নভেম্বর ১২, ২০২৩, ১২:০৩ এএম
বর্তমানে টালমাটাল অর্থনীতির প্রধান সমস্যা অর্থপাচার। সর্বত্র দুর্নীতি আর লুটপাটের মাধ্যমে দেশ থেকে বিপুল অর্থ সরিয়ে নিচ্ছে একটি চক্র। এর প্রভাবে মূল্যস্ফীতি লাগামহীন বৃদ্ধিসহ নানামুখী সমস্যায় জর্জরিত হয়ে নাগরিকদের নাভিশ্বাস উঠেছে। এতে সরকারের নজিরবিহীন উন্নয়ন কর্মকাণ্ড আড়ালেই থেকে যাচ্ছে। দুর্নামের ভাগ সরকার ও সরকারি দলের নেতাদের কাঁধে চাপিয়ে পকেট ভারী করছে কতিপয় ব্যবসায়ী ও আমলা। অথচ পাচারকারীদের হাতেনাতে ধরার পরও নাম প্রকাশ করছে না বাংলাদেশ ব্যাংক। বিশ্লেষকরা বলছেন, চক্রটি ক্ষমতার কেন্দ্রে ঘাঁটি গেড়েছে, তাই তাদের নিয়ে বিপাকে পড়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও দুর্নীতিবিরোধী সংস্থাগুলো।
প্রতিনিয়ত পাচারের নতুন নতুন গন্তব্য আবিষ্কার হচ্ছে। একসময় যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া, সুইজারল্যান্ড প্রভৃতি দেশ পাচারের গন্তব্য ছিল। কিন্তু বর্তমানে দুবাই, মালয়েশিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশের নাম উঠে আসছে। আফ্রিকার বিভিন্ন দেশেও অর্থপাচারের তথ্য ছিল গোয়েন্দা সংস্থার কাছে। সম্প্রতি অর্থপাচারের নতুন আরেক গন্তব্য খুঁজে পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ইউরোপের দেশ পর্তুগালে অর্থপাচারের ঘাঁটি গেড়েছে বাংলাদেশের আড়াই হাজার নাগরিকের একটি বিশাল চক্র। নিরাপদে অর্থ সরিয়ে নিতে তারা দেশটির নাগরিকত্বও গ্রহণ করেছে। ইতোমধ্যে দেশটিতে সাড়ে ১৪ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশ দুবাইয়ের পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ। বর্তমানে অর্থপাচারের প্রধান রুট হিসেবে দেশটিকে ব্যবহার করছে দুর্নীতিবাজ চক্রটি। পাচারকার্য পরিচালনার জন্য দুবাইয়ে ১৩ হাজার প্রতিষ্ঠান খুলেছে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা। সেখানে বিনিয়োগ করা হয়েছে ৬৫ হাজার কোটি টাকা। রাজনীতিবিদ ও আমলাদের অর্থপাচারের বাহক হিসেবে কাজ করছে ব্যবসায়ী গোষ্ঠীগুলো। প্রভাবশালীদের প্রশ্রয়ে আমদানি-রপ্তানির আড়লে এবং হুন্ডির মাধ্যমে বিপুল অর্থ পাচার করে বিদেশে বিশাল সাম্রাজ্য গড়েছে কয়েকটি শিল্পগ্রুপ। তাদের হাতেনাতে ধরার পরও শাস্তি দেয়া দূরে থাক, নামটি পর্যন্ত মুখে আনতে পারছেন না খোদ বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার। কারণ, তারা সবাই ক্ষমতার কেন্দ্রে ঘাঁটি গেড়েছেন।
গত ৬ নভেম্বর অর্থনীতি বিটের সাংবাদিকদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন গভর্নর। চলমান সংকট মোকাবিলায় করণীয় ঠিক করতে এ বৈঠকের আয়োজন করা হয়। এ সময় সাংবাদিকদের পরামর্শ ও প্রস্তাব শোনেন গভর্নর, অর্থ সচিব, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। আলোচনায় উঠে আসে বর্তমান সংকটের নেপথ্যে প্রধান সমস্যা হলো অর্থপাচার। এ-সংক্রান্ত তথ্য উপস্থাপন করতে গিয়ে গভর্নর বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান দায়িত্ব আর্থিক ও মূল্য স্থিতিশীলতা বজায় রাখা। আমরা এ জন্য কাজ করছি। অর্থপাচার খুবই খারাপ আকার ধারণ করেছিল। বাণিজ্যের আড়ালে অর্থপাচার বন্ধ করা হয়েছে। সব ধরনের ঋণপত্রের মূল্য পরীক্ষা করা হচ্ছে। হুন্ডির চেয়ে ১০ গুণ বেশি অর্থপাচার হয়েছে বাণিজ্যের আড়ালে। ১০০ ডলারের পণ্য আনতে ৩০০ ডলার পাঠানো হয়েছে। দুবাইতে ১৩ হাজার কোম্পানি খুলেছে বাংলাদেশিরা, প্রতিজন পাঁচ কোটি টাকা করে বিনিয়োগ করেছে। পর্তুগালে আড়াই হাজার বাংলাদেশি নাগরিকত্ব নিয়েছেন। প্রত্যেকে পাঁচ লাখ ইউরো করে বিনিয়োগ করেছেন। এই অর্থ বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়ে গেছে।’
তবে পাচারকারীদের নাম প্রকাশ করেননি গভর্নর। এর আগে পৃথক সংবাদ সম্মেলনে গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার ও বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রধান মাসুদ বিশ্বাস জানান, ওভার ও আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের আড়ালে অর্থপাচার করেন কতিপয় ব্যবসায়ী। পণ্যের দাম ২০০-৩০০ শতাংশ পর্যন্ত বেশি দেখিয়ে ওভার ইনভয়েসিং এবং পণ্যের দাম অস্বাভাবিক কম দেখিয়ে আন্ডার ইনভয়েসিং করা হচ্ছিল। এলসি যাচাইয়ের মাধ্যমে পাচারকারীদের হাতেনাতে ধরা হয়। কিন্তু আমার সংবাদের পক্ষ থেকে পাচারকারীদের নাম জানতে একাধিকবার আবেদন করলেও তথ্য দেয়নি বাংলাদেশ ব্যাংক।
অপর এক সংবাদ সম্মেলনে অর্থপাচারের পেছনে বড় শিল্পগ্রুপ জড়িত বলে জানায় ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি)। সংগঠনটির নেতারা বলেন, ‘বাণিজ্যের আড়ালে প্রতি মাসে দেড় বিলিয়ন ডলার পাচার করেছিল কয়েকটি বড় শিল্পগ্রুপ। ব্যাংকাররা এটি রুখতে ব্যর্থ হয়। ফলে তাদের ওপর আস্থা হারিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক তদারকি শুরু করে। আমদানি ঋণপত্র পরীক্ষার মাধ্যমে পাচারের তথ্য উদ্ঘাটন করে তা বন্ধে পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।’ কিন্তু সুনির্দিষ্টভাবে পাচারকারীদের নাম উল্লেখ করতে অস্বীকৃতি জানান এবিবি নেতারা।
গত বছরের ১১ সেপ্টেম্বর পুলিশের ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্টের (সিআইডি) দেয়া তথ্যমতে, শুধু হুন্ডি প্রক্রিয়ায় দেশ থেকে প্রতিবছর গড়ে ৭৫ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে। এর সঙ্গে আমদানির ওভার ইনভয়েসিং, রপ্তানির আন্ডার ইনভয়েসিং এবং রপ্তানি আয় দেশে ফেরত না আনার মতো মূল সমস্যাগুলো যোগ করলে দেখা যাবে প্রতিবছর কমপক্ষে দেড় লাখ কোটি টাকার সমপরিমাণের বৈদেশিক মুদ্রা থেকে বাংলাদেশ বঞ্চিত হচ্ছে, যার অর্ধেকের মতো পাচার হচ্ছে হুন্ডির মাধ্যমে।
অন্যদিকে ওয়াশিংটনভিত্তিক সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির (জিএফআই) তথ্য অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর গড়ে ৭৫৩ কোটি ৩৭ লাখ ডলার পাচার হয়। ওই সময়ের বাজারদর অনুযায়ী (৮৫ টাকায় প্রতি ডলার) এর পরিমাণ ৬৪ হাজার কোটি টাকা এবং বর্তমান বাজারদর (১১১ টাকা প্রতি ডলার) অনুযায়ী সাড়ে ৮৩ হাজার কোটি টাকা, যা ১৩৫টি উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে গড় অর্থপাচারের হিসাবে বাংলাদেশের অবস্থান ৩৩তম। অন্যদিকে সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২১ সালে দেশটির বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশিদের গচ্ছিত অর্থের পরিমাণ ছিল বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় আট হাজার ২৭৫ কোটি টাকা।
জানা গেছে, বিলাসী জীবনযাপনের নিশ্চয়তা এবং ‘ট্যাক্স হেভেন’ সুবিধা পাওয়ার আশায় বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশ থেকে অর্থপাচারের জন্য এতদিন নিরাপদ গন্তব্য ছিল যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, সুইজারল্যান্ড এবং বেশ কিছু দ্বীপরাষ্ট্র। পাচারকারীদের কাছে অবৈধ অর্থ স্থানান্তরের স্বর্গরাজ্য হয়ে উঠেছিল সিঙ্গাপুরও। এসব দেশে অর্থ পাচারকারীদের তালিকায় অনেক বাংলাদেশিও আছেন। সুনির্দিষ্ট তথ্য-উপাত্ত না থাকলেও বাংলাদেশ ব্যাংক, দুর্নীতি দমন কমিশনসহ অর্থপাচার প্রতিরোধে দায়িত্বশীল সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর ধারণা, বাংলাদেশ থেকে দুর্নীতিবাজরা সিঙ্গাপুরে বিপুল পরিমাণ টাকা পাচার করেছেন। ওই অর্থে তারা সেখানে ফ্ল্যাট, বাড়ি-গাড়ি ও বিভিন্ন ব্যবসায় বিনিয়োগ করে বিলাসী জীবনযাপন করছেন।
সম্প্রতি ফের আলোচনায় আসে কানাডার ‘বেগমপাড়া’, যা বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশের অর্থ পাচারকারীদের দ্বিতীয় আবাসস্থলের একটি প্রতীকী নাম। কানাডা সরকারের তথ্যমতে, দেশটিতে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য ২০১৫ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর তিন হাজারের বেশি বাংলাদেশিকে সুযোগ দেয়া হয়। তার আগে ২০০৬ থেকে ২০১৯ সালের নভেম্বর পর্যন্ত ৪৪ হাজার ১৮৬ বাংলাদেশিকে কানাডিয়ান গ্রিন ভিসা (পিআর) দেয়া হয়। অভিযোগ আছে, যেসব বাংলাদেশি বিনিয়োগকারী কোটায় কানাডায় পিআরের সুযোগ পেয়েছেন, তাদের একটা অংশ মূলত অবৈধভাবে অর্জিত টাকা কানাডায় নিয়ে বিনিয়োগ করেছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো থেকে জানা যায়, অস্ট্রেলিয়াতেও বাংলাদেশসহ কয়েকটি দেশের নাগরিকের বাড়ির সন্ধান পাওয়া গেছে। তাদের প্রায় সবাই বিদেশি শিক্ষার্থী। এদের কারো কারো পেট্রোল পাম্প ও কফিশপসহ অন্যান্য ব্যবসা আছে। চলতি বছরে সেন্ট্রাল লন্ডনের কেনসিংটনের মতো বিলাসবহুল এলাকায়ও বাংলাদেশিদের ৯৮টি বাড়ির সন্ধান মিলেছে। যুক্তরাজ্যের হাউসবিল্ডিং শিল্প খাতবিষয়ক সাময়িকী শোহাউস জরিপে এমন তথ্য উঠে এসেছে। এতে উল্লেখ করা হয়, লন্ডনের সম্পত্তিতে বিনিয়োগকারী শীর্ষ ১০ দেশের তালিকায় নবম অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। যাদের বেশিরভাগই অবৈধ প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ থেকে অর্থ নিয়ে সেখানে বাড়ি-গাড়ি কিনেছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
সম্প্রতি মালয়েশিয়া সরকার ‘মাই সেকেন্ড হোম’ প্রকল্প চালু করেছে। এর আওতায় এখন পর্যন্ত আট হাজারেরও বেশি বাংলাদেশি ‘সেকেন্ড হোম’ সুবিধা নিয়ে মালয়েশিয়ায় ফ্ল্যাট কিনে বসবাস করছেন বলে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। জানা গেছে, বিদেশি নাগরিকদের স্থায়ী বসবাস বিবেচেনায় বাংলাদেশিদের অবস্থান তৃতীয়। দুদক সূত্রের বরাতে গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য বলছে, মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম নির্মাণকারীদের মধ্যে বাংলাদেশের ৬৪৮ বিশিষ্ট ব্যক্তি রয়েছেন। তাদের মধ্যে আওয়ামী লীগের ২৮৭, বিএনপি ও সমমনাদের ৯৬ এবং বাকি ২৬৫ জন সুবিধাভোগী শিল্পপতি, ব্যবসায়ী ও আমলা। এদের মাধ্যমে গত পাঁচ বছরে অন্তত চার হাজার ৯৮৬ কোটি টাকার সমপরিমাণ মার্কিন ডলার মালয়েশিয়ায় পাচার হয়েছে।
সম্প্রতি মধ্যপ্রাচ্যের সংযুক্ত আরব অমিরাত এবং আফ্রিকার অনুন্নত কিছু দেশে পাচারের চিত্র নানাভাবে উঠে এসেছে। ধনী দেশগুলো আবাসন সংকটে বিনিয়োগ সুবিধা কমিয়ে দেয়ার বিপরীতে এসব দেশ বিদেশিদের বৈধ ও অবৈধ পুঁজি আকর্ষণ করার চেষ্টা করছে।
বিশেষ করে ‘গোল্ডেন ভিসা’ পদ্ধতি চালু করেছে সংযুক্ত আরব আমিরাত। ২০১৯ সালে এ গোল্ডেন ভিসার সুবিধা নিয়ে বাংলাদেশের অসংখ্য ব্যবসায়ী গত সাড়ে তিন বছর যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া ও কানাডার পাশাপাশি দুবাইয়ে পুঁজি পাচারকে আকর্ষণীয় বিষয় হিসেবে বেছে নিতে শুরু করেছেন। সংযুক্ত আরব আমিরাতে, বিশেষত দুবাইয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য এবং নির্মাণ কার্যক্রমের শাখা খোলা এখন বাংলাদেশের মধ্যম পুঁজিপতিদের কাছেও ক্রমেই আকর্ষণীয় ও বিকল্প হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। যেখানে কেউ ২০ লাখ দিরহাম (বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ছয় কোটি টাকা) বিনিয়োগ করলে বা আমিরাতের কোনো ব্যাংকে জমা রাখলে তাকে ১০ বছরের জন্য কোনো প্রশ্ন ছাড়া আমিরাতে অবাধে প্রবেশের ভিসা দেয়ার ব্যবস্থা চালু করা হয়।