নভেম্বর ১৩, ২০২৩, ১২:০৪ এএম
শুরু হয়েছে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের ক্ষণগণনা। গত ২ নভেম্বর একাদশ সংসদের সমাপনী অধিবেশন শেষ হওয়ার মধ্য দিয়ে ৯০ দিনের নির্বাচনি যাত্রা চলছে। চলতি সপ্তাহে ঘোষণা হতে পারে তফসিল। তবে এখনো আশা যায়নি কোনো রাজনৈতিক সমঝোতায়। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল উন্নয়নের মহড়া দিচ্ছে সারা দেশে। অন্যদিকে হরতাল-অবরোধসহ সিরিজ কর্মসূচি অব্যাহত রেখেছে বিএনপিসহ এক দফার আন্দোলনের সঙ্গীরা। ইসির কোনো আহ্বানেও সাড়া দিচ্ছে না বিরোধীরা।
গত ২৮ তারিখের পর থেকে টানা ১৬ দিন দেশের অন্যতম রাজনৈতিক দল তিনবার রাষ্ট্র নেতৃত্বে থাকা বিএনপি কার্যালয়ে তালা ঝুলছে। দলটির সেকেন্ডম্যান বিএনপি মহাসচিবসহ শীর্ষ নেতারা কারাগারে। দলের প্রায় কয়েক লক্ষাধিক নেতাকর্মী হামলা, মামলা ও গ্রেপ্তার আতঙ্কে বাড়িঘর ছাড়া। বিএনপি মিডিয়া সেল নিয়মিত ছবি প্রকাশ করে জানাচ্ছে নেতাকর্মীরা পুলিশের ভয়ে ধানক্ষেত, বন জঙ্গলে রাত্রিযাপন করছে। গ্রেপ্তার এড়িয়ে তারা ঢাকাসহ সারা দেশেই কেন্দ্রীয় কর্মসূচি পালন করছে। এর মধ্যেই চলছে রাজনৈতিক সহিংসতা। দিনে এবং রাতে যানবাহনে সিরিজ আকারে দেয়া হচ্ছে আগুন। বিরোধী দমনের চিত্রও দৃশ্যায়িত বলে অনেকে মনে করছেন। সরকারবিরোধীদের দায়ী করেছে ক্ষমতাসীন দল। অপরদিকে বিরোধীরা এর পেছনে সরকারের ইন্ধন ও পরিকল্পনার কথা বলছে। এমন পরিস্থিতিতে চলছে কূটনৈতিক স্নায়ুযুদ্ধ। রাজনীতিতে চোখ রাখা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নীতির কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না।
অর্থাৎ বাংলাদেশ নিয়ে আমেরিকা, ভারত এখন দুই মেরুতে রয়েছে। চীনের আধিপত্য যেন তৈরি না হয় সেদিকেও ওপারের কড়া নজর রয়েছে। সাংঘর্ষিক রাজনৈতিক কূটনৈতিক স্বার্থের মধ্যে বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে নির্বাচন কমিশন। রাজনৈতিক দলের অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিতে ইসির দুর্বল ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। এর মধ্যে তফসিল ঘোষণা না করতে দেশের কয়েকটি রাজনৈতিক দল থেকে আহ্বান করা হয়েছে। তফসিল ঘোষণা হলে সারা দেশে ভয়ানক পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে বলেও ইঙ্গিত দেয়া হচ্ছে। উদ্ভূত সব পরিস্থিতির জন্য কমিশন দায়ী থাকবে বলেও বলা হচ্ছে। রাজনৈতিক সূত্রগুলোর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তফসিলকে সামনে রেখে দেশের সব বিরোধী রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সখ্যতা বাড়িয়েছে বিএনপি। এর সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ বিদেশি উইংও যুক্ত রয়েছে। সবাই স্ব স্ব উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে তৎপর। বিএনপি নির্বাচনকে সামনে রেখে এক গুচ্ছ কর্মসূচি সাজিয়েছে। মাঠপর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক সরাসরি যোগাযোগ রাখছেন। কারা রাজপথে আন্দোলনের চূড়ান্ত নেতৃত্বে থাকবে তা শুধু দলের ওয়ান পার্সনই জানেন। শীর্ষ নেতারা আটক কিংবা দলের হাইকমান্ডের মধ্যে পন্থি ও এজেন্ট নিয়েও চিন্তিত নয়। সব কিছু দৃষ্টি রেখেই বিকল্প প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে রেখেছে বিএনপি।
তফসিল ঘোষণা হলেই তা বাস্তবায়ন করা হবে। দেশে ডান-বাম রাজনৈতিক দল ছাড়াও ইসলামপন্থি দলের বড় শক্তিকে বিএনপি গুরুত্ব দিচ্ছে। এক সময়ের জোটসঙ্গী জামায়াতের সঙ্গে গভীর যোগাযোগ বাড়ানো হয়েছে। পর্দার আড়ালে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে কর্মসূচিও ঠিক করা হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রের ভাষ্য। জামায়াতে ইসলামীও সরকার পতনের আন্দোলনের জন্য নিজস্ব ছক তৈরি করছে। সারা দেশে আন্দোলন কোন পদ্ধতিতে হবে এ নিয়ে দলটির মধ্যে এখন নিয়মিতই সিরিজ বৈঠক চলছে। জামায়াতের সূত্রগুলো বলছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার আন্দোলনে জামায়াত এর আগেও দলটির সাবেক আমির গোলাম আজমের ফর্মুলায় সফল হয়েছে। এবারও হবে। আদর্শের ভিন্নতা থাকলেও এখন উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে বিএনপির নির্দেশনার অপেক্ষায় রয়েছে। এদিকে চরমোনাইয়ের ইসলামী আন্দোলনও সরকার পতনে বিএনপি-জামায়াতের কর্মসূচিকে সমর্থন জানিয়ে মাঠে রয়েছে। তারা হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন এবার ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন হবে না। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই নির্বাচন করতে হবে।
গেলো সপ্তাহে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিশাল সমাবেশ করে বড় শোডাউন দিয়েছে। গতকাল তারা সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন, রাজনৈতিক সমঝোতা ছাড়া এবং সবার জন্য সমান সুযোগ (লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড) তৈরির আগে কোনো অবস্থাতেই যেন তফসিল ঘোষণা না করা হয়। সমঝোতা ছাড়াই নির্বাচন কমিশন একতরফা তফসিল ঘোষণা করলে সেদিনই ঢাকায় নির্বাচন কমিশন অভিমুখে গণমিছিল করা হবে। তখন যদি ভিন্ন কোনো পরিবেশ তৈরি হয় তার জন্য কমিশন দায়ী থাকবে। দলটির আমির ও চরমোনাই পীর মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, তফসিল ঘোষণা করা হলে নির্বাচন কমিশন অভিমুখে গণমিছিল ছাড়াও সারা দেশে প্রতিটি জেলা ও মহানগরে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ মিছিল করা হবে। উদ্ভূত পরিস্থিতির দায় নির্বাচন কমিশনকেই নিতে হবে। বিএনপি ও ইসলামন্থি দলগুলো ছাড়াও ডান-বামদের বড় একটি অংশও রাজপথে রয়েছে। বিএনপিও মনে করছে, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলগুলোর ব্যানার পলিটিক্সও দরকার। তারা পল্টন প্রেসক্লাবকেন্দ্রিক কর্মসূচি পালন করলে পুলিশ তাদের বাধা দেবে না। তাদের মধ্যে আন্দোলনের ফলাফল ঘরে না উঠলেও কিছু প্রচারণা হলেও কাজে আসবে। তাদের মাধ্যমে কৌশলভিত্তিক কিছু প্রস্তাবনা তুলে ধরা হবে। কিংবা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যগুলোও বাস্তবায়নে কাজে আসবে।
গতকাল সরকারবিরোধী একটি কর্মসূচিতে যোগ দিয়ে রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক হাসনাত কাইয়ুম বলেছেন, এ সরকারের পদত্যাগের জন্য যারা লড়ছে, তাদের সামনে আরও ত্যাগ স্বীকার করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনকে গণতান্ত্রিক বলে প্রতিবেশী দেশ ভারত এ সরকারকে বৈধতা দিয়ে আজ পর্যন্ত টিকিয়ে রেখেছে। এখনো ভারত অতীত অবস্থান নিয়েছে। তারা বাংলাদেশের পানি নিয়ে পানিতে মারবে, সীমান্তে মারছে, বাংলাদেশের বন্দর ব্যবহার করছে, রাস্তা ব্যবহার করছে, বাংলাদেশের জনগণকে যারা হত্যা করে তাদের মদত দিচ্ছে; তারপরও এ দেশের জনগণ তাদের বন্ধু মনে করবে, সেই দিন আর নেই। পরিস্থিতি যে কোনো সময় ভিন্নদিকে যেতে পারে।
তফসিল ঘোষণা পরবর্তী দেশের রাজনীতি নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করছে বাংলাদেশ জাসদও। গতকাল গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতির মাধ্যমে বলা হয় বর্তমানে দেশে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পরিবেশ নেই। রাজনৈতিক সমঝোতা হওয়ার আগে তফসিল ঘোষণা না করার জন্য নির্বাচন কমিশনের (ইসি) প্রতি আহ্বান জানান তারা। বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ক্ষমতাসীন সরকারের অহমিকা, ক্ষমতালিপ্সা ও একগুঁয়েমির কারণে রাজনৈতিক অচলাবস্থা ও দেশব্যাপী জনজীবনের নিরাপত্তাহীনতা তৈরি হয়েছে। ভিন্ন কোনো পরিবেশ তৈরি হলে কমিশন দায় এড়াতে পারবে না। এদিকে আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা এখন প্রায় অনেকটাই স্পষ্ট হয়ে গেছে। ভারত, চীন স্বার্থসংশ্লিষ্ট সমীকরণ তৈরি হয়েছে। চাপ তৈরিতে দেয়া হয়েছে র?্যাব নিষেধাজ্ঞা। ভিসানীতির পর ভিসানীতির প্রয়োগও শুরু হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধু দেশগুলোও এর সঙ্গে তাল মেলাচ্ছে বলে কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে। অর্থনৈতিক বিষয়ে চাপ তৈরিতেও নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। এছাড়া সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোতেও তারা চোখ রাঙাচ্ছে। সামনে আরও নেতিবাচক কিছু তাদের সিদ্ধান্ত আসার সম্ভাবনা দেখছে কূটনীতিকরা। এমন পরিস্থিতিতে ক্ষমতাসীন দলের অনেকেই যুক্তরাষ্ট্রের ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করছে।
সমপ্রতি মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসকে পেটানোর হুমকি দিয়েছেন চট্টগ্রামের বাঁশখালীর ইউপি চেয়ারম্যান মুজিবুল হক। এ ছাড়া ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনান পিটার হাসকে রাজহাঁসের সঙ্গে তুলনা ও জবাই প্রসঙ্গে ইঙ্গিতবাচক শব্দ ব্যবহার করেছেন। এ নিয়ে মার্কিন দপ্তর থেকে ক্ষোভ প্রকাশ করে আগাম শঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, তফসিল ঘোষণার সঙ্গে বিরোধী রাজনৈতিক দলের সঙ্গে মার্কিন বিষয়গুলোও স্পষ্ট হয়ে যাবে। তাদের চূড়ান্ত উদ্দেশ্যগুলোও দৃশ্যায়িত হয়ে যাবে। সামগ্রিক বিষয়ে জানতে চাইলে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক প্রফেসর ইমতিয়াজ আহমেদ আমার সংবাদকে বলেন, কূটনৈতিক কিছু বিষয় আছে নির্বাচন এলে আমরা সেগুলো সব সময় দেখে আসছি। তবে এ বিষয়গুলো একান্ত বাংলাদেশের। এদেশের নাগরিকরাই সেগুলো সমাধান করতে যথেষ্ট। এবার নির্বাচনকে সামনে রেখে আমেরিকা বেশি উৎসাহ দেখাচ্ছে, আমরা সেগুলো দেখতে পাচ্ছি। এ নিয়ে একটি রাজনৈতিক দল কিছুটা সন্তোষ দেখালেও আবার অন্যদল বিরক্ত— এগুলোও আমাদের চোখে পড়ছে।
সমপ্রতি ভারতের সঙ্গে আমেরিকার যে আলোচনা হয়েছে ভারত তার অবস্থান স্পষ্ট করতে পেরেছে বলে ধারণা করছি। ভারত বাংলাদেশের বন্ধুরাষ্ট্র হিসেবে তাদের অবস্থান চাইবে। এখানে অন্য কেউ এসে মাথা ঘামাক এটা ভারত চাইবে না। আবার চীনও এই অঞ্চলে কোনো বড় অবস্থান তৈরি করুক সেটাও চাইবে না। আবার আমেরিকাও তাদের নিরাপত্তা কাঠামো দুর্বল হোক সেটি চাইবে না। আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে বেশ কিছু সমীকরণ তৈরি হয়েছে। তফসিল ঘোষণার পর বিষয়গুলো স্পষ্ট হবে, এবং দেশের জনগণ অবশ্যই সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারবে।