ডিসেম্বর ১, ২০২৩, ১২:২৬ এএম
- অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন
- সংলাপের মাধ্যমে প্রশ্নহীন নির্বাচন আয়োজনের পরামর্শ বিশ্লেষকদের
- পররাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে পিটার হাসের বৈঠক
- নিষেধাজ্ঞায় ভয় না পাওয়ার পরামর্শ সচিবের
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল অনুযায়ী গতকাল সংসদ সদস্য পদে মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার শেষ তারিখ ছিল। রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনা ছিল পুনঃতফসিল অথবা মনোনয়ন দাখিলের সময় বাড়ানো হতে পারে, কিন্তু গতকাল সন্ধ্যায় ইসির পক্ষ থেকে নিশ্চিত করা হয়েছে— পুনঃতফসিল হচ্ছে না। সেই হিসাবে দ্বাদশ নির্বাচনে ৩০ নভেম্বরের মধ্যে যারা মনোনয়ন ফরম জমা দিয়েছেন কেবল তারাই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন। এদিকে বিএনপি-জামায়াতে ইসলামীসহ রাজপথে থাকা উল্লেখযোগ্য দলগুলো ভোটে না আসায় এ নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ বলতে চাচ্ছেন না নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের একটি অংশ। এদিকে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) বলছে, এ নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক নয়। তাই শক্ত বিরোধীদল বিহীন এ নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি বাড়াতে সর্বাধিক গুরুত্ব পাচ্ছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। আওয়ামী লীগ সভাপতির ভাষণে বিষয়টি ইতোমধ্যে স্পষ্ট হয়েছে। সব প্রার্থীর নির্বিঘ্নে নির্বাচনি প্রচারণার পরিবেশ তৈরিতে বার্তা পেয়েছেন মাঠপর্যায়ের প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
বিশ্লেষকরা বলছেন, অনেকটা নিজেদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতার নির্বাচনে প্রার্থীরা বিরোধী দলের সমর্থক ও সাধারণ ভোটারদের কেন্দ্রে আনতে পারবে কি-না সেটিই এখন মূল আলোচনার বিষয়। কারণ ২০১৪ সালের নির্বাচনে নিজ দলের ভোটারদেরও কেন্দ্রে আনতে পারেনি আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা। ফলে ভোটার উপস্থিতি কম থাকায় ওই নির্বাচন নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা রয়েছে দেশে-বিদেশে। তাই এবার স্বতন্ত্র প্রার্থীরা সর্বাধিক গুরুত্ব পাবেন। আওয়ামী লীগ চাইছে শান্তিপূর্ণ ভোট আয়োজন করে সমালোচনার জবাব দিতে। কারণ স্বতন্ত্র প্রার্থিরা অধিকাংশই আওয়ামী লীগেরই প্রার্থী। তাই ২০১৪ সালের মতো দলীয় টিকিট পেলেই এমপি হওয়ার মতো পরিবেশ এবার নেই। চাপ প্রয়োগ করে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের বসিয়ে দেয়ার মাধ্যমে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ারও সুযোগ রাখা হয়নি। কারণ ২০১৪ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ১৫৪ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ায় ওই নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয়। তাই এবার দলীয় প্রধান ঘোষণা দিয়েছেন, কেউ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। সব মিলিয়ে নিজেদের মধ্যে হলেও মোটামুটি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ভোট অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে এবার।
এদিকে এবারের নির্বাচনে বিরোধী দলগুলোর অংশগ্রহণ নিয়ে চমকের ঘোষণা দিয়েছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জাতীয় পার্টির অংশগ্রহণ ছাড়া তেমন কোনো চমক লক্ষ করা যায়নি। বিএনপির হেভিওয়েট বহু নেতার দলছুট হয়ে নির্বাচনে আসার গুঞ্জন থাকলেও দলটি তাদের নেতাদের ধরে রাখতে পেরেছে। নানামুখী চাপ ও বিপদের মধ্যেও দলটিতে ঐক্য বজায় থাকায় গুরুত্বপূর্ণ কেউ নির্বাচনে অংশ নেয়নি। উল্টো আড়াই শতাধিক বহিষ্কৃত নেতা দলে ফেরার আবেদন করেছে। বৃহৎ রাজনৈতিক শক্তি জামায়াতে ইসলামীও নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না। দলটি একতরফা নির্বাচন বাতিলের জন্য বিএনপির সঙ্গে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। বিএনপির মিত্র দলগুলোর মধ্যে কল্যাণ পার্টি নির্বাচনে অংশ নেয়া ঘোষণা দেয়ার পর অন্য দলগুলোর বিষয়ে সন্দেও তৈরি হয়। শেষ পর্যন্ত বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা দলগুলোর পাশাপাশি মাঠের রাজনীতিতে মোটামুটি শক্তিশালী ও আওয়ামী লীগের মিত্র হিসেবে পরিচিত ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশও নির্বাচনে অংশ নেয়নি। ফলে আগামী ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনকে একতরফা হিসেবেই আখ্যা দিচ্ছেন বিশ্লেষকদের একাংশ। তারা মনে করেন, দেশে স্থিতিশীল পরিবেশ নিশ্চিত করতে এবং আন্তর্জাতিক চাপ থেকে মুক্তি পেতে সংলাপের মাধ্যমে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজন করতে হবে। অন্যথায় বিরোধী দলগুলোর আন্দোলন এবং বৈদেশিক চাপ ও নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়ে দেশ মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হবে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ড. বদিউল আলম মজুমদার মনে করেন, যোগ্য একাধিক প্রার্থী না থাকলে সেই নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন বলা যাবে না। আমার সংবাদের সঙ্গে আলাপকালে এই বিশ্লেষক আরও বলেন, প্রভাবশালী ও জনপ্রিয় রাজনৈতিক দলগুলোকে ভোটে আনার পরিবেশ তৈরি করার দায়িত্ব সরকারেরই ছিল, কিন্তু সেই পরিবেশ তৈরি হয়নি, ফলে প্রশ্নহীন নির্বাচন হচ্ছে না। তিনি মনে করেন, এখনো সংলাপের মাধ্যমে সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ ফিরিয়ে আনা সম্ভব। অন্যদিকে, এবারও নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হচ্ছে না বলে মনে করছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। দলীয় মনোনয়নের ক্ষেত্রেও প্রশ্ন রয়েছে বলে মনে করে সংস্থাটি। রাজনীতিবিদদের প্রাধান্য না দিয়ে অর্থ ও পেশিশক্তির মাধ্যমে দলীয় মনোনয়ন হাতিয়ে নেয়ার ফলে রাজনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে মত দিয়েছে টিআইবি। গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর ধানমন্ডিতে টিআইবির কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব মতামত তুলে ধরা হয়েছে। গণতন্ত্র, সুশাসন ও শুদ্ধাচার চর্চার রাজনৈতিক অঙ্গীকার : টিআইবির সুপারিশমালা’ তুলে ধরতে এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। টিআইবির গবেষক কাওসার আহমেদ সুপারিশমালা তুলে ধরেন। এতে ৯টি বিষয়ের ওপর ৭৬টি সুপারিশ করা হয়।
এ সময় সংস্থাটির নির্বাহী পরিচাল ইফতেখারুজ্জামা বলেন, ‘সত্যিকার অর্থে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন বলতে যা বোঝায়, তা এবারও হচ্ছে না; এটি উদ্বেগের। সে ক্ষেত্রে নির্বাচন হবে; ক্ষমতায় কারা থাকবে— সেটিও নির্ধারণ হবে। কিন্তু জনগণের ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠা পাবে না। জনগণের আস্থা নিশ্চিত করাও অসম্ভব হবে।’ তিনি বলেন, দলে মনোনয়নের ক্ষেত্রে দলের প্রতি আনুগত্যকে প্রাধান্য দিতে হবে। চট করে কেউ এলো, অর্থকড়ি, পেশিশক্তি আছে বা অন্য পরিচয়ের কারণে মনোনয়ন দিয়ে দেয়া হলো। এতে যারা সত্যিকারের মূল ধারার রাজনীতির ধারক-বাহক, তারা কিন্তু নিজেদের বিলুপ্তপ্রায় ভাবতে থাকে। দলগুলোকে এ অবস্থার পরিবর্তন করতে হবে।’ এদিকে আওয়ামী লীগের মিত্র দলগুলোর সঙ্গেও সমঝোতা হয়নি। তাই আসন ভাগাভাগিতে দলগুলো এখনো ঠিক করতে পারেনি তাদের অবস্থান কী হবে। চাহিদামাফিক আসন না পেয়ে ১৪ দলীয় জোটের দলগুলোও যদি নির্বাচন বর্জন করে মনোনয়ন প্রত্যাহার করে নেয় তখন স্বতন্ত্র প্রার্থীরাই থাকবে প্রধান শক্তি। নাটকীয় পরিস্থিতির সমাপ্তি দেখা যাবে মনোনয়ন প্রত্যাহারের শেষ দিন। তবে মনোনয়নপত্র দাখিল বিবেচনায় সবশেষ ঠিক কতটি দল ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে তা জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশন সচিব মো. জাহাঙ্গীর আলম গতকাল আমার সংবাদকে বলেন, সারা দেশ থেকে উপজেলা নির্বাহী অফিসাররা তথ্য পাঠালে নিশ্চিত হওয়া যাবে কতটি দল ভোটে অংশ নিয়েছে, গতকাল রাত ৮টায় এ রিপোর্ট লেখার সময় পর্যন্ত ইসিতে পূর্ণাঙ্গভাবে এ তথ্য আসেনি।
তবে গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে নির্বাচন ভবনের মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ইসি সচিব জানান, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পুনঃতফসিল হচ্ছে না। তিনি বলেন, ‘মনোনয়নপত্র জমার সময় আর বাড়ানো হচ্ছে না। বৃহস্পতিবার বিকেল ৪টায় সময় শেষ হয়েছে। নির্বাচন কমিশন মনে করে, এ সময়সীমা বাড়ানোর আর কোনো সুযোগ নেই।’
এদিকে নির্বাচন ইস্যুতে বিদেশি চাপ ও নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে অভয় দিয়েছেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ। গতকাল বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা দেয়ার মতো পরিস্থিতি বাংলাদেশে নেই। আমাদের ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আমরা যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে কোনো সুযোগ পাই না। ফলে নতুন মার্কিন শ্রমনীতি উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে দেশটির উদ্বেগের সঙ্গে বাংলাদেশের নির্বাচনের কোনো সম্পর্ক নেই। আমরাও চাই আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) স্ট্যান্ডার্ড বজায় রাখতে। আমাদের মোট রপ্তানির মাত্র ১৭ শতাংশ হয় যুক্তরাষ্ট্রে। আর ইউরোপে করে থাকি ৫৫ থেকে ৬০ শতাংশ। যথেষ্ট শুল্ক দিয়েই আমরা আমেরিকায় পোশাক পাঠাই। এর আগে গত ১৬ নভেম্বর প্রেসিডেন্সিয়াল মেমোরেন্ডাম ঘোষণা করেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি জে ব্লিংকেন। তিনি বলেন, যারা ইউনিয়ন নেতা, শ্রমিক অধিকার রক্ষাকারী এবং শ্রমিক সংগঠনকে আক্রমণ করে, তাদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা, বাণিজ্য-বিষয়ক জরিমানা ও ভিসানিষেধাজ্ঞার মতো পদক্ষেপ নেয়া হবে। ইতোমধ্যে শ্রমমান ও শ্রমিক অধিকার বিষয়ে মার্কিন নতুন নীতি নিয়ে উদ্বেগ জানিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছে ওয়াশিংটনের বাংলাদেশ দূতাবাস। ওই চিঠিতে বলা হয়, শ্রম পরিবেশ আর শ্রমিক অধিকার রক্ষার ইস্যু বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কিত। কাজেই অবহেলা না করে গুরুত্ব দিতে হবে এ বিষয়ে। যদিও নীতিটি সর্বজনীন। তবে শঙ্কা রয়েছে বাংলাদেশকে লক্ষ্য বানানোর।
অন্যদিকে নানা জল্পনা-কল্পনার মধ্যে ছুটি শেষ করে দেশে আসার পর গতকাল ফের পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেনের সঙ্গে বৈঠক করেছেন ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় ঘণ্টাব্যাপী বৈঠক ক?রেন তারা। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন ঢাকায় অবস্থানরত ওয়াশিংটনে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ ইমরান, উত্তর আমেরিকা অনুবিভাগের মহাপরিচালক খন্দকার মাসুদ উল আলম। বৈঠকের বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে এখনো কো?নো তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে ধারণা করা হচ্ছে, ঘণ্টাব্যাপী বৈঠকে বাংলাদেশের চলমান রাজনীতি, শ্রমনীতি, অর্থনীতিসহ দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় ইস্যু নিয়ে আলোচনা হওয়ার সম্ভাবনা থাকতে পারে। বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে পিটার হাসের সাম্প্রতিক তৎপরতার কারণে তার কর্মকাণ্ড বাংলাদেশের রাজনীতিতে বেশ গুরুত্ব পাচ্ছে। রাজনৈতিক সংলাপ সংক্রান্ত মার্কিন প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় সরকারের বিরুদ্ধে দেশটির পক্ষ থেকে শক্ত পদক্ষেপের গুঞ্জন রয়েছে রাজনৈতিক মহলে।
প্রসঙ্গত, গত ১৫ নভেম্বর নির্বাচন কমিশন ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী, আগামী ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। মনোনয়নপত্র জমার সময় গতকাল ৩০ নভেম্বর শেষ হয়েছে। মনোনয়নপত্র বাছাই হবে ১-৪ ডিসেম্বর ও প্রত্যাহারের শেষ সময় ১৭ ডিসেম্বর।