বেলাল হোসেন ও নাঈমুল হক
জানুয়ারি ১, ২০২৪, ১১:৪০ পিএম
বেলাল হোসেন ও নাঈমুল হক
জানুয়ারি ১, ২০২৪, ১১:৪০ পিএম
নতুন বছরে নতুন বই। শীতের কুয়াশামাখা রোদে শিক্ষার্থীরা ছুটে গেছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। নতুন বই হাতে পেয়ে জেগেছে নতুন প্রাণ। প্রতি বছরের মতো এবারো বর্ণিল আয়োজনে সারা দেশে বই বিতরণ উৎসব-২০২৪ অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক স্তরের শিশুশিক্ষার্থীরা দেশব্যাপী আনন্দঘন পরিবেশে নতুন বছরের পাঠ্যপুস্তক পেয়ে উল্লাসে মাতোয়ারা হয়ে ওঠে। তবে এবার মাধ্যমিকে কেন্দ্রীয়ভাবে বই উৎসব হয়নি। নিজ নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উৎসবমুখর পরিবেশে বই বিতরণ করা হয়। কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে গতকাল সোমবার রাজধানীর মিরপুরের ন্যাশনাল (সকাল-বিকাল) সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে প্রাথমিকের বই বিতরণ উৎসবের উদ্বোধন করা হয়।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন। বিশেষ অতিথি ছিলেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব ফরিদ আহাম্মদ। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শাহ রেজওয়ান হায়াত। প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী বলেন, নতুন বই শিশুদের জন্য প্রধানমন্ত্রীর নতুন বছরের উপহার। নতুন বই শিশুকে উজ্জীবিত ও অনুপ্রাণিত করে। নতুন বইয়ের ঘ্রাণ শিশুকে বইয়ের প্রতি আকৃষ্ট করে তোলে। বইয়ের প্রতিটি পৃষ্ঠা শিশুর মনোজগতে বিস্ময় তৈরি করে। শিশুমনের এ আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ আগ্রহে বই বিতরণের সূচনা। সময়ের পরিক্রমায় এটি এখন বই উৎসবে পরিণত হয়েছে।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে সচিব ফরিদ আহাম্মদ বলেন, চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকার পুরোনো ধারার শিক্ষার খোলনলচে পাল্টে এমন এক নতুন শিক্ষার বীজ বপনের কাজে হাত দিয়েছে, যা শিক্ষার্থীর মস্তিষ্ক ও পিঠ থেকে মুখস্থবিদ্যার বোঝা ঝেড়ে ফলে তাদের কৌতূহল, জিজ্ঞাসা, অনুসন্ধান, গবেষণা ও ভাবনার শক্তিকে জাগাবে ও নেতৃত্বের গুণাবলি তৈরিতে উপযোগী করে তুলবে। সে নিজেই নানা চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করবে, তা মোকাবিলা করে অভীষ্ট গন্তব্য পৌঁছাবে। বর্তমান সরকার ২০১০ শিক্ষাবর্ষ থেকে প্রাথমিক স্তরের শিক্ষাক্রম অনুসরণে সব ক্যাটাগরির বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে শতভাগ আকর্ষণীয় নতুন পাঠ্যপুস্তক দিয়ে আসছে। শিশুদের মধ্যে পাঠ্যপুস্তক আকর্ষণীয় করার জন্য ২০১২ শিক্ষাবর্ষ থেকে প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠ্যপুস্তক হোয়াইট পেপার, কভার পৃষ্ঠা, হিট থার্মাল পারফেক্ট বাইন্ডিংসহ চার রঙের আকর্ষণীয় মানসম্মত পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ করা হচ্ছে। ২০১৩ শিক্ষাবর্ষ থেকে পরিমার্জিত কারিকুলাম অনুযায়ী প্রাথমিক স্তরের পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ করা হচ্ছে। পরিমার্জিত কারিকুলামে বর্তমান বিশ্ব এবং সমসাময়িক পরিস্থিতিকে বিবেচনায় রাখা হয়েছে। ২০১০ সাল থেকে প্রতি বছর বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আনুষ্ঠানিকভাবে বই বিতরণ উৎসবে শিক্ষার্থীদের হাতে পাঠ্যপুস্তক তুলে দেন। এ কার্যক্রমের ধারাবাহিকতায় সারা দেশে একযোগে বছরের প্রথম দিনে শিক্ষার্থী-শিক্ষক-অভিভাবক, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, প্রাথমিক শিক্ষা সংশ্লিষ্ট দপ্তরসমূহের কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং গণ্যমান্য ব্যক্তিদের উপস্থিতিতে উৎসবমুখর ও আনন্দঘন পরিবেশে বই বিতরণ উৎসব উদযাপিত হয়ে আসছে।
এদিকে, মাধ্যমিকের কোনো কেন্দ্রীয় আয়োজন না থাকলেও সারা দেশে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বই উৎসবের আয়োজন করা হয়েছে। নিজ নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উৎসবমুখর পরিবেশে বই বিতরণ করা হয়। সব শিক্ষার্থী বই হাতে ফিরবে বলে জানিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ঢাকার বাইরের কয়েকটি স্কুল ও ঢাকার স্কুলগুলো পরিদর্শনে জানা যায়, প্রাথমিক শিক্ষার্থীরা সব বই পেয়েছে। প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হওয়া নতুন শিক্ষার্থীরা ১৪ তারিখে বই পাবে। গ্রামে ও শহরে অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে প্রাথমিকের শিক্ষার্থীরা সব বই পেয়েছে। মাধ্যমিকের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা সব বই পেয়েছে। অষ্টম ও নবমের শিক্ষার্থীরা পেয়েছে পাঁচ থেকে ছয়টি বই পেয়েছে। তবে গ্রামের পৌঁছেনি নবম শ্রেণির বই। মানের দিক থেকে তুলনায় গ্রামের শিক্ষার্থীদের বইয়ের মান কিছুটা খারাপ।
এবারের বই উৎসবে উচ্ছ্বসিত অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরা। কেন্দ্রীয় বই উৎসবে মিরপুর ন্যাশনাল সরকারি প্রাথমিক স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী আমেনা আক্তার জানায়, নতুন বই হাতে পেয়ে অনেক ভালো লাগছে তবে গত বছর তৃতীয় শ্রেণির বইয়ের কাগজ একটু ভালো ছিল। এ ছাড়া মিরপুর মনিপুর স্কুলের প্রথম শ্রেণির শিক্ষার্থী সিফাত রহমান বুকের মধ্যে বই জড়িয়ে ধরে তার ভালো লাগার কথা প্রকাশ করে। মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলের সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী রাতুল সবগুলো বছরের প্রথম দিনই সবগুলো পেয়েছে। সন্তানের সঙ্গে বই উৎসবে এসেছে বাবা আজহারুল ইসলাম। তিনি আমার সংবাদের প্রতিবেদককে বলেন, বছরের প্রথম দিনই সন্তান সবগুলো বই পেয়েছে। বাবা হিসেবে এটি আমাকে আনন্দিত করেছে। আমাদের সময় আর ওদের সময় এখন অনেক পার্থক্য মনে হচ্ছে। আমরা পুরোনো বই সংগ্রহ করার জন্য বিভিন্ন বাড়ি বাড়ি যেতাম। এবার গতবারের মতো হয়নি। বইয়ের উজ্জলতাও ভালো। আমরা চাই, এ ধারা অব্যাহত থাকুক। নারিন্দা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী নাহিদ সবগুলো বই পেয়েছে। হাসি হাসি মুখে মায়ের হাত ধরে বাড়ি ফিরছিল। নাহিদের আম্মু জোহরা খাতুন বলেন, ছয়টি বই একসঙ্গে পাবো ভাবিনি। প্রতিবারই দুই-তিনটি বই দিত। এবার হয়তো নির্বাচনের কারণে আমাদের খুশি করেছে। অনেক ভালো লেগেছে।
তবে ঢাকার বাইরের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা বই পায়নি। ফেনী জয়পুর সরোজিনী হাইস্কুলের জাহানারা আকতারের মা মিতু আকতার বলেন, বই উৎসব জেনেই স্কুলেই এসেছি। কিন্তু সব ক্লাসের বই দেয়া হলেও নবম শ্রেণির বই দেয়া হয়নি। শুনেছি, উপজেলা পর্যায়ে বই আসেনি। কবে বই পাবে? কখন পড়াশোনা শুরু করবে জানি না। বই উৎসব নিয়ে ঢাকা গভমেন্ট মুসলিম হাইস্কুলের অধ্যক্ষ মমতাজ আকতার আমার সংবাদকে বলেন, বছরের শুরুতে নতুন বই শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দিতে পারার আনন্দই অন্যরকম।
সন্তানতুল্য শিক্ষার্থীদের হাতে বই পৌঁছানোর পর তাদের চোখে মুখে দেখা তৃপ্তির হাসি আমাদেরও আনন্দিত করে। এবার সরকার বই উৎসবে প্রায় সব বই পৌঁছে দিয়েছে। তাই খুশিটা একটু বেশি। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) জানিয়েছে, প্রাক-প্রাথমিক থেকে সপ্তম শ্রেণির শতভাগ বই উপজেলায় পৌঁছে দিয়েছেন তারা। উপজেলা শিক্ষা অফিস সমন্বয় করে বইগুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চাহিদা মোতাবেক বিলি করছে। তবে অষ্টম-নবমের ২০-২৫ শতাংশ বই এখনো ছাপা হয়নি। সেগুলো চলতি মাসেই ছাপা শেষে শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছে দেয়া হবে। এনসিটিবির তথ্যমতে, ২০২৪ শিক্ষাবর্ষে শিক্ষার্থী সংখ্যা ধরা হয়েছে তিন কোটি ৮১ লাখ ২৭ হাজার ৬৩০ জন। তাদের জন্য বই ছাপা হয়েছে মোট ৩০ কোটি ৭০ লাখ ৮৩ হাজার ৫১৭টি। প্রথম, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য ছাপানো হয়েছে পাঁচ কোটি ৩৮ লাখ তিন হাজার ৪২৩ কপি বই।
দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির বই সংখ্যা তিন কোটি ৩৬ লাখ এক হাজার ২৭৪টি। প্রাক-প্রাথমিকের জন্য ৬১ লাখ ৯৩ হাজার ৮৭৮ কপি বই ছাপা হয়েছে। ষষ্ঠ শ্রেণিতে ছয় কোটি ৪৫ লাখ ৪৮ হাজার ৩০৮ কপি, সপ্তম শ্রেণির চার কোটি ৪৫ লাখ ৫৭ হাজার কপি, অষ্টম শ্রেণির জন্য পাঁচ কোটি ৩৪ লাখ ৮৪ হাজার ২৭১ কপি এবং নবম শ্রেণির জন্য পাঁচ কোটি ছয় লাখ ৮৪ হাজার ৫৭৩ কপি বই ছাপা হচ্ছে। অন্যদিকে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর (পাঁচটি ভাষায় রচিত) শিশুদের জন্য এবার মোট দুই লাখ পাঁচ হাজার ৩১ কপি বই ছাপা হয়েছে। অন্য বইয়ের মধ্যে পাঁচ হাজার ৭৫২ কপি ‘ব্রেইল’ বই আছে। তা ছাড়া শিক্ষকদের ৪০ লাখ ৯৬ হাজার ৬২৮টি ‘শিক্ষক সহায়িকা’ দেয়া হচ্ছে। এ ছাড়া ৯টি শ্রেণির মধ্যে এবার সাতটি শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রমে লেখা বই দেয়া হচ্ছে। সেগুলো হলো— প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম, নবম। এসব বইয়ের পাণ্ডুলিপি নতুন করে লেখা। শুধু চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা আগের শিক্ষাক্রমের বই পাবে।