Amar Sangbad
ঢাকা সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০২৪,

ভুয়া নথিতে ঋণ বিতরণ

রেদওয়ানুল হক

জানুয়ারি ২২, ২০২৪, ১২:৩৭ এএম


ভুয়া নথিতে ঋণ বিতরণ

জালিয়াতির মাধ্যমে ঋণ বিতরণ অব্যাহত রয়েছে শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোতে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শনে একের পর এক ঘটনা বেরিয়ে আসছে। সম্প্রতি পরিচালিত এক পরিদর্শনে দেখা যায়, ব্যাংক-গ্রাহক যোগসাজশে ভুয়া নথিপত্র তৈরি করে ত্রুটিপূর্ণ জামানতের বিপরীতে বিতরণকৃত ঋণ খেলাপি হয়ে পড়ায় বিপাকে পড়েছে শরিয়াহভিত্তিক পরিচালিত আল আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক। খেলাপি ঋণগুলো আদায়ে রহস্যজনক কারণে অর্থঋণ আদালতে মামলা করেনি ব্যাংকটি। জামানত ত্রুটিপূর্ণ হওয়ায় নিলামে বিক্রি করে দায় সমন্বয় করা যাচ্ছে না। আল আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের নর্থ-সাউথ রোড শাখায় এসব ঘটনা ঘটেছে। ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্রের মাধ্যমে এ সংক্রান্ত নথিপত্র আমার সংবাদের হাতে এসেছে।  

তথ্যমতে, ব্যাংকের নর্থসাউথ রোড শাখা থেকে ২০০৯ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর গ্রাহক মেসার্স সোহেল এন্টারপ্রাইজের অনুকূলে ৩০ লাখ টাকার বিনিয়োগ অনুমোদন করা হয়। নির্ধারিত সময়ে পরিশোধ না করায় ঋণটি খেলাপি হয়ে পড়ে। এরপর ২০০৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত মোট ১০ বার নবায়ন ও বর্ধিতকরণের ফলে ব্যাংকের কাছে প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান দায় দাঁড়িয়েছে দুই কোটি ৪০ লাখ টাকা। এর মধ্যে আমদানি দায় পরিশোধ বাবদ ঋণ রয়েছে ৪৭ লাখ টাকা। অর্থাৎ বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করে ঋণ দেয়া হলেও তা পরিশোধ করেনি গ্রাহক। বর্তমানে মন্দমানে শ্রেণিকৃত ঋণটি আদায়ে বিপাকে পড়েছে ব্যাংকটি। কারণ ঋণের বিপরীতে জামানত হিসেবে গ্রহণ করা ১.৬৮৭ শতাংশ জমি ও তদস্থিত ছয়তলা ভবন অবণ্টিত ছিল। যাচাই-ছাড়াই অথবা তথ্য গোপন করে ঋণটি অনুমোদন করা হয়েছে। বর্তমানে অন্য মালিকদের অংশ থাকায় জমি ও ভবন অধিগ্রহণ ও নিলামে বিক্রি প্রক্রিয়ায় জটিলতা দেখা দিয়েছে।  

একই খেলাপি গ্রাহককে পুনরায় জালজালিয়াতির মাধ্যম্যে ঋণ বিতরণ করেছে ব্যাংকটি। বর্তমানে গ্রাহকের নামে এক কোটি ১০ লাখ ৩৬ হাজার টাকার বাই মুয়াজ্জাল ঋণ রয়েছে। এর মধ্যে পাঁচটি হিসাবের দায় অসমন্বিত রয়েছে। স্থানীয় উৎস থেকে গ্রাহকের পণ্য ক্রয়ের জন্য ঋণসমূহ ছাড় করা হয়েছিল। কিন্তু ঋণ সংশ্লিষ্ট ক্রয় দলিলাদি যাচাই করে জালিয়াতির প্রমাণ পেয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সম্প্রতি পরিচালিত এক পরিদর্শনে দেখা যায়, পণ্যের প্রকৃত ক্রয় ছাড়াই গ্রাহক ও শাখা কর্মকর্তাদের যোগসাজসে ভুয়া দলিলাদি সৃষ্টি করে তার বিপরীতে বিনিয়োগের নামে ব্যাংকের অর্থ গ্রাহককে  দেয়া হয়েছে। পণ্য ক্রয়-বিক্রয়ের পক্ষে প্রয়োজনীয় প্রমাণাদি শাখা ব্যবস্থাপনার কাছে পাওয়া যায়নি। 

ব্যাংকটির শাখা সূত্র জানিয়েছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শক দলের কাছে প্রয়োজনীয় নথি উপস্থাপনে ব্যর্থ হন বর্তমান শাখা ব্যবস্থাপক। সরবরাহকৃত পণ্য ক্রয়ের ইনভয়েসে সরবরাহকারীর তাজ আয়রন স্টোরের প্রদত্ত স্বাক্ষরের সাথে তার ব্যাংক হিসাব খোলার ফরমে প্রদত্ত স্বাক্ষরের মিল নেই। একইভাবে, ক্রেতা সোহেল এন্টারপ্রাইজের হিসাব খোলার ফরমে প্রদত্ত স্বাক্ষর থেকে পণ্যের ইনভয়েসে প্রদত্ত স্বাক্ষর সুস্পষ্টভাবে ভিন্ন। এ ছাড়া পণ্য ক্রয়সংশ্লিষ্ট মূসক পরিশোধের প্রমাণক (মূসক চালান) দেখাতে পারেনি ব্যাংক কর্তারা। সে মোতাবেক সরকারকে ১৯ লাখ টাকা মূসক ফাঁকি দেয়া হয়েছে। এসব অসঙ্গতিকে স্পষ্ট জালিয়াতি হিসেবে চিহ্নিত করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শক দল। 

জালিয়াতির আরও শক্ত প্রমাণ চিহ্নিত করেছে পরিদর্শক দলের সদস্যরা। বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে গ্রাহকের কথিত ক্রয়কৃত বিপুল পণ্য মজুতের জন্য গুদাম ছিল কি-না তা জানতে চাওয়া হলে শাখা জানায়, গ্রাহকের গুদাম ছিল এবং তা নিয়মিত পরিদর্শন করা হতো। কিন্তু গুদামের দুটি পরিদর্শন প্রতিবেদনই ভুয়া। পরিদর্শক দলের পর্যালোচনায় দেখা যায়, প্রতিবেদন দুটি একই টেমপ্লেটে লিখিত, যেখানে শুধু তারিখ ছাড়া বাকি সব বিবরণ অভিন্ন। প্রতিবেদনে গ্রাহকের গুদামের আয়তন, ধারণ ক্ষমতা, অবস্থান উল্লেখ নেই। জালিয়াতিপূর্ণ প্রতিবেদনে স্বাক্ষর করেছেন মো. তাজুল ইসলাম, মো. কামাল হোসেন ও এ কে এম আমজাদ হোসেন। এ ছাড়া পণ্যের সরবরাহকারী তাজ আয়রন স্টোরের বিক্রয় রেজিস্টারের কপিও পরিদর্শক দলের কাছে উপস্থাপন করতে পারেনি ব্যাংক। ফলে, তাজ আয়রন কর্তৃক কোনো পণ্য বিক্রয় করা হয়নি মর্মে নিশ্চিত হয়েছে পরিদর্শক দল।

এসব ত্রুটিপূর্ণ তথ্য বিশ্লেষণ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শক দল এই সিদ্ধান্তে উপনীতি হয়েছে যে, ভুয়া নথি সৃজনপূর্বক ব্যাংকের ঋণকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করা হয়েছে; অথবা পণ্য ক্রয় হয়ে থাকলে সরকারের মূসক ফাঁকি দেয়া হয়েছে। ২০১৫ সালের জুলাই থেকে ২০১৭ সালের নভেম্বর সময়ে তৎকালীন শাখা প্রধান এ এন এম মুফীদুল ইসলাম এসব ঋণ দেন। জালিয়াতির স্পষ্ট উদাহরণ সত্ত্বেও ঋণসমূহ অনুমোদন করেন এ কে এম আমজাদ হোসেন ও মো. মঞ্জুর হাসান। তারা সবাই ব্যাংকটির এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট (ইভিপি) পদমর্যাদার কর্মকর্তা। 

এসব ঋণ সমন্বয়ের লক্ষ্যে ব্যাংক থেকে ২০১৯ সালের ২৫ নভেম্বর গ্রাহককে লিগ্যাল নোটিস দেয়া হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০২০ সালের ১২ জানুয়ারি এনআই অ্যাক্টের অধীনে মামলা করা হয়। পরে ২০২১ সালের ২২ জুন পুনরায় লিগ্যাল নোটিস হলেও অদৃশ্য কারণে অর্থঋণ আদালতে মামলা করা হয়নি। যা পরিদর্শক দলের কাছে অস্বাভাবিক মর্মে প্রতীয়মান হয়েছে।

অন্যদিকে সোহেল এন্টারপ্রাইজের স্বত্ব্বাধিকারী মো. আবু সাইদ সোহেল ব্যাংকের কাছে পাঁচজনের মালিকানাধীন যে জমি ও ভবন বন্ধক রেখেছিলেন তার প্রকৃত মালিক আটজন। জামানত অবিভাজ্য অবস্থায় থাকায় ওই ভবন ও জমি বিক্রি করে ব্যাংকের ঋণ সমন্বয়ে জটিলতা দেখা দিয়েছে। বাকি তিন মালিকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে পরিচালিত পরিদর্শনে জালিয়াতির এসব তথ্য বেড়িয়ে এসেছে। এতে দেখা যায়, আটজন স্বত্বাধিকারীর ২.৯৪ শতাংশ জমি সম্পত্তি পাঁচজন স্বত্বাধিকারীর ১.৬৮ জমির আমমোক্তারের বিপরীতে বন্ধক গ্রহণের মাধ্যমে অপর তিন স্বত্ব্বাধিকারীর সম্পত্তিকে এবং একই সাথে ব্যাংকের ঋণকে ঝুঁকিতে ফেলা হয়েছে; যাতে ব্যাংক কর্মকর্তাদের প্রত্যক্ষ যোগসাজশ রয়েছে। 
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে আল আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট ও নর্থ-সাউথ রোড শাখা ব্যবস্থাপক আশরাফ হোসাইন আমার সংবাদকে বলেন, ‘গ্রাহক খেলাপি হয়ে পড়ায় ঋণটি আদায়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। জালিয়াতির বিষয়ে জানতে চাইলে এ কর্মকর্তা প্রশ্ন এড়িয়ে বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শক দলের পক্ষ থেকে চাওয়া প্রতিটি তথ্য সরবরাহ করা হয়েছে। এ সংক্রান্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিদ্ধান্ত এখনো চূড়ান্ত হয়নি।’

ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফরমান আর চৌধুরীর মন্তব্যের জন্য তার মুঠোফোনে কল করা হলে তিনি সাড়া দেননি। অনলাইনে পাঠানো লিখিত প্রশ্নেরও উত্তর দেননি তিনি। এরপর প্রধান কার্যালয়ে গেলে তার দপ্তরে যেতে বাধা দেন ব্যাংককর্মীরা। এ সময় জনসংযোগ বিভাগের প্রধান জালাল আহমেদের মুঠোফোনে কল করা হলে তিনি লিখিত প্রশ্ন পাঠানোর পরামর্শ দেন। পরবর্তীতে লিখিত প্রশ্ন পাঠানো হলে গতকাল রাত ৮টায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত ব্যাংকের পক্ষ থেকে কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।

প্রসঙ্গত, করোনা মহামারির সময়ে ব্যাংকগুলোর প্রধান কার্যালয়ে সর্বসাধারণের প্রবেশে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। মহামারি-পরবর্তী সময়ে এ বিধিনিষেধ সাংবাদিকদের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করছে আল আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকসহ বেশ কয়েকটি বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক। যা উচ্চ আদালতের নির্দেশনা পরিপন্থি ও স্বাধীন সাংবাদিকতায় প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ হিসেবে দেখছেন আইনজ্ঞরা। বর্তমানে ব্যাংকে সাংবাদিক প্রবেশের আগে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার নাম উল্লেখ করতে হয়। পরবর্তীতে ওইসব কর্মকর্তাকে নানাভাবে হেনস্তা করেন ব্যাংকের নির্বাহীরা। তাই সাংদিকদের সঙ্গে কথা বলতে ভয় পান কর্মকর্তারা। যেহেতু ব্যাংকে প্রবেশের জন্য কোনো কর্মকর্তার অনুমোদন পাওয়া যায় না; তাই পেশাগত দায়িত্ব পালন ও তথ্য সংগ্রহে নানা প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হন অর্থনীতি-সংশ্লিষ্ট সাংবাদিকরা। আইন অমান্য করে এ ধরনের হয়রানিমূলক কাজ চালিয়ে যাচ্ছে বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলো।
 

Link copied!