মো. মাসুম বিল্লাহ
নভেম্বর ২৭, ২০২৩, ১২:২১ এএম
মো. মাসুম বিল্লাহ
নভেম্বর ২৭, ২০২৩, ১২:২১ এএম
কঠোর অবস্থানে পুলিশ। আগামী নির্বাচনে স্থানীয় পর্যায়ে রাজনৈতিক দল ও প্রার্থী কাউকেই কিশোর গ্যাং ব্যবহার করতে দেয়া হবে না
—ড. খ. মহিদ উদ্দিন, অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার, ডিএমপি
রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার ও আয়ের উৎস এবং ক্ষমতার হাতিয়ার হিসেবে কিশোর গ্যাং ব্যবহার করা হয়। শুধু পুলিশি তৎপরতায় তা প্রতিরোধ সম্ভব নয়
—অধ্যাপক মুহাম্মদ উমর ফারুক, চেয়ারম্যান, অপরাধবিজ্ঞান ও পুলিশবিজ্ঞান বিভাগ, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
কিশোর গ্যাং মামলা প্রচুর আসে। মুক্তি পেয়ে পুনরায় অপরাধে জড়ায় ১৫ শতাংশ। বর্তমান সময়ে নারী-শিশু ও কিশোর অপরাধ আগের তুলনায় বেশি দেখা যায়
—মো. সহিদ হোসেন ঢালী, স্পেশাল পিপি, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৯, ঢাকা
আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছে। সমপ্রতি ঢাকা ও এর আশপাশের জেলাগুলোতে কিশোর গ্যাং কালচার ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। এই গ্যাং দমনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তৎপরতা চালিয়ে জড়িতদের আটক করলেও বেশি দিন বন্দি রাখা যায় না। কারণ, নারী ও শিশু আইন-২০১৩ এ বিচারিক প্রক্রিয়ায় কেউ কেউ দণ্ড পেলেও অধিকাংশই আইনের ফাঁকফোকরে বেরিয়ে যান। মুক্তি পেয়ে পুনরায় একই অপরাধে জড়িয়ে পড়ে শিশু-কিশোরদের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ। শুধু ঢাকায় ৯টি ট্রাইব্যুনালে গড়ে প্রতিদিন কমপক্ষে ৪৫টি মামলার শুনানি করতে হয়। মাঝে মধ্যে এর থেকে বেশিও থাকে। বর্তমানে নারী-শিশু ও কিশোর অপরাধ আগের তুলনায় অনেক বেশি দেখা যায়। যাদের বয়স ১৮ বছরেরে নিচে কেবল তাদেরই নারী ও শিশু কোর্টে বিচার হয়। শিশু আইনের ধারা-৪৯ এর ক্ষমতাবলে অপরাধীদের ধরন অনুযায়ী প্রবেশনের মাধ্যমে মুক্তি দিয়ে থাকেন আদালত। প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় এসব কিশোর নানারকম অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাদের অপরাধের ধরনও পাল্টেছে। এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজি, চুরি-ছিনতাই, ধর্ষণ, মাদক থেকে শুরু করে খুনোখুনিসহ নানা অপরাধে কিশোর-তরুণরা জড়িয়ে পড়ছে। অথচ এই বয়সে তাদের স্কুল-কলেজে পড়াশোনা, নতুন নতুন উদ্ভাবনী কোনো কাজে অংশগ্রহণ এবং মাঠে খেলাধুলা করে সুস্থ সংস্কৃতি চর্চায় ব্যস্ত থাকার কথা।
ঢাকা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৯ এর স্পেশাল পিপি মো. সহিদ হোসেন ঢালী আমার সংবাদকে বলেন, কিশোর গ্যাং অনেক আগে থেকেই চলে আসছে। শিশু আইন-২০১৩ এর ধারার মাধ্যমে বিচার, সাজা এবং মুক্তি দেয়া হয়। আমাদের কাছে কিশোর গ্যাংয়ের মার্ডার, ধর্ষণ, ডাকাতি, দস্যুতা, ছিনতাই ও মাদকসহ সব ধরনের মামলা আসে। তবে মুক্তি পেয়ে পুনরায় অপরাধে জড়িয়ে পড়ে (পিসিপিআর নিয়ে) কোর্টে আসে ১৫ শতাংশ শিশু-কিশোর। গড়ে প্রতিদিন তার কাছে কমপক্ষে পাঁচটি মামলা আসে বলেও জানান মো. সহিদ হোসেন ঢালী। তিনি আরও জানান, মাঝে মধ্যে দৈনিক ১৫ থেকে ২০টি মামলার শুনানি করতে হয়। ঢাকায় ৯টি ট্রাইব্যুনাল আছে, তাদের কাছেও মামলা আসে প্রতিদিনই। তাতে দৈনিক গড়ে পাঁচটি করে হলেও ৪৫টির কম নয়। বর্তমান সময়ে নারী-শিশু ও কিশোর অপরাধ আগের তুলনায় অনেক বেশি দেখা যায় বলেও জানান তিনি। মামলাগুলো প্রথমত থানা হয়ে কোর্টে আসে। তবে তাদের বয়স ১৮ বছরের নিচে হলে নারী ও শিশু কোর্টে বিচার হবে, (জন্মনিবন্ধন বা পিএসসি) সার্টিফিকেট দেখাতে হবে এবং মামলাগুলো শুনেন নারী-শিশু জেলা জজ, সন্দেহ হলে ডিএনএ টেস্টও করা হয়। যদি তাদের বয়স একদিনও বেশি হয় তাহলে রেগুলার আদালতে বিচার হয়।
কিশোর অপরাধ রোধে কোনো পরামর্শ আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, এদের বাবা-মার জিম্মায় জামিন দেয়া হয়। এ ক্ষেত্রে পরিবারের ভূমিকা বেশি রাখতে হবে, ছেলে-মেয়েরা কি করে কোথায় যায় নিয়মিত খোঁজ-খবর রাখতে হবে। নারী ও শিশু আইনে শিশুদের সংশোধনের সুযোগ আছে। সামাজিক প্রেক্ষাপট, রাষ্ট্র, সমাজসেবা অফিসার ও সংশোধানাগরের সমন্বয়ে গঠিত প্রক্রিয়ায় চলে। তিনি আরও জানান, সমাজসেবা অফিসার শিশু আইনের ধারা-৪৯ এর ক্ষমতাবলে অপরাধীদের ধরন অনুযায়ী প্রবেশনের মাধ্যমে মুক্তি দিয়ে থাকেন। অপরাধে সংশ্লিষ্ট শিশু-কিশোরদের অভিভাবকসহ সমাজসেবা কর্মকর্তাদের সমাজসেবা অফিসারের নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়। নির্দিষ্ট সময় পরে সম্পূর্ণ সাজার পরিমাণ বুঝে মুক্তি দেয়া হয়।
সমপ্রতি এমন অসংখ্য ঘটনা এখন প্রতিনিয়তই ঘটছে। গত ১২ অক্টোবর রাজধানীর দক্ষিণখানের কসাইবাড়ি এলাকায় পাওনা দুই হাজার টাকার জন্য সিফাত নামে এক কিশোরকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে জখম করে কিশোর গ্যাং। হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করে। এর আগে গত ৪ অক্টোবর রাজধানীর মোহাম্মদপুরে দুই কিশোর গ্যাং গ্রুপের অন্তর্দ্বন্দ্বের জেরে প্রতিপক্ষের হাত বিচ্ছিন্ন করে টিকটক করার মতো লোমহর্ষক ঘটনা ঘটে এবং গত ২৯ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকায় প্রায় দুই ঘণ্টাব্যাপী গণছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। এ সময় অন্তত ১৫ জন আহত হয়েছেন বলে জানা গেছে। এর আগে গত ২৪ আগস্ট ঢাকার দক্ষিণখান এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্বে রাফসান নামে ১৭ বছরের এক কিশোরকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে আরেক কিশোর।
এর আগে গত জুন মাসে ফেনীতে এক স্কুলছাত্রকে মারধর করে কিশোর গ্যাংয়ের তিন সদস্য গ্রেপ্তার হয়। তারা ওই স্কুলছাত্রকে মারধরের পর তার ভিডিও ধারণ করে আবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়েছিল। একই মাসে ফেনী থেকেই ছিনতাইয়ে জড়িত থাকার অভিযোগে কিশোর গ্যাংয়ের চার সদস্যকে আটক করা হয়। তারা কথিত ‘নুরু গ্যাং’-এর সদস্য। তাদের কাছ থেকে ছুরি ও চাকু উদ্ধার করা হয়। এর আগে গত ২১ মে রাজধানীর দারুসসালাম থানার লালকুঠি এলাকার বসুপাড়ায় স্কুলছাত্র সিয়াম খানকে (১৪) প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। তার আগে ১০ মে দনিয়া কলেজের সামনে ‘জুনিয়র-সিনিয়র’ দ্বন্দ্বে খুন হয় মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী তাজুন ইসলাম ওরফে মুশফিক। স্থানীয়রা জানান, আগামী নির্বাচনে কিশোর গ্যাং সক্রিয় হতে পারে বলে আশঙ্কা। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং প্রার্থীরা তাদের কাজে লাগাতে পারে। সেটা হলে পরিস্থিতি খারাপ হতে পারে। গাজীপুর সিটিসহ স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনে কিশোর গ্যাংয়ের কদর দেখা গেছে।
পুলিশ সূত্রে জানা যায়, প্রায় ১৫ বছর আগে ঢাকার উত্তরা এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা প্রথম নজরে আসে। এরপর তা আর কখনোই থামেনি। সেই কিশোর গ্যাং এখন ঢাকাসহ সারা দেশে এমনকি প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে। গত জুলাই মাসে পুলিশ সদর দপ্তরে পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তারা কিশোর গ্যাং পরিস্থিতি নিয়ে একটি বৈঠক করেন। তারা তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখেন যে, কিশোর গ্যাং কালচার সারা দেশে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। পুলিশের বিশ্লেষণে উঠে এসেছে ‘হত্যা থেকে শুরু করে এমন কোনো অপরাধ নেই যাতে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা জড়িত নয়।’ খোজ নিয়ে জানা যায়, ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) তালিকাভুক্ত কিশোর গ্যাং গ্রুপের সংখ্যা ৫২টি। এসব গ্যাং গ্রুপে সদস্য সংখ্যা প্রায় ৭০০। ঢাকায় মিরপুরে এখন কিশোর গ্যাং সবচেয়ে বেশি। পুলিশের হিসাবে পুলিশের মিরপুর বিভাগে ১৩টি কিশোর গ্যাংয়ের ১৭২ সদস্য সক্রিয়। কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা এলাকাভিত্তিক মাদকের কারবার, মাদকসেবন, মাদক সরবরাহ, ছিনতাই, ইভটিজিং, চুরি, ডাকাতি, চাঁদাবাজি এমনকি খুনের মতো অপরাধেও জড়িত বলে পুলিশের কাছে তথ্য আছে।
এ বিষয়ে অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার, ডিএমপি ড. খ. মহিদ উদ্দিন আমার সংবাদকে বলেন, ‘কিশোর গ্যাংগুলোর ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বরাবরের মতই কঠোর অবস্থানে আছে। আগামী নির্বাচনে স্থানীয় পর্যায়ে রাজনৈতিক দল ও প্রার্থী কাউকেই কিশোর গ্যাং ব্যবহার করতে দেয়া হবে না।’ পুলিশ সূত্রে জানা যায়, হতাশা আর হিরোইজম থেকে কিশোর গ্যাংগুলো তৈরি হয়। একেক এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের প্রেক্ষাপট একেক রকম। অভিজাত এলাকায় উচ্চবিত্ত পরিবারের কিশোররা হিরোইজম থেকে কিশোর গ্যাং-এ যুক্ত হয়। আবার বস্তি বা নিম্নবিত্ত এলাকায় এটা হয় হতাশা থেকে। তবে এখানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক ও ইউটিউব তাদের প্রলুব্ধ করে।
এ বিষয়ে মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের প্রধান অধ্যাপক মুহাম্মদ উমর ফারুক বলেন, রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করতে গিয়ে কিশোরদের ব্যবহার করা হয় সেখানে একটা গ্যাং কালচার ডেভলপ করে এবং অর্থনৈতিক আয়ের উৎস ও ক্ষমতার হাতিয়ার হিসেবে গ্যাংগুলোর ব্যবহার হয়। সামগ্রিকভাবে কিশোর গ্যাংগুলো শুধু পুলিশি তৎপরতায় প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। তাই দরকার সামাজিক উদ্যোগ। সমাজের রাজনৈতিক নেতৃত্বকে এগিয়ে আসতে হবে। তবে সমাজ ও রাষ্ট্রের মধ্যে যদি সুস্থ বিনোদন না থাকে, তাহলে কিশোর-কিশোরীদের বিপথগামী হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে বলেও মনে করেন অধ্যাপক মুহাম্মদ উমর ফারুক।