নভেম্বর ১৫, ২০২৩, ১১:৪৯ পিএম
- সংলাপের মাধ্যমে সমঝোতা ও সমাধান অসাধ্য নয় : সিইসি
- মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ তারিখ ৩০ নভেম্বর
- মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাই ১ থেকে ৪ ডিসেম্বর
- আপিল দায়ের ও নিষ্পত্তি ৬ থেকে ১৫ ডিসেম্বর
- প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ তারিখ ১৭ ডিসেম্বর
- প্রার্থীদের মধ্যে প্রতীক বরাদ্দ ১৮ ডিসেম্বর
- প্রচারণা ১৮ ডিসেম্বর থেকে ৫ জানুয়ারি সকাল ৮টা
- ৩০০ আসনেই ভোট হবে ব্যালট পেপারে
আগামী ৭ জানুয়ারি ভোটগ্রহণের তারিখ নির্ধারণ করে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করল নির্বাচন কমিশন-ইসি। গতকাল সন্ধ্যা ৭টায় জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল এ তফসিল ঘোষণা করেন। সন্ধ্যা ৭টায় বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতারে সিইসির ভাষণ সমপ্রচার শুরু হয়। সিইসির ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী, মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ তারিখ আগামী ৩০ নভেম্বর। মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাই হবে আগামী ১ থেকে ৪ ডিসেম্বর। রিটার্নিং অফিসারের আদেশের বিরুদ্ধে কমিশনে আপিল দায়ের ও নিষ্পত্তি হবে ৬ থেকে ১৫ ডিসেম্বর। প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ তারিখ ১৭ ডিসেম্বর। রিটার্নিং অফিসাররা প্রতীক বরাদ্দ দেবেন ১৮ ডিসেম্বর। নির্বাচনি প্রচারণা চলবে ১৮ ডিসেম্বর থেকে আগামী ২০২৪ সালের ৫ জানুয়ারি সকাল ৮টা পর্যন্ত। ভোটগ্রহণ করা হবে ৭ জানুয়ারি রোববার। এবার ৩০০ আসনেই ভোট হবে ব্যালট পেপারে।
জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে সিইসি জানান, ৩০০ আসনে এই ভোট অনুষ্ঠান সম্পন্নের জন্য ৬৬ জন রিটার্নিং অফিসার ও ৫৯২ জন সহকারী রিটার্নিং অফিসারের নিয়োগ চূড়ান্ত করা হয়েছে। দেশের ৪২ হাজার ভোটকেন্দ্রের দুই লাখ ৬২ হাজার বুথে এবার প্রায় ১১ কোটি ৯৭ লাখ ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন। তফসিল ঘোষণার ভাষণে সিইসি বলেন, রাজনৈতিক মতানৈক্যের সমাধান প্রয়োজন। আমি সব রাজনৈতিক দলকে বিনীতভাবে অনুরোধ করব, সংঘাত পরিহার করে সমাধান অন্বেষণ করুন। সংলাপের মাধ্যমে সমঝোতা ও সমাধান অসাধ্য নয়। তিনি বলেন, মতভেদ থেকে সংঘাত ও সহিংসতা হলে তা থেকে সৃষ্ট অস্থিতিশীলতা নির্বাচনপ্রক্রিয়ায় বিরূপ প্রভাব বিস্তার করতে পারে। সিইসি আরও বলেন, আমি নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে সব রাজনৈতিক দলকে বিনীতভাবে অনুরোধ করব, সংঘাত ও সহিংসতা পরিহার করে সদয় হয়ে সমাধান অন্বেষণ করতে।
নির্বাচন কমিশন নির্বাচনে সব দলের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে সর্বদা স্বাগত জানাবে উল্লেখ করে সিইসি বলেন, পারস্পরিক প্রতিহিংসা, অবিশ্বাস ও অনাস্থা পরিহার করে সংলাপের মাধ্যমে সমঝোতা ও সমাধান অসাধ্য নয়। সিইসি বলেন, অবাধ, নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক ও উৎসবমুখর নির্বাচনের জন্য কাঙ্ক্ষিত অনুকূল রাজনৈতিক পরিবেশের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। কিন্তু নির্বাচন প্রশ্নে, বিশেষত নির্বাচনের প্রাতিষ্ঠানিক পদ্ধতির প্রশ্নে, দীর্ঘ সময় ধরে দেশের সার্বিক রাজনৈতিক নেতৃত্বে মতভেদ পরিলক্ষিত হচ্ছে। সিইসি বলেন, বহুদলীয় রাজনীতিতে মতাদর্শগত বিভাজন থাকতেই পারে। সংলাপের মাধ্যমে সমঝোতা ও সমাধান অসাধ্য নয় উল্লেখ করে সিইসি বলেন, পরমতসহিষ্ণুতা, পারস্পরিক আস্থা, সহনশীলতা এবং সহমর্মিতা টেকসই ও স্থিতিশীল গণতন্ত্রের জন্য আবশ্যকীয় নিয়ামক। জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে সিইসি উল্লেখ করেন, সরকার আসন্ন সংসদ নির্বাচনকে সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক ও শান্তিপূর্ণ করার লক্ষ্যে সুস্পষ্ট প্রতিশ্রুতি বারবার ব্যক্ত করেছে। কমিশনও তার আয়ত্তে থাকা সর্বোচ্চ সামর্থ্য দিয়ে এবং সরকার থেকে আবশ্যক সব সহায়তা নিয়ে নির্বাচনকে অবাধ, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ করার বিষয়ে সততা, নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করবে। সংবিধানে সংসদের মেয়াদ পূর্তির আগের ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন আয়োজনের সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে উল্লেখ করে সিইসি বলেন, এ নির্দেশনা নির্বাচন কমিশন সরকারের নির্বাহী বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তা নিয়ে সম্পন্ন করে থাকে।
সিইসি উল্লেখ করেন, নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক হতে পারে কেবল সংশ্লিষ্ট প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্ট সবার সমন্বিত সহযোগিতা ও অংশগ্রহণের মাধ্যমেই। রাজনৈতিক দলগুলো গণতান্ত্রিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে প্রার্থী দিয়ে নির্বাচনে কার্যকরভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলে কেন্দ্রে কেন্দ্রে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা হয়, নির্বাচন আরও পরিশুদ্ধ ও অর্থবহ হয়। তাতে জনমতেরও শুদ্ধতর প্রতিফলন ঘটে। সইসি তার ভাষণের শেষ দিকে নির্বাচনপ্রক্রিয়ায় সব রাজনৈতিক দল, প্রার্থী ও জনগণের অংশগ্রহণ ও সক্রিয় সহযোগিতা কামনা করেন।
এর আগে গতকাল বিকেলে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) ২৬তম সভা হয়। সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল ছাড়াও সভায় বেগম রাশেদা সুলতানা, মো. আলমগীর ও আনিছুর রহমানসহ কমিশনার এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা অংশ নেন। একই দিন সকাল ১০টায় আগারগাঁও নির্বাচন কমিশন ভবনে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে নির্বাচন কমিশনের সচিব মো. জাহাংগীর আলম বলেন, নির্বাচন কমিশন মনে করে নির্বাচনের পরিবেশ আছে। গত মঙ্গলবার এক ব্রিফিংয়ে ইসি সচিব মো. জাহাংগীর আলম জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া-বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লুর চিঠির কোনো প্রভাব তফসিলের ওপর পড়বে না। গত সোমবার আলোচনার উদ্যোগের অংশ হিসেবে দেশের প্রধান তিন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টিকে চিঠি দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া-বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু। সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের তাগিদ দিয়ে পাঠানো এ চিঠি দলগুলোর কাছে হস্তান্তর করেন ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস। বাংলাদেশে অবাধ সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চায় যুক্তরাষ্ট্র। সেই চাওয়ার কথা জানিয়ে এই চিঠি দেন ডোনাল্ড লু।
বিএনপি-জামায়াতে ইসলামীসহ রাজপথে থাকা বিরোধী দলগুলো নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে রয়েছে। আন্দোলনকারী দলগুলোর পক্ষ থেকে ইসিকে বারবারই বলা হয়েছিল, রাজনৈতিক সমঝোতার আগে তারা যেন তফসিল ঘোষণা না দেয়। কিন্তু সেই চাওয়াকে আমলে নেয়নি নির্বাচন কমিশন। কেউ কেউ বলেছিলেন, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপ হোক এটি নির্বাচন কমিশনও চেয়েছিল। প্রধান নির্বাচন কমিশনার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দফায় দফায় সংলাপ করার সময় অনেক রাজনৈতিক দলই অংশ নেয়নি, তবে যেসব রাজনৈতিক দল অংশ নিয়েছিল তাদের সঙ্গে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছিলেন, চলমান সংকট নিরসনে রাজনৈতিক দলগুলো যাতে নিজেরা বসে সমস্যা সমাধান করে নেয়। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপ বা কোনো সমঝোতা হয়নি। অবশেষে কমিশন সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কথা উল্লেখ করে তফসিল ঘোষণা দিয়েছে।
গতকাল সন্ধ্যায় সিইসির তফসিল ঘোষণা দেয়ার পরপরই রাজধানীসহ পুরো দেশজুড়ে আনন্দ মিছিল করেছে আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন। অন্যদিকে, তফসিল ঘোষণার পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, নির্বাচন কমিশন আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে দেশকে গভীর সংকটের দিকে ফেলে দিয়েছে। তিনি বলেন, প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল এই স্বৈরাচার সরকারের প্রধান দলদাস। ৫ নভেম্বর রাতে এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন তিনি। রিজভী বলেন, সিলেকশন ভোটের তফসিল ঘোষণা করে জাতির সঙ্গে চরম তামাশা করেছে।
গতকাল বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন নির্বাচন কমিশনের (ইসি) উদ্দেশে বলেছেন, যেখানে নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা ঠিক হয়নি, সেখানে নির্বাচন কমিশন তফসিল ঘোষণার মাধ্যমে আমি মনে করি দেশের জনগণের বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছে, যেটি দেশের জন্য সুখকর নয়। তিনি আরও বলেন, সামনে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে, রাজনৈতিক অবস্থা যদি জটিল হয়, সমস্ত দায়-দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের ওপর পড়বে। মাহবুব উদ্দিন খোকন ইসির উদ্দেশে বলেন, যদি আপনারা না পারেন, সরকার যদি চাপ দেয়, আপনারা পদত্যাগ করুন। দেশকে বাঁচান, গণতন্ত্রকে বাঁচান। মানুষের ভোটাধিকার নিশ্চিত করুন। এটিই আমার দাবি, দলের পক্ষ থেকে, বলেন তিনি।
রাজনৈতিক সমঝোতা ছাড়া তফসিল ঘোষণা করলে উদ্ভূত যেকোনো পরিস্থিতির দায় কমিশনকেই নিতে হবে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা এ টি এম মাছুম। গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে তিনি এ কথা জানান। এ দিকে গতকাল সন্ধ্যায় দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার প্রতিবাদে ও তফসিল ঘোষণা বন্ধের দাবিতে আগারগাঁওয়ে নির্বাচন কমিশনের উদ্দেশে গণমিছিল শুরু করেছিল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। বেলা সাড়ে ৩টায় বায়তুল মোকাররম উত্তর গেট থেকে গণমিছিল শুরু করে দলটি। তবে রাজধানীর মালিবাগ শান্তিনগর মোড়ে পুলিশ প্রস্তুত ছিল আগে থেকেই। সেখানে ব্যারিকেড দিয়ে আটকে দেয়া হয় গণমিছিল। এ সময় ইসলামী আন্দোলনের নেতাকর্মীরা ব্যারিকেড ভাঙার চেষ্টা করেন। তবে সিনিয়র নেতারা পরে বিক্ষুব্ধ নেতাকর্মীদের নিবৃত করেন।
তফসিল ঘোষণার পর কেউ জনমনে আতঙ্ক ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে চাইলে নির্বাচন কমিশনের দিকনির্দেশনা অনুযায়ী আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কঠোর ব্যবস্থা নেবে বলে জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার (গোয়েন্দা) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ। গতকাল দুপুরে নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে এ কথা বলেন তিনি। আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের চূড়ান্ত ভোটার তালিকা অনুযায়ী এবার সারা দেশে মোট ভোটার ১১ কোটি ৯৬ লাখ ৯১ হাজার ৬৩৩ জন। ইসির দেয়া তথ্যানুযায়ী, মোট ভোটারের মধ্যে পুরুষ ভোটার ছয় কোটি সাত লাখ ৭১ হাজার ৫৭৯ জন এবং নারী ভোটার পাঁচ কোটি ৮৯ লাখ ১৯ হাজার ২০২ জন। আর হিজড়া ভোটার ৮৫২। গত ১৪ সেপ্টেম্বরের মধ্যে যারা ভোটার হিসেবে নিবন্ধিত হয়েছেন, তারাই আগামী নির্বাচনে ভোট দিতে পারবেন। চূড়ান্ত ভোটার তালিকায় ১৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত হালনাগাদ করা হয়।
প্রসঙ্গত, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর। নির্বাচনের পর সংসদের প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয় ২০১৯ সালের ৩০ জানুয়ারি। তাই সংবিধান অনুযায়ী বর্তমান সংসদের পাঁচ বছর মেয়াদ শেষ হবে ২০২৪ সালের ২৯ জানুয়ারি। পরবর্তী সংসদের জন্য ভোটগ্রহণ করতে হবে তার আগের ৯০ দিনের মধ্যে। অর্থাৎ গত ১ নভেম্বর দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় গণনা শুরু হয়েছে। আর ২৯ জানুয়ারির মধ্যে নির্বাচন সম্পন্ন করার সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে।