Amar Sangbad
ঢাকা সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০২৪,

৪৮ বছরে নগরায়ণ বেড়েছে ৩১ ভাগ

আব্দুল কাইয়ুম

আব্দুল কাইয়ুম

জানুয়ারি ২৩, ২০২৪, ১২:১৩ এএম


৪৮ বছরে নগরায়ণ বেড়েছে ৩১ ভাগ
  • দেশের অর্ধেক কর্মসংস্থান ঢাকায়
  • ২৫ ভাগ সড়কের স্থানে আছে ৮ ভাগের কম
  • মোট জনসংখ্যার ৪০ শতাংশ নগরবাসী
  • ঢাকায় বাস করছে ৩২ শতাংশ 
  • যানজটে জিডিপির প্রায় ২.৯ শতাংশ ক্ষতি হচ্ছে

প্রতিটি জেলায় অন্তত একটি করে অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তুললে জেলাভিত্তিক কর্মসংস্থান বাড়বে এবং কমবে ঢাকামুখী জনস্রোত
—ড. নজরুল ইসলাম, সহসভাপতি, বাপা

ঢাকায় অতিনগরায়ণের ফলে বেড়েছে নানা ধরনের ঝুঁকি ও যানজট 
—অধ্যাপক রেহমান সোবহান, চেয়ারম্যান, সিপিডি

সারা দেশে ১৯৯৭ সালে নগর অঞ্চলের পরিমাণ ছিল মাত্র ৯ শতাংশ। তা বহুগুণ বেড়ে ২০২২ সালে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪০ শতাংশ। অর্থাৎ, বিগত ৪৮ বছরে দেশে নগর অঞ্চলের পরিমাণ বেড়েছে প্রায় ৩১ শতাংশ। যদিও বেড়েই চলেছে নগর অঞ্চলের পরিমাণ কিন্তু সেই অনুযায়ী নেই রাস্তা। যেখানে মোট আয়তনের ২৫ ভাগ সড়ক থাকার কথা, সেখানে রয়েছে মাত্র ৮ ভাগ। তাছাড়া ৫২ শতাংশ মোটরযানই চলাচলের অযোগ্য। আর এসব কারণে প্রতিনিয়ত বাড়ছে যানজট, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) ও বাংলাদেশ পরিবেশ নেটওয়ার্কের (বেন) যৌথ গবেষণায় এমনটাই উঠে আসে । 

বেন ও বাপার গবেষণায় দেখা যায়, ক্রমাগত দখল ও দূষণে দেশের শহরগুলোর সবুজ ও জলজ অংশগুলো বিলীন হয়ে পড়েছে। দেশের জনসংখ্যার ৪০ শতাংশ এখন শহরে বসবাস করে; এর মধ্যে ঢাকাতেই বসবাস করে ৩২ শতাংশ নগরবাসী। ২০৪১ সালে দেশের ৫০ শতাংশ নগর অঞ্চলে রূপ লাভ করবে। সরকার উন্নত দেশ গঠনের ঘোষণা দিলেও উন্নত দেশ যেসব প্রকল্প থেকে সরে আসছে, সেসব প্রকল্প ঢাকায় বাস্তবায়ন করছে। ঢাকায় অপরিকল্পিত প্রকল্প বাস্তবায়নে বিপুল অর্থ বাস্তবায়ন করছে, দেশের অন্যান্য শহরও সেসব প্রকল্প দাবি করছে। সারা দেশ ঢাকাকে অনুসরণ করে। এসব প্রকল্পের বেশিরভাগই গণমুখী নয়, কিছু প্রকল্প শুধু মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তের কথা বিবেচনায় করা হচ্ছে। এসব কার্যক্রম থেকে সরে এসে সরকারকে গণমুখী প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হবে, তাহলে তা পরিবেশবান্ধব হবে। গুটিকয়েক শহর নয়, দেশের ৬৪টি জেলাকে গুরুত্ব দিয়ে কাজ করতে হবে। 

গবেষণায় আরও দেখা যায়, জিডিপির এক-তৃতীয়াংশ আসে ঢাকা থেকে এবং সারা দেশের প্রায় অর্ধেক কর্মসংস্থান রয়েছে শুধু ঢাকাতেই। অথচ ঢাকায় নেই ন্যূনতম নাগরিক সুবিধা। ঢাকায় বিনিয়োগে সুফল কম মিলছে জেলা ও উপজেলায় বিনিয়োগের চেয়ে। এতে বিনিয়োগে জিডিপি কমে যাচ্ছে ৬ থেকে ১০ শতাংশ। ঢাকার অতিবৃদ্ধি সারা দেশের অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। নগরবাসীর বিভিন্ন মৌলিক নাগরিক সেবা অর্থাৎ, বিদ্যুৎ, পানি, পয়ঃনিষ্কাশন, সড়ক, পরিবহন, বাসস্থানের চাহিদা মেটানো কঠিন হয়ে পড়েছে। দেশের মানুষের মধ্যে আয়বৈষম্য আগের চেয়ে বেড়েছে। দেশের মোট আয়ের ১৮ শতাংশ হলো ৫০ শতাংশ হতদরিদ্রের হাতে। আর ধনী ৫ শতাংশের হাতে মোট আয়ের ৩০ শতাংশ। সরকার গ্রামকে শহরে রূপান্তরের ঘোষণা দিলেও এর সুনির্দিষ্ট রূপরেখা দেয়নি।

বিশেষজ্ঞদের মতে, আশির দশক থেকে ঢাকায় বিনিয়োগ বাড়ছে। এর আগে অন্যান্য শহরের মতো বিনিয়োগ হতো ঢাকায়ও। তখন ঢাকার ও দেশের অন্যান্য শহরের মধ্যে তেমন পার্থক্য ছিল না। বেশি বিনিয়োগের পর থেকে ঁঁ শেষ পৃষ্ঠার পর

ঢাকায় কর্মসংস্থান বাড়তে থাকে। কর্মের প্রয়োজনে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষ ঢাকায় জড়ো হতে থাকে। যে হারে ঢাকামুখী বিনিয়োগ বেড়েছে, সে হারে জেলা ও উপজেলা শহরে বিনিয়োগ বাড়েনি। ফলে ঢাকায় জনঘনত্বপূর্ণ শহরে পরিণত হয়েছে। এখন যানবাহনের ঘণ্টায় গতিবেগ ২৩ কিলোমিটার থেকে ৭ কিলোমিটারে নেমে এসেছে। ঢাকার যানজটের কারণে জিডিপির প্রায় ২ দশমিক ৯ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। জনশুমারি ২০২২-এর তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা উত্তর সিটিতে প্রতি বর্গকিলোমিটারে প্রায় ৩১ হাজার মানুষ বসবাস করে। আর ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে প্রতি বর্গকিলোমিটারে বাস করে প্রায় ৪০ হাজার মানুষ। প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে রাজধানী ঢাকার জনসংখ্যার পরিমাণ। নগরায়ণকে কেন্দ্র করে সবাই রাজধানীমুখী হচ্ছে। কিন্তু সেই অনুযায়ী বাড়ছে না রাস্তা ও সুবিধা।  

বাংলাদেশ পরিবেশ নেটওয়ার্কের (বেন) প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও বাপার সহসভাপতি ড. নজরুল ইসলাম বলেন, সরকার ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল গঠনের বিষয়ে গুরুত্ব দিয়েছে। এটি ভালো উদ্যোগ যদি সবগুলো একত্রে না-ও হয়, অন্তত ৬৪টি জেলায় একটি করে অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা হয়, তাতেও জেলাভিত্তিক কর্মসংস্থান বাড়বে। কমবে ঢাকামুখী জনস্রোত। ঢাকা প্রশাসনিক ও আবাসিক শহর হওয়ার কথা থাকলেও অপরিকল্পিত ভূমি ব্যবহারের কারণে এই শহর শিল্পনগরে পরিণত হয়েছে। ঢাকা ও আশপাশের এলাকায় পোশাক খাতের প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক কাজ করছেন। নতুন সরকারের কাছে দাবি জানাব, দেশের নগর-পরিকল্পনা নিয়ে নতুন করে ভাবুন। নইলে ক্রমবর্ধমান দেশের নগর অঞ্চল বড় সমস্যার সৃষ্টি করবে, যেটার ব্যবস্থাপনা করা সম্ভব হবে না। বর্তমানে দেশে ১২টি সিটি কর্পোরেশন, ৩২৭টি পৌরসভা ও ৫৭০টি নগর কেন্দ্র রয়েছে।

নগর গবেষণা কেন্দ্রের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. নজরুল ইসলাম বলেন, প্রতিবছর ঢাকায় পাঁচ লাখ মানুষ নতুন করে যুক্ত হচ্ছে; এর মধ্যে প্রায় চার লাখই দরিদ্র। অতিরিক্ত বৃদ্ধি শহরকে সমস্যাগ্রস্ত করছে। সরকারের নগর উন্নয়নের দায়িত্ববোধ নেই। গ্রামীণ প্রকৃতির দেশটি নগররাষ্ট্র হওয়ার দৌড়ে থাকলেও দেশে নেই কোনো নগর উন্নয়ন মন্ত্রণালয়। দরিদ্রদের জন্য মিরপুরে বিশাল আবাসিক এলাকা গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়া হয়। সেখানে পরিকল্পনার চেয়েও ২০ গুণ বেশি মানুষ বসবাস করছে। তবু সেখানে তেমন কোনো সমস্যা নেই। কেননা, কাজটি সেখানে পরিকল্পিত উপায়ে তৈরি করা হয়েছিল। সে সময় অভিজাতদের জন্য ধানমন্ডি ও মোহাম্মদপুর আবাসিক এলাকা গড়ে তোলা হয়। সরকারের পরিকল্পনায় দরিদ্রদের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। 

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেন, ঢাকায় অতি নগরায়ণের ফলে যানজট বেড়েছে। নগরের নানা ধরনের ঝুঁকি বাড়ছে। সমন্বয় না থাকায় নগর দ্রুত বাড়ছে। আবাসন কোম্পানির চটকদার বিজ্ঞাপনের ফলে দেশের মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। তিনি বলেন, ঢাকার আশপাশের এলাকা আবাসন কোম্পানিগুলো ভরাট করে প্রকল্প গড়ে তুলেছে। এসব নিয়ন্ত্রণে সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলো যথাযথ ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। এজন্য সরকারকে নগর-সংশ্লিষ্টদের ভূমিকম্প প্রতিরোধকব্যবস্থা ও সংশ্লিষ্টদের এসব বিষয়ে দৃষ্টিপাত করার অনুরোধ রাখব। নিউইয়র্কসহ বিশ্বের উন্নত শহরগুলোয় মেয়রদের হাতে অনেক ক্ষমতা থাকে। এজন্য তারা নগর উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণে বড় ভূমিকা রাখতে পারেন। বাংলাদেশের মেয়রদের ক্ষমতা বাড়ানো দরকার। তাহলে তারা কাজগুলো সঠিকভাবে করতে পারবেন।
 

Link copied!