Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৪,

ত্রিদেশীয় চক্রের ভিডিও ফাঁদ

মো. মাসুম বিল্লাহ

মো. মাসুম বিল্লাহ

ডিসেম্বর ২৬, ২০২৩, ১২:১৫ এএম


ত্রিদেশীয় চক্রের ভিডিও ফাঁদ
  • বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানচক্র সম্পৃক্ত 
  • প্রতারকচক্রের মূল উদ্যোক্তারা ভারতীয়
  • প্রতারণার অর্থের ৫০ শতাংশ নেয় ভারতীয় চক্র 
  • ২৫ শতাংশ করে পায় বাংলাদেশি ও পাকিস্তানিরা

আপত্তিকর মুহূর্তের ভিডিও রেকর্ড করে বহু পুরুষকে ফাঁদে ফেলছে
—নিশাত রহমান মিথুন, এডিসি (এডমিন), সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম (দক্ষিণ) বিভাগ, ডিবি

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পরিচয়। ভিডিওকলে অন্তরঙ্গ মুহূর্তে স্ক্রিন রেকর্ডের ফাঁদ। উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়াদের টার্গেট করে তাদের সাথে ভিডিও কলে কথা বলে আসছে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ও পাকিস্তানের প্রতারকসহ দেশীয় একটি ভয়ঙ্কর চক্র। অজান্তেই অন্তরঙ্গ মুহূর্তের অশ্লীল, আপত্তিকর ছবি ও ভিডিও ধারণ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়ার হুমকি দিয়ে ব্ল্যাকমেইল করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে চক্রটি।

গত ২৯ আগস্ট দিপিকা আগোয়াল নামক ফেসবুক আইডি থেকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট এলে ভুক্তভোগী হাসান (ছদ্মনাম) একসেপ্ট করেন। উভয়ের মধ্যে প্রথমে কথোপকথন হয়, পরে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের একপর্যায়ে নিয়মিত ভিডিওকলে কথা বলতে থাকেন তারা। ওই আইডি যে একটি প্রতারক চক্রের তা শুরুতে আন্দাজ করতে পারেননি হাসান। ভিডিও চেটিংয়ের একপর্যায়ে প্রতারক (দিপিকা আগোয়াল) কৌশলে ম্যাসেঞ্জারে ও হোয়াটসঅ্যাপে ভিডিওকলে কথা বলার সময় ভুক্তভোগীর অজান্তেই ঘনিষ্ঠ মুহূর্তের বেশ কিছু অশ্লীল, আপত্তিকর, নগ্ন, অর্ধনগ্ন ছবি ও ভিডিও গোপনে ধারণ করে রাখে। গত ১ সেপ্টেম্বর দিপিকা আগোয়ালের ব্যবহূত হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর থেকে ভুক্তভোগী হাসানের হোয়াটসঅ্যাপে ঘনিষ্ঠ মুহূর্তের বেশ কিছু অশ্লীল, আপত্তিকর, নগ্ন, অর্ধনগ্ন ছবি ও ভিডিও পাঠায়। পরবর্তীতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়ে ভাইরাল করবে বলে হুমকি দেয়। বারবার অনুরোধ করে নগ্ন ছবি ও ভিডিও ডিলিট করতে অনুরোধ করলে তার কাছ থেকে এক লাখ টাকা দাবি করে ওই প্রতারক চক্র।

ডিবি পুলিশের দেয়া তথ্য বলছে, ঢাকার কড়াইল, বনানী এলাকায় বসবাসরত মো. টিপু সুলতান ও মো. মোসলেম রানা নামে দুই ব্যক্তি এমন প্রতারণার সাথে সম্পৃক্ত। এরা পুরুষদের টার্গেট করে ফেসবুকে মেয়ে নামধারী ফেক আইডি থেকে রিকোয়েস্ট পাঠায়। টার্গেটকৃত ব্যক্তি রিকোয়েস্ট একসেপ্ট করলে প্রতারক চক্রের সদস্যরা ভিডিওকলে কথা বলাতে ইন্ডিয়ার বিভিন্ন মেয়েকে ভাড়া করে। ভুক্তভোগীর অজান্তে অশ্লীল ছবি ও ভিডিও ধারণ করে রাখে তারা। ব্ল্যাকমেইল করে টার্গেটকৃত ব্যক্তিদেও কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নেয় চক্রটি। চক্রটি গড়ে ওঠে বাংলাদেশি ভারতীয় ও পাকিস্তানি নাগরিকদের যৌথ উদ্যোগে। ত্রিদেশীয় এই চক্রটির মূল টার্গেট এরিয়া হচ্ছে বাংলাদেশ, মনে করছে পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ। প্রতারক চক্রের মূল হোতা শাকিল। ভারতীয় এ নাগরিকের লোন অ্যাপস থেকে লোন গ্রহীতাদের লোন পরিশোধের জন্য এবং একই সাথে ফেসবুকে বন্ধুত্ব করে অশ্লীল ছবি ও ভিডিও ধারণ করে ভিকটিমদের কাছ থেকে অর্থ আদায়ের জন্য ইউনিফাইড পেমেন্ট ইন্টারফেস (ইউপিআই) বাংলাদেশি এজেন্ট টিপু সুলতানকে পাঠায়। সে পাঠায় পাকিস্তানি এজন্টে পারভেজ নামে এক প্রতারককে। পারভেজ ভিকটিমদেরকে কল দিয়ে ব্ল্যাকমেইল করে টাকা আদায় করে ইউপিআইয়ের মাধ্যমে। এই অর্থ মূলহোতা ভারতের শাকিল নেয় ৫০ শতাংশ। বাকি বাংলাদেশি এজেন্ট পায় ২৫ ও পাকিস্তানি এজেন্ট ২৫ শতাংশ। 

সম্প্রতি ঢাকার বনানী কড়াইল এলাকা থেকে মো. টিপু সুলতান (২৭) ও মো. মোসলেম রানা (২৮) নামে দেশীয় এই দুই প্রতারককে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম (দক্ষিণ) বিভাগ। তাদের কাছ থেকে জব্দকরা হয় দুটি মোবাইল ফোন।

বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত কতটি ঘটনা সংঘটিত হয়েছে তার পূর্ণাঙ্গ তথ্য ও এ সংক্রান্ত কোনো তথ্য বা গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ পায়নি। তবে, বাংলাদেশের সাইবার অপরাধের প্রবণতা নিয়ে চলতি বছর একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশন। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে নতুন ধরনের সাইবার অপরাধের মাত্রা বেড়েছে ২৮১ দশমিক ৭৬ শতাংশ। দেশে যারা সাইবার ক্রাইমের শিকার হয়েছেন তাদের ১৫.৪৭ শতাংশকে অনলাইনে বার্তা পাঠিয়ে ব্ল্যাকমেইলসহ নানা ধরনের হুমকি দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি ৯.১২ শতাংশ ভুক্তভোগীকে পর্নোগ্রাফির মাধ্যমে হয়রানি করা হয়েছে। গবেষণায় আরও বলা হয়েছে, সাইবার অপরাধের শিকার ভুক্তভোগীদের পুলিশের সহায়তা চাইতে চরম অনীহা। ২০১৮ সালের জরিপে যেখানে অভিযোগকারীর হার ছিল ৬১ শতাংশ, ২০২৩ সালে এসে তা কমে দাঁড়িয়েছে ২০ দশমিক ৮৩ শতাংশে। পুলিশের কাছে না যাওয়ার কারণ হিসেবে ‘সামাজিক ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হওয়ার আশঙ্কা’র কথা বলেছেন অনেকে।

এ বিষয়ে ডিবি-সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম (দক্ষিণ) ডিসি তারেক আহমেদ জানান, সবার প্রতি অনুরোধ, অপরিচিত আইডি থেকে কোনো মেসেজ এলে তার সাথে বন্ধুত্ব করবেন না। বন্ধুত্ব করলেও সে ক্ষেত্রে সাবধানে কথা বলতে হবে। কারও প্রতি বিশ্বাস করে গোপন চ্যাট বা ভিডিওকলে কথা বলা যুক্তিযুক্ত নয়। কেউ যদি এ ধরনের ঘটনায় ভুক্তভোগী হয়ে থাকেন অবশ্যই তাকে সাইবার পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে।

স্ক্রিন রেকর্ডের মাধ্যমে ফাঁদে ফেলে প্রতারণার বিষয়ে ডিবির সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম (দক্ষিণ) বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) নিশাত রহমান মিথুন আমার সংবাদকে বলেন, সাইবার প্রতারকরা প্রেমের ফাঁদে ফেলে ভিডিওকলে আপত্তিকর মুহূর্তের ভিডিও রেকর্ড করে বহু পুরুষকে ফাঁদে ফেলছে। এদের মধ্যে ভুক্তভোগী রয়েছে সরকারি কর্মকর্তা থেকে শুরু করে হাজী সাহেবও। তিনি আরও বলেন, যার তার ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট একসেপ্ট না করা, অনলাইনে কাউকে নিজের ছবি বা ভিডিও না পাঠানো এবং আপত্তিকর অবস্থায় ভিডিও কলে কথা বলা থেকে বিরত থাকতে হবে। এরপরও যদি কেউ ব্লাকমেইলের স্বীকার হন, তাহলে পুলিশের সাইবার বিভাগে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন ডিবির এ কর্মকর্তা।
 

Link copied!