Amar Sangbad
ঢাকা সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০২৪,

আচরণবিধি লঙ্ঘন

শোকজেই দায়মুক্ত ইসি

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক

ডিসেম্বর ২৫, ২০২৩, ১২:২৯ এএম


শোকজেই দায়মুক্ত ইসি
  • প্রবীণ রাজনীতিক ও তারকা প্রার্থীরাও বিধি লঙ্ঘন করছেন
  • দৃশ্যমান ব্যবস্থা নেয়ার ঘোষণার বাস্তবায়ন নেই

প্রার্থীরা আচরণবিধি মানছেন না। প্রতিপক্ষকে হুমকি দেয়া হচ্ছে। ভয়ভীতি প্রদর্শন করা হচ্ছে। হামলা চালিয়ে হতাহত করা হচ্ছে। ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী ও তাদের সমর্থকদের বিরুদ্ধেই আচরণবিধি লঙ্ঘনের এমন বিস্তর অভিযোগ। হুমকির শিকার হয়ে প্রতিকারের আবেদন জানানোর পরও নির্বাচন কমিশন ‘শোকজ’-এ সীমাবদ্ধ থেকেছে। এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা নেয়ার নজির নেই বলে দাবি অভিযোগকারীদের। ব্যতিক্রম একটি হচ্ছে, সম্প্রতি আচরণবিধি লঙ্ঘন করায় ঝিনাইদহ-১ আসনের নৌকার প্রার্থী আব্দুল হাইয়ের বিরুদ্ধে আদালতে নিয়মিত অভিযোগ দায়েরের সিদ্ধান্ত নিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। তবে গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত ইসির পক্ষ থেকে আদালতে অভিযোগ দায়ের হওয়ার তথ্য পাওয়া যায়নি।

স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে কাজ করায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর উপজেলার কুণ্ডা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান নাসির উদ্দিনের নাম নাসিরনগর থেকে মুছে ফেলার হুমকি দেন সেখানকার সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী মো. ফরহাদ হোসেন সংগ্রাম। গত শুক্রবার বিকালে নাসিরনগরের কুণ্ডা উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে অনুষ্ঠিত এক নির্বাচনি জনসভায় এমন হুমকি দেয়া হয়। এ ঘটনায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া-১ আওয়ামী লীগ প্রার্থী এমপি বিএম ফরহাদ হোসেনকে শোকজ করেছে নির্বাচনি অনুসন্ধান কমিটি। তাকে আজ সোমবার বিকাল ৫টায় জেলা ও দায়রা জজ আদালতে হাজির হয়ে লিখিত ব্যাখ্যা দিতে হবে। গতকাল রোববার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সিনিয়র সহকারী জজ ও নির্বাচন অনুসন্ধান কমিটির প্রধান মোহাম্মদ রেজাউল হক এ চিঠি দিয়েছেন। চিঠি ফরহাদ হোসেনের কাছে পৌঁছানো হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র নিশ্চিত করেছে। শোকজ নোটিসে বলা হয়, ২৩ ডিসেম্বর একটি জাতীয় দৈনিকের অনলাইন সংস্করণে প্রকাশিত হয় ‘চেয়ারম্যানের নাম মুছে দিতে চান এমপি’। এমপির বক্তব্য সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর আচরণবিধির লঙ্ঘন মর্মে কমিটির কাছে প্রতীয়মান হয়। চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, এমন অবস্থায় আপনার (ফরহাদ) বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য কেন নির্বাচন কমিশনকে সুপারিশ করা হবে না মর্মে আজ বিকাল ৫টায় জেলা ও দায়রা জজ আদালতে সশরীরে হাজির হয়ে লিখিত ব্যাখ্যা প্রদানের জন্য নির্দেশ প্রদান করা হলো। কুণ্ডা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নাসির উদ্দিন বলেন, আমার নাম নাসিরনগর থেকে মুছে ফেলা হবে বলে প্রকাশ্যে জনসভা থেকে ঘোষণা দিয়েছেন এমপি। এ বক্তব্যের পর নিজের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।

ঢাকা-৫ আসনে ঈগল প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী ঢাকা মহানগর দক্ষিণ স্বেচ্ছাসেবক লীগ সভাপতি কামরুল হাসান রিপনের সমর্থক সুজনের মাথা ফেলে হত্যার হুমকি দিয়েছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটির ৬৯নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর সালাউদ্দিন আহম্মেদ। এ বিষয়ে সুজন ডেমরা থানায় লিখিত অভিযোগ করেও কোনো প্রতিকার পাননি। তফসিল অনুযায়ী প্রতীক বরাদ্দ দেয়া হয় ১৮ ডিসেম্বর। প্রতীক বরাদ্দের দিনই উসকানিমূলক বক্তব্য দেয়ায় কুমিল্লা-৬ আসনের সংসদ সদস্য ও দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রার্থী আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারকে শোকজ দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট তদন্ত কমিটি। গত ১৯ ডিসেম্বর আসনটির তদন্ত কমিটি ও যুগ্ম জেলা জজ মোহাম্মদ সিরাজ উদ্দিন ইকবাল তাকে শোকজ দেন। বাহারকে দেয়া শোকজে উল্লেখ করা হয়, আপনি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কুমিল্লা-৬ আসনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মনোনীত নৌকা প্রতীকের প্রার্থী হিসেবে ১৮ ডিসেস্বর কুমিল্লা মহানগরের ০৩ নং ওয়ার্ডের কালিয়াজুরি পিটিআই স্কুল মাঠে উঠান বৈঠক করেছেন। ওই বৈঠকে আপনি ‘যদি বিএনপি এবং জামায়াতের কোনো কর্মীকে কোনো প্রার্থীর পক্ষে পাওয়া যায় তার হাত, ঠ্যাং ভেঙে দেবেন। আমি আ ক ম বাহাউদ্দিন আপনাদের সঙ্গে আছি’ মর্মে উসকানিমূলক বক্তব্য প্রদান করেছেন। আপনার ওই বক্তব্যের কারণে নির্বাচনের সুষ্ঠু, অবাধ ও ভীতিমুক্ত পরিবেশ বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে এবং এতে আপনি রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর আচরণ বিধিমালা, ২০০৮ এর বিধি ১১ (ক) লঙ্ঘন করেছেন মর্মে দৃষ্ট হয়। এই অবস্থায় ওই বিষয়ে আপনার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য কেন নির্বাচন কমিশনে সুপারিশসহ প্রতিবেদন প্রেরণ করা হবে না, ২৪ ডিসেম্বর বেলা ১১টায় নির্বাচনি অনুসন্ধান কমিটির কার্যালয়ে স্বয়ং অথবা উপযুক্ত প্রতিনিধির মাধ্যমে হাজির হয়ে কারণ দর্শাবেন। হুমকির প্রেক্ষিতে নোটিস দেয়া হলেও ওই এমপির বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।

নির্বাচনি আইন ও বিধান লঙ্ঘনে পিছিয়ে নেই ভিআইপি প্রার্থীরাও। আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফরউল্লাহ, কেন্দ্রীয় ১৪ দলের সমন্বয়ক আমির হোসেন আমু, তারকা প্রার্থী মাগুরা-১ আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানও নির্বাচনি আচরণবিধি ভঙ্গ করেছেন। এদের নোটিস করা হলেও আইনগত কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এছাড়া নির্বাচনি আচরণবিধি লঙ্ঘনের দায়ে ঢাকা-৭ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ও সংসদ সদস্য হাজী মো. সেলিমের ছেলে মোহাম্মদ সোলায়মান সেলিমকে শোকজ করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। আচরণবিধি লঙ্ঘন করে সরকারি গাড়ি নিয়ে পুলিশি নিরাপত্তায় নির্বাচনি এলাকায় গিয়েছেন এবং সেখানে জনসভায় যোগ দিয়েছেন জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন। এর মাধ্যমে নির্বাচনি আচরণবিধি লঙ্ঘন করেছেন তিনি। এ কারণে তাকে শোকজ করেছে নির্বাচন কমিশনের অনুসন্ধান কমিটি। আচরণবিধি লঙ্ঘনের ঘটনায় শোকজ করা হয়েছে নারায়ণগঞ্জ-১ (রূপগঞ্জ) আসনের সংসদ সদস্য এবং বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী, ঢাকা-১৯ আসনে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান, গাজীপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল এবং নাটোর-৩ আসনে তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলককেও। আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্যদের মধ্যে আরও রয়েছেন লক্ষ্মীপুর-২ সরকারদলীয় সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগের প্রার্থী নুর উদ্দিন চৌধুরী নয়ন, লক্ষ্মীপুর-৩ মিয়া মো. গোলাম ফারুক পিংকু, নরসিংদী-৫ সাবেক ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী রাজি উদ্দিন আহমেদ, পটুয়াখালী-৪ মহিববুর রহমান, গাজীপুর-৫ মেহের আফরোজ (চুমকি), চট্টগ্রাম-১৬ মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী, লক্ষ্মীপুর-১ ড. আনোয়ার হোসেন খান, মুন্সিগঞ্জ-৩ মৃণাল কান্তি দাস, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী, ময়মনসিংহ-১১ কাজিম উদ্দিন আহম্মেদ ধনু এবং নাটোর-২ আসনে মো. শফিকুল ইসলাম শিমুল।

আচরণবিধি লঙ্ঘন করায় ঝিনাইদহ-১ আসনের নৌকার প্রার্থী আব্দুল হাইয়ের বিরুদ্ধে আদালতে নিয়মিত অভিযোগ দায়েরের সিদ্ধান্ত নিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। গত শুক্রবার ইসির নির্বাচন পরিচালনা-২ অধিশাখার উপসচিব মো. আতিয়ার রহমানের সই করা এক চিঠিতে এ সিদ্ধান্তের কথা সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাচন অফিসারকে জানানো হয়। চিঠিতে বলা হয়, শৈলকূপা থানাধীন ১৪নং দুধসর ইউনিয়নের ভাটই বাজারে সাপ্তাহিক হাটবারের দিনে বিকেল ৪টার দিকে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী আব্দুল হাইয়ের অনুসারীরা দেশীয় অস্ত্র ও লাঠিসোঁটা নিয়ে মহাসড়কে মহড়া দেয় ও জনগণের মনে ভীতি সঞ্চার করায় নির্বাচনি অনুসন্ধান কমিটির প্রতিবেদনের আলোকে মো. আব্দুল হাই ‘সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর আচরণ বিধিমালা, ২০০৮’ এর বিধি ৮(ক), ১১(ক) ও বিধি ১২ এর লঙ্ঘন করেছেন। এ বিধি লঙ্ঘন করায় অভিযুক্ত প্রার্থী ও অনুসারীদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্বাচন কমিশন সিদ্ধান্ত প্রদান করেছেন। চিঠিতে আরও উল্লেখ করা হয়, উপর্যুক্ত বিষয়ে সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে নিয়মিত অভিযোগ দায়ের করার জন্য আদিষ্ট হয়ে অনুরোধ করা হলো।

ইসির অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ গত শনিবার নির্বাচন ভবনে এক বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আচরণবিধি লঙ্ঘন করলে এখন আর শুধু শোকজ নয়, দৃশ্যমান ব্যবস্থা নেবে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। প্রয়োজনে বাতিল করা হতে পারে প্রার্থিতাও। ইসি শুধু শোকজ করছে, কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না— এমন প্রশ্নের জবাবে অশোক কুমার বলেন, এখন শোকজ করাই কেবল নয়, তাদের (ডিসি, এসপি) প্রতিবেদনের ভিত্তিতে আমরা ব্যবস্থা নেব। কোনো একটি দৃশ্যমান আপডেট আপনারা পাবেন। তিনি বলেন, যেখানে যারা হামলা করেছে তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। নির্বাচনি তদন্ত কমিটি আচরণবিধি না মানলে সংশ্লিষ্টদের শোকজ করছে। তবুও সেকেন্ড টাইম করলে এখন ব্যবস্থা নেয়া হবে। এই নির্বাচনি কর্মকর্তার এমন বক্তব্যের পরও আচরণবিধি লঙ্ঘনে কোনো ব্যবস্থা নেয়ার খবর পাওয়া যায়নি।  

প্রসঙ্গত, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩০০টি নির্বাচনি অনুসন্ধান কমিটি গঠন করে ইসি। আচরণবিধি লঙ্ঘনের দায়ে ওই কমিটি ইসিকে প্রতিবেদন দেবে। এর ভিতিত্তে সংশ্লিষ্টদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে নির্বাচন কমিশন।

Link copied!