ডিসেম্বর ২০, ২০২৩, ১১:২১ পিএম
৭ জানুয়ারি ভোট বর্জন, সব ধরনের ট্যাক্স, খাজনা, ইউটিলিটি বিল ও অন্যান্য প্রদেয় স্থগিত, ব্যাংকে লেনদেন এড়িয়ে চলতে এবং রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের মামলায় হাজিরা দেয়া থেকে বিরত থাকার আহ্বান
- অসহযোগ আন্দোলনের পক্ষে ২১, ২২ ও ২৩ ডিসেম্বর গণসংযোগ ২৪ ডিসেম্বর অবরোধ
- সরকারকে অসহযোগিতা করতে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হলে পরবর্তী ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণের আশ্বাস
অধিকার প্রতিষ্ঠায় ডামি নির্বাচন বর্জন ও অসহযোগ কর্মসূচি ঘোষণা
—মঈন খান
নতুন উদ্যমে সাহসের সাথে বর্তমান সরকারকে না বলতে হবে
—কর্নেল (অব.) অলি
ডামি নির্বাচন বর্জন ও অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়েছে বিএনপি। গতকাল বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বরাত দিয়ে এ কর্মসূচি ঘোষণা করেন। রিজভী বলেন, অসহযোগ আন্দোলনে দেশবাসীকে সহযোগিতার আহ্বান জানাচ্ছি। তারেক রহমান যুগান্তকারী কর্মসূচি ঘোষণা দিয়েছেন। দেশের প্রত্যেকটি নাগরিক অসহযোগ কর্মসূচিকে সহযোগিতা করার বিকল্প নেই, এ কথাটি তারেক রহমান জাতির উদ্দেশ্যে বলেছেন। তাই ৭ জানুয়ারি ডামি ভোটের খেলা বর্জন করুন। ভোট গ্রহণে নিযুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা দায়িত্ব পালনে বিরত থাকুন। সরকারকে সব ধরনের ট্যাক্স, খাজনা, ইউটিলিটি বিল ও অন্যান্য প্রদেয় স্থগিত রাখুন। ব্যাংকগুলো সরকারের লুটপাটের অন্যতম মাধ্যম বিধায় ব্যাংকে লেনদেন যথাসম্ভব এড়িয়ে চলুন। রাজনৈতিক নেতাকর্মীসহ মিথ্যা ও গায়েবি মামলায় অভিযুক্তরা মামলায় হাজিরা দেয়া থেকে বিরত থাকুন। গতকাল সকালে কর্মসূচি ঘোষণার পর বিকেলে সরকারের পদত্যাগ ও নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার পুনঃপ্রতিষ্ঠার একদফা দাবিতে, নির্বাচন বর্জন ও অসহযোগ আন্দোলনের পক্ষে-২১ ডিসেম্বর (আজ), ২২ ডিসেম্বর (শুক্রবার) ও ২৩ ডিসেম্বর (শনিবার) গণসংযোগ। একই দাবিতে ২৪ ডিসেম্বর রোববার সকাল-সন্ধ্যা অবরোধ কর্মসূচির ঘোষণা দেয়া হয়।
এদিকে অসহযোগ আন্দোলনের ঘোষণায় বিএনপির নেতাকর্মীদের মধ্যে উচ্ছ্বাসের হাওয়া বইছে। ঢাকা মহানগর দক্ষিণের শীর্ষ নেতা বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক কমিটির সদস্য ইশরাক হোসেন বলেন, অসহযোগ আন্দোলনের ফাইনাল খেলার সূচনা হলো। আওয়ামী লীগের আদেশ শুনবেন না সরকারি কর্মচারীরা। ট্যাক্স দেব না, বিদ্যুৎ-পানি-গ্যাসের বিল দেব না, আজ্ঞাবহ আদালতে আর হাজিরা দেব না। ফেনী জেলা যুবদলের সমন্বয়ক নঈম উল্যাহ চৌধুরী বরাত বলেন, আমরা তারেক রহমানের নির্দেশ মেনে চলব। এখন থেকে আর হাজিরা দিতে আদালতে যাব না। বিএনপির প্রভাবশালী নেতা গিয়াস উদ্দিন মানুন বলেন, ইনশাআল্লাহ অচিরেই স্বৈরাচার সরকারের পতন হবে। যে আন্দোলনের ডাক এসেছে তা বাস্তবায়ন হবে। সিলেটের যুবদল নেতা মনির খান বলেন, সব নেতাকর্মী একত্রিত হয়ে কাজ করতে হবে যারা নেতা হবেন তাদের সাথে কর্মীদের ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক থাকতে হবে, একে অন্যের বিপদে পাশে থাকার বিশ্বাস নিয়ে সবাইকে একসাথে বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। আমার বিশ্বাস, বিএনপির কর্মীরা মাঠে নামার জন্য প্রস্তুত, তবে নেতাদের আশ্বস্ত করতে হবে কর্মীদের পাশে থাকার। ইনশাআল্লাহ বিজয় সুনিশ্চিত। ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় নেতা তানজিল হাসান বলেন, ২০১৪ সালে বিনা ভোটের নির্বাচন, ২০১৮ সালে রাতের ভোটের নির্বাচন, ২০২৪ সালের জন্য নিজেদের মধ্যে ক্ষমতা এবং আসন ভাগাভাগির নির্বাচন। স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তির দোহাই দিয়ে ক্ষমতাসীন এবং তাদের এক চোখা অন্ধ দোসররা নির্বাচনের নামে প্রহসনের রঙ্গমঞ্চ বাস্তবায়নে সচেষ্ট। এবার এটি আর বাস্তবায়ন হবে না। তারেক রহমানের নির্দেশ বাস্তবায়ন হবে।
কর্মসূচি ঘোষণার পর রিজভী বলেন, ‘বিএনপিসহ দেশের সব গণতন্ত্রের পক্ষের রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে প্রতিশ্রুতি দিতে চাই, এই সরকারকে অসহযোগিতা করতে গিয়ে প্রশাসন কিংবা দেশপ্রেমিক জনগণ যারা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন, পরবর্তী গণতান্ত্রিক সরকার অবশ্যই সব ক্ষতিগ্রস্তদের যথাযথ ক্ষতিপূরণ দেবে। মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে আপনাদের ত্যাগের প্রতি সুবিচার করবে। একইসঙ্গে আমি আরও বলতে চাই, গণতন্ত্র, মানবাধিকার এবং লুণ্ঠিত ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠার চলমান আন্দোলনে বিএনপিসহ গণতন্ত্রের পক্ষের যারাই হতাহত হয়েছেন— ভবিষ্যৎ গণতান্ত্রিক সরকার তাদের অবদানও দলীয় এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে মূল্যায়ন করবে।’ তিনি আরও বলেন, জনগণের প্রত্যাশিত নির্বাচনের পরিবর্তে ‘ডামি রাজনৈতিক’ দল দিয়ে ‘ডামি নির্বাচনে’র আয়োজন করেছে। চিহ্নিত ভোট ডাকাতরা এই ‘ডামি নির্বাচনে’ বানরের পিঠা ভাগের মতো নিজেদের মধ্যে পার্লামেন্টারি আসন ভাগাভাগি করেছে। এখন ‘বানর খেলা’র আসরের মতো লোক জমানোর জন্য রাষ্ট্রের প্রায় ২০০০ কোটি টাকা তসরুপ করে নিজ দলেরই একজনের বিরুদ্ধে আরেকজনকে ডামি প্রার্থী বানিয়ে নির্বাচনি আমেজ তৈরির অপচেষ্টা চলছে। সুতরাং, ডামি নির্বাচন প্রতিহত করে ১২ কোটি ভোটারের লুণ্ঠিত ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠার এখনই সময়।
অসহযোগে বিএনপির ৪ দিনের কর্মসূচি : নির্বাচন বর্জন করে অসহযোগ আন্দোলনের প্রথম যাত্রায় চার দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে বিএনপি। দলটির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা, এক দফার দাবিতে অসহযোগ আন্দোলনে আগামী ২১, ২২ ও ২৩ ডিসেম্বর গণসংযোগ কর্মসূচি পালিত হবে। আগামী ২৪ তারিখ অসহযোগ আন্দোলনের অংশ হিসেবে সারা দেশে অবরোধ কর্মসূচি পালন হবে। গতকাল বিকেলে অনলাইনে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কর্মসূচি ঘোষণা দেন। রিজভী বলেন, আগামী সাত তারিখ নৌকা ও ডামি প্রার্থীর মধ্যে সরকারের নির্দেশেই প্রশাসনের পক্ষ থেকে শুধু নাম ঘোষণা করা হবে। এখন সেই নামের তালিকাটা করা হচ্ছে। বাংলাদেশে দুঃশাসনের নমুনা দেখা যাচ্ছে। জনগণ সেটি প্রতিরোধ করবে।
অধিকার প্রতিষ্ঠায় ডামি নির্বাচন বর্জন ও অসহযোগ কর্মসূচি ঘোষণা হয়েছে —ড. মঈন খান : বিএনপির নির্বাচন বর্জন ও অসহযোগ আন্দোলনের ঘোষণা পরবর্তী সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় ড. মঈন খান বলেছেন, বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার চলমান আন্দোলনে বিএনপির আজকের ঘোষণা নতুন করে এই সত্য প্রতিষ্ঠা করেছে যে, বিএনপি একটি উদারপন্থি রাজনৈতিক দল; যারা ভিন্ন মতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে এবং সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ প্রক্রিয়ায় আস্থাশীল হয়ে তাদের প্রতিবাদ ও আন্দোলন পরিচালনা করে থাকে। তিনি বলেন, এই একদলীয় সরকারের দীর্ঘ ১৫ বছরের অপশাসন, মামলা-হামলা, জুলুম-নির্যাতন, দুর্নীতি-লুটপাট, আর্থিক অব্যবস্থাপনা ও বিদেশে টাকা পাচারের মাধ্যমে দেশকে নৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে দেউলিয়া করে ধ্বংসের পথে ঠেলে দেয়ার শেষ পর্যায়ে এসে দীর্ঘ এক বছরেরও বেশি সময় ধরে দেশের জনগণকে সম্পৃক্ত করে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় সবার অধিকার প্রতিষ্ঠায় বিএনপি সরকারের ডামি নির্বাচন বর্জন ও অসহযোগ কর্মসূচি (সিভিল ডিজওবিডিয়েপ্স) ঘোষণা করেছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির এই সদস্য বলেন, আমরা স্পষ্ট ভাষায় বলে দিতে চাই যে, লক্ষ লক্ষ মানুষের রক্তের বিনিময়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত এই স্বাধীন বাংলাদেশকে এই বাকশালী সরকার দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে এক গভীর অমানিশার অন্ধকারে নিমজ্জিত করে দিয়েছে। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের একমাত্র উপায় হচ্ছে দেশকে গণতন্ত্রের পথে ফিরিয়ে আনা এবং সেই উদ্দেশ্যেই আজ বিএনপি অসহযোগের মন্ত্রে সরকারকে দীক্ষিত করে দেশের আঠার কোটি মানুষের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার প্রয়াসে সরকারকে সংঘাতের পথ থেকে বেরিয়ে এসে একটি শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পথ উন্মুক্ত করতে দেশবাসীর প্রতি এই আবেদনের সহায়ক ভূমিকা পালন করবে বলে বিশ্বাস করে।
তিনি বলেন, আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মাধ্যমেই কেবল এদেশে গণতন্ত্র ফিরে আসতে পারে যা অর্জন করার উদ্দেশ্যে বিএনপির প্রতিটি নেতাকর্মী আজ রাজপথে নেমেছে। বিএনপির জন্য নয়, কোনো ব্যক্তির জন্য নয়, বরঞ্চ এদেশের সব মানুষের মৌলিক ভোটের অধিকার তথা সুবিধাবঞ্চিত মানুষের অর্থনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার এই সংগ্রাম অর্জন না হওয়া পর্যন্ত আমাদের রাজপথের আন্দোলন চলতেই থাকবে।
নতুন উদ্যমে সাহসের সাথে বর্তমান সরকারকে না বলতে হবে —কর্নেল অলি : লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) প্রেসিডেন্ট ও সাবেক মন্ত্রী ড. কর্নেল (অব.) অলি আহমদ বীর বিক্রম বলেছেন, বর্তমান দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে সমাজে যে সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে, এটা শুধু এককভাবে রাজনৈতিক দলগুলোর সমস্যা নয়, সমগ্র দেশ ও সমগ্র জাতির সমস্যা। সুতরাং সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে এই সমস্যার মোকাবিলা করতে হবে। অন্যথায় এই ধরনের অন্যায়-অবিচার সমাজকে গৃহযুদ্ধের দিকে বা রক্তপাতের দিকে ঠেলে দিবে। আওয়ামী বাকশালীরা চায় তাদের অবৈধ কর্মকাণ্ড জায়েজ করার জন্য যেনতেনভাবে পুনরায় ক্ষমতা দখল নিতে। আমরা চাই জনগণের ভোট প্রদান নিশ্চিত করতে, সমাজে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করতে।
গতকাল বিকালে এলডিপি কার্যালয়ে জরুরি সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন। ড. কর্নেল অলি আহমদ বীর বিক্রম বলেন, দুর্নীতি, অন্যায় ও অবিচারের হাত থেকে জনগণকে রক্ষা করতে বর্তমান পদ্ধতিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে, জনগণ ভোটের অধিকার হারিয়ে ফেলবে। এতে দেশ ও জনগণ উপকৃত হবে না। বরং এই হটকারি ভাগাভাগির নির্বাচনের কারণে দেশ ও জনগণ এক গভীর সংকটে পড়বে। ক্ষমতা লোভীদের আশা আকাঙ্ক্ষা পূরণ হবে। এই নির্বাচন কখনো গণতন্ত্র নিশ্চিত করবে না।
তিনি বলেন, সুতরাং আসুন ঐক্যবদ্ধ হই, সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে নিজ নিজ দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করি। কোনো অবস্থাতেই অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয়া যাবে না। আল্লাহ প্রদত্ত এই সুযোগ কাজে লাগাতে হবে। চিরতরের জন্য দুর্নীতিবাজ, অর্থপাচারকারী, নির্যাতন ও নিপিড়নকারীদের বর্জন করতে হবে। হতাশ হলে চলবে না, নতুন উদ্যমে সাহসের সাথে বর্তমান সরকারকে না বলতে হবে। সমাজে সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার কাজে যুবসমাজকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। ইনশাআল্লাহ সত্যের জয় প্রতিষ্ঠা হবে। এই ভাগাভাগির একদলীয় নির্বাচন বর্জন করুন। দেশ বাঁচান। কর্মসূচি : ২১, ২২ ও ২৩ লিফলেট বিতরণ। ২৪ তারিখ অবরোধ।