কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে আবারও জ্বালাও-পোড়াও কর্মসূচিতে ফিরেছে বিএনপি। সাংবাদিক ও পুলিশের ওপর বর্বর হামলার পাশাপাশি গণপরিবহনেও আগুন দিয়ে ভয়ের রাজনীতির প্রদর্শনী শুরু করেছে বিএনপি-জামায়াত। সেই ধারাবাহিকতায় প্রায় চার বছর পর ফের গতকাল রোববার হরতাল কর্মসূচি পালন করে তারা। এর আগে, ২০২০ সালের ২ ফেব্রুয়ারি সর্বশেষ হরতাল কর্মসূচি পালন করে দলটি। পুলিশ ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে নিজেদের মহাসমাবেশে হামলার অভিযোগ তুলে ডাকা হরতালে সকাল থেকেই রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় গণপবিহনসহ বিভিন্ন গাড়িতে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। 

রাজধানীতে শিকড়, বিহঙ্গ, অছিম, পরিস্থান, বিআরটিসিসহ বিভিন্ন পরিবহন সংস্থার বাসে অগ্নিসংযোগ এবং ভাঙচুরের তথ্যও পাওয়া গেছে। যদিও এতে কোনো হতাহতের খবর জানা যায়নি। এদিকে জাতীয় নির্বাচনের আগে আগে এমন কর্মসূচিতে জনমনে তৈরি হয়েছে উৎকণ্ঠা। গতকাল দিনের শুরুর দিকে হরতালের কারণে বাস টার্মিনালগুলোতে ছিল না স্বাভাবিক চিত্র। হরতালে বাস চালানোর ঘোষণা থাকলেও সকালে ছাড়েনি দূরপাল্লার গাড়ি। তবে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রাস্তায় গণপরিবহন বাড়ে। যদিও স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় কিছুটা কম। এরই মধ্যে হরতালের পর এবার সর্বাত্মক অবরোধ কর্মসূচিও ঘোষণা করেছে বিএনপি। ৩১ অক্টোবর থেকে ২ নভেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে এই কর্মসূচি পালন করা হবে।

তবে এ নিয়ে পরিবহন মালিক সমিতির নেতারা বলছেন, বিএনপি-জামায়াতের ডাকা নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি এড়াতে সকাল থেকেই রাস্তায় যাত্রীর উপস্থিতি কম ছিল। যে কারণে গাড়িও কম ছিল। দূরপাল্লার গাড়িও বের হয়েছে, শহরের গাড়িও বের হয়েছিল। মালিক সমিতির মহাসচিব এনায়েত উল্লাহ বলেন, ‘কিছু গাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে, স্টাফ হত্যা করা হয়েছে। ফলে একটু তো ভয় কাজ করে। শুধু আজকে না, বিএনপি সব সময় এ ধরনের কাজ করে আসছে। আমরা ভবিষ্যতেও এ ধরনের কর্মসূচিতে যান চলাচল স্বাভাবিক রাখব।’ ঢাকায় দুয়েকটি স্থানে হরতালের সমর্থনে ঝটিকা মিছিল বের করলেও রাস্তার কোথাও তেমন পিকেটিং দেখা যায়নি। ঢাকার বাইরের বিভিন্ন এলাকায় সংঘর্ষ, পিকেটিং ও যানবাহনে আগুন দেয়ার খবর পাওয়া গেছে। রেলপথ ও মহাসড়ক অবরোধের ঘটনাও ঘটেছে কোথাও কোথাও। পিকেটারদের রুখে দতে অন্যান্য বারের মতোই রাজধানীসহ সারা দেশে তৎপর ছিল পুলিশ, বিজিবি, র্যাব ও আনসার সদস্যরা। টহল ও তল্লাশিতে দৃশ্যমান ছিল তৎপরতা। রাস্তায় মোতায়েন ছিল এন্টিপার্সোনাল কার (এপিসি), জলকামান, রায়টকারসহ দাঙ্গা দমনের সরঞ্জাম। এরই মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ সমাবর্তনে যোগ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মরণোত্তর ‘ডক্টর অব লজ’ ডিগ্রি দিতে বিশেষ এই সমাবর্তনের আয়োজন করা হয়। 

গতকালের হরতালে ঢাকার মিরপুরসহ একাধিক স্থানে ঢিলেঢালা ভাব লক্ষ্য করা গেছে। পল্লবীর সিটি ক্লাবে একটি ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটলেও হরতালের প্রতিবাদে গুলিস্তানে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগসহ, বিভিন্ন স্থানে শান্তি সমাবেশ করে আওয়ামী লীগ। বিএনপির কর্মসূচির তীব্র সমালোচনা করে মাঠে থেকে বিএনপিকে প্রতিহত করার ঘোষণাও দিয়েছে দলটি। ফায়ার সার্ভিস সদর দপ্তর জানায়, শনিবার দুপুর থেকে গতকাল সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত সারা দেশে ৪৫টি আগুন দেয়া হয়েছে। এসবের মধ্যে ঢাকা সিটি কর্পোরেশন এলাকায় ২৭টি আগুনের ঘটনা ঘটে। গতকাল সারা দেশে মোট ১৩টি আগুনের সংবাদ পাওয়া যায়। এর মধ্যে চারটি ঢাকা সিটি এলাকায়। আগুন দেয়ার ঘটনার মধ্যে ৪১টি ঢাকা বিভাগে, একটি রাজশাহী বিভাগ, দুটি খুলনা বিভাগে, একটি রংপুর বিভাগে ঘটে এবং এসব অগ্নিকাণ্ডে ১৯টি বাস, তিনটি মাইক্রোবাস, তিনটি অ্যাম্বুলেন্স, একটি ট্রাক, সাতটি মোটরসাইকেল, তিনটি পিকআপ, একটি সিএনজি পুড়ে যায়। এ ছাড়া পুলিশ বক্স, বিদ্যুৎ অফিস, বাস কাউন্টার, রাজনৈতিক দলের কার্যালয়েও আগুনের ঘটনা ঘটে। 

এ ছাড়া বিএনপির মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে পুলিশ হত্যার উদ্দেশে ককটেল বিস্ফোরণ ও পুলিশের অস্ত্র ছিনিয়ে নেয়ার অভিযোগে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসসহ ৮৪৯ জনের বিরুদ্ধে শাহজাহানপুর থানার এসআই মোস্তাফিজুর রহমান বাদী হয়ে একটি মামলা করেন। মামলায় এজহারনামীয় আসামি করা হয়েছে মির্জা আব্বাসসহ ৪৯ জনকে। অজ্ঞাত পরিচয় আসামি করা হয়েছে আরও প্রায় ৮০০ জনকে। এ ছাড়া পুলিশ সদস্য নিহত, নাশকতা ও ভাঙচুরসহ ২৪টি মামলার প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে বলেও জানা গেছে। এতে আসামিও করা হয়েছে ৬৮২ জনকে। ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) ড. খ মহিদ উদ্দিন বলেছেন, মামলা অনেক হবে। বেশ কিছুর প্রস্তুতি চলছে। আটক অনেক আছে। আরও আটকের অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানও বলেছেন, মামলা শুরু হয়েছে। অনেকে মামলা দেবে। যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তারাও মামলা দেবে। পুলিশ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মামলা দেবে। পুলিশ মামলা দেবে। প্রধান বিচারপতির বাড়িতে হামলা হয়েছে, সেই মামলাও তো হবে। সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করে মামলা দেয়া হবে।

ঢাকার বাইরেও তাণ্ডব চালিয়েছে হরতাল সমর্থকরা। এর মধ্যে বগুড়ার সদর উপজেলার ইউএনও ফিরোজা পারভীন ও রোগীবাহী মিনিবাসেও হামলার ঘটনা ঘটে। এতে রোগীবাহী মিনিবাসে থাকা তিনজন আহত হন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে জেলা গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) গুলি ছোড়ে। এতে দুই শিশু ও পাঁচ হরতাল সমর্থক গুলিবিদ্ধ হয়। উপজেলার ঢাকা-রংপুর মহাসড়কে বাঘোপাড়া খোলারঘরে এ ঘটনা ঘটে। পরে বাঘোপাড়ার উত্তরপাড়া জামে মসজিদ থেকে ডিবি পুলিশের সদস্যদের এলাকা ছেড়ে যাওয়ার অনুরোধ করা হয়। এ সময় মাইকে বলা হয়, ‘ডিবি পুলিশের ভাইয়েরা আপনারা এলাকা থেকে চলে যান। আপনাদের গুলিতে শিশুরা আহত হয়েছে। অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটতে পারে, এলাকাবাসীও সরে যান।’ এর পরই শত শত ক্ষুব্ধ গ্রামবাসী পুলিশ ও সাংবাদিকদের ওপরে হামলা চালান। এ সময় তিন সাংবাদিক ও দুই ডিবি পুলিশের সদস্য আহত হন।
 

Link copied!