Amar Sangbad
ঢাকা বুধবার, ২৫ ডিসেম্বর, ২০২৪,

সুদ ব্যবসায় আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক

শরিয়াহ লঙ্ঘন করে ঋণ বিতরণ

অর্থনৈতিক প্রতিবেদক

অর্থনৈতিক প্রতিবেদক

ফেব্রুয়ারি ৮, ২০২৪, ০৩:৩০ পিএম


শরিয়াহ লঙ্ঘন করে ঋণ বিতরণ
  • কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন
  • বাই মুয়াজ্জাল বিনিয়োগের নিয়ম মানছে না ব্যাংকটি
  • পণ্য ক্রয় ছাড়াই ভুয়া ডিল
  • গ্রাহক ছাড়াই সৃষ্টি হচ্ছে ঋণ
  • শরিয়াহ লঙ্ঘন চিহ্নিত করে দোষীদের শাস্তির সুপারিশ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শক দল

জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকা শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোকে আস্থার সংকটে ফেলছে কয়েকটি ব্যাংক। সুদভিত্তিক লেনদেনে জড়িয়ে পুরো ইসলামি ব্যাংকিং খাতকে ঝুঁকিতে ফেলছে তারা। এর মধ্যে অন্যতম আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক। নথিপত্র ছাড়াই ঋণ বিতরণ, শরিয়াহ লঙ্ঘন করে ভুয়া ডিল সৃষ্টি এবং কর ফাঁকি দেয়ার মতো কাণ্ড ঘটিয়েছে ব্যাংকটি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শক দল শরিয়াহ লঙ্ঘনের চিত্র শনাক্ত করে দোষী কর্মকর্তাদের শাস্তির সুপারিশ করেছে। এমন জালিয়াতির ফলে ব্যাংকটির গ্রাহক ও শেয়ারহোল্ডাররা প্রতারণার শিকার হচ্ছেন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এর মাধ্যমে ব্যাংকটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শরিয়াহ গাইডলাইন এবং ব্যাংক কোম্পানি আইন অমান্য করে যাচ্ছে বলে মত দিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ইসলামি ব্যাংক রেগুলেশন বিভাগের কর্মকর্তারা। 

আমার সংবাদের হাতে থাকা নথিপত্র বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, শরিয়াহ লঙ্ঘন করে ব্যাংক-গ্রাহক যোগসাজশে ঋণ সৃষ্টি করে যাচ্ছে আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক। ব্যাংকটির যাত্রবাড়ী দক্ষিণ শাখায় পরিচালিত এক পরিদর্শনে উঠে এসেছে ভুয়া ডিল সৃষ্টি করে শরিয়াহ বহির্ভূত সুদভিত্তিক লেনদেনের চিত্র। দীর্ঘ সময় ধরে এ ধরনের জালিয়াতি করে আসছে ব্যাংকটি। পরিদর্শন প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ব্যাংকের গ্রাহক মেসার্স আলভী কটন ও মেসার্স আলভী ইন্টারন্যাশনাল নামে দু’টি প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে শরিয়াহ বহির্ভূত ৯টি ভুয়া ডিল সৃষ্টি করেছে ব্যাংকের কর্মকর্তারা। বিস্ময়করভাবে গ্রাহকের অগোচরেই এসব ডিল সৃষ্টি করা হয়েছে। এ মাধ্যমে একদিকে যেমন গ্রাহককে ফাঁসানো হয়েছে; অপরদিকে শরিয়াহ ভঙ্গ করেছে ব্যাংকটি। 

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১২ সালে ২৯ মার্চ শরিয়াহ বহির্ভূত পাঁচটি ডিল (নং ১১৬৩, ১১৭৪, ১১৮৫, ১১৯৬, ১২০৭) সৃষ্টি হয়েছে এই শাখায়। একই বছরের ১ এপ্রিল দুটি (নং ১২১৮ ও ১২২৯০ ৩ এপ্রিল দুটি (নং ৯১২৪২ ও ১২৫৩), ৮ এপ্রিল একটি (নং ১২৬৪) এবং ১৯ এপ্রিল একটি (নং ১৩২১)-সহ মোট ১১টি ডিল হয়েছে। এর বিপরীতে মোট চার কোটি ৭০ লাখ টাকার শরিয়াহ বহির্ভূতভাবে বাই-মুয়াজ্জাল বিনিয়োগ সৃষ্টি করা হয়েছে। এসব ঋণের বিষয়ে পরিদর্শক দল উল্লেখ করেছে, ‘শরিয়াহ আইন অনুযায়ী ক্রেতা, বিক্রেতা ও পণ্য ছাড়া বাই-মুয়াজ্জাল বিনিয়োগ করা যায় না। এখানে বিক্রেতার উপস্থিতি থাকলেও ক্রেতা ও পণ্য অনুপস্থিত। তাই শরিয়াহ আইন অনুযায়ী ডিল সৃষ্টি হয়নি। শাখা শরিয়াহ আইন লঙ্ঘন করে ডিল সৃষ্টি করেছে যা অবৈধ।’ 

একই সাথে শরিয়াহ লঙ্ঘনকারী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করেছে পরিদর্শক দল। পরিদর্শন প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, একই গ্রাহকের অনুকূলে আরও ছয়টি শরিয়াহ বহির্ভূত ভুয়া ডিল সৃষ্টি করা হয়েছে। যার নং ৪৯৭, ৪৮৬, ৫০৪, ৫১৯, ৪৭৫ ও ৫২১। এসব ডিল গ্রাহকের আবেদন ছাড়াই নবায়ন ও পুনঃতফসিল করা হয়েছে। কৃত্রিম মুনাফা দেখিয়ে ব্যাংকের পুরো মুনাফাকে শরিয়াহ বহির্ভূত (হারাম) আয়ে পরিণত করা হয়েছে। ইলসামি শরিয়তের নিয়ম অনুযায়ী, হালাল উপার্জনের সঙ্গে সামান্য হারাম যুক্ত হলেও পুরো অর্থ হারামে পরিগণিত হয়, মত শরিয়াহ-সংশ্লিষ্টদের। 

এসব অনিয়মের মাধ্যমে ব্যাংকটি গ্রাহকের সঙ্গে প্রতারণা চালিয়ে যাচ্ছে বলে মত দিয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ইসলামি ব্যাংকিং বিভাগের কর্মকর্তারা। নির্ধারিত মুখপাত্র ছাড়া গণমাধ্যমে বক্তব্য না দেয়ার বাধ্যবাধকতা থাকায় নাম প্রকাশ না করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা আমার সংবাদকে বলেন, ‘শরিয়াহ ব্যাংক পরিচালনার প্রতিশ্রুতি দিয়ে গ্রাহকের আমানত সংগ্রহ করেছে আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক। তা ছাড়া পুঁজিবাজারে ব্যাংকটির শেয়ার কিনে বহু গ্রাহক বিনিয়োগ করেছে। এখন শরিয়াহ লঙ্ঘন করে ব্যবসা করলে এবং এর বিপরীতে মুনাফা দিলে সুদের চক্করে পড়বে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। 

এ ছাড়া আমানতের বিপরীতে প্রদত্ত মুনাফাও সুদে পরিণত হবে। এ ধরনের কর্মকাণ্ড শরিয়াহ গাইডলাইনের পরিপন্থি। একই সাথে শরিয়াহ ব্যাংক পরিচালনার জন্য লাইসেন্স নিয়ে গ্রাহকের সঙ্গে এ ধরনের প্রতারণা ব্যাংক কোম্পানি আইনের স্পষ্ট লঙ্ঘন।’ পরিদর্শন প্রতিবেদন অনুযায়ী, ব্যাংকটির একই শাখায় শরিয়াহ লঙ্ঘনের আরও একাধিক প্রমাণ পেয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শক দল। তারা সুনির্দিষ্টভাবে এসব অনিয়ম উল্লেখ করে দোষী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করেছে। ব্যাংকটিতে পরিচালিত অপর এক পরিদর্শনে উঠে এসেছে একই ধরনের চিত্র। আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের নর্থ-সাউথ রোড শাখায় নথিপত্র ছাড়া বিনিয়োগের প্রমাণ পেয়েছে পরিদর্শক দল। এসব বিনিয়োগও শরিয়াহ আইন লঙ্ঘন করে সৃষ্টি করা হয়েছে বলে মনে করেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা। 

পরিদর্শন প্রতিবেদন অনুযায়ী, ব্যাংকের নর্থ-সাউথ রোড শাখার গ্রাহক মেসার্স সোহেল এন্টারপ্রাইজের অনুকূলে জাল-জালিয়াতির মাধ্যম্যে ঋণ বিতরণ করেছে ব্যাংকটি। এই গ্রাহকের নামে এক কোটি ১০ লাখ ৩৬ হাজার টাকার বাই-মুয়াজ্জাল বিনিয়োগ রয়েছে। এর মধ্যে পাঁচটি হিসাবের দায় অসমন্বিত। স্থানীয় উৎস থেকে গ্রাহকের পণ্য ক্রয়ের জন্য ঋণসমূহ ছাড় করা হয়েছিল। কিন্তু ঋণ-সংশ্লিষ্ট ক্রয় দলিলাদি যাচাই করে জালিয়াতির প্রমাণ পেয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সম্প্রতি পরিচালিত এক পরিদর্শনে দেখা যায়, পণ্যের প্রকৃত ক্রয় ছাড়াই গ্রাহক ও শাখা কর্মকর্তাদের যোগসাজশে ভুয়া দলিলাদি সৃষ্টি করে তার বিপরীতে বিনিয়োগের নামে ব্যাংকের অর্থ গ্রাহককে দেয়া হয়েছে। পণ্য ক্রয়-বিক্রয়ের পক্ষে প্রয়োজনীয় প্রমাণাদি শাখা ব্যবস্থাপনার কাছে পাওয়া যায়নি। 

ব্যাংকটির শাখা সূত্র জানিয়েছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শক দলের কাছে প্রয়োজনীয় নথি উপস্থাপনে ব্যর্থ হন বর্তমান শাখা ব্যবস্থাপক। সরবরাহকৃত পণ্য ক্রয়ের ইনভয়েসে সরবরাহকারীর তাজ আয়রন স্টোরের প্রদত্ত স্বাক্ষরের সাথে তার ব্যাংক হিসাব খোলার ফরমে প্রদত্ত স্বাক্ষরের মিল নেই। একইভাবে, ক্রেতা সোহেল এন্টারপ্রাইজের হিসাব খোলার ফরমে প্রদত্ত স্বাক্ষর হতে পণ্যের ইনভয়েসে প্রদত্ত স্বাক্ষর সুস্পষ্টভাবে ভিন্ন। এ ছাড়া পণ্য ক্রয়-সংশ্লিষ্ট মূসক পরিশোধের প্রমাণক (মূসক চালান) দেখাতে পারেননি ব্যাংক কর্তারা। সে মোতাবেক সরকারকে ১৯ লাখ টাকা মূসক ফাঁকি দেয়া হয়েছে। এসব অসঙ্গতিকে স্পষ্ট জালিয়াতি হিসেবে চিহ্নিত করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শক দল। জালিয়াতির আরও শক্ত প্রমাণ চিহ্নিত করেছেন পরিদর্শক দলের সদস্যরা। বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে গ্রাহকের কথিত ক্রয়কৃত বিপুল পণ্য মজুতের জন্য গুদাম ছিল কি-না তা জানতে চাওয়া হলে শাখা জানায়, গ্রাহকের গুদাম ছিল এবং তা নিয়মিত পরিদর্শন করা হতো। কিন্তু গুদামের দুটি পরিদর্শন প্রতিবেদনই ভুয়া। 

পরিদর্শক দলের পর্যালোচনায় দেখা যায়, প্রতিবেদন দুটি একই টেমপ্লেটে লিখিত, যেখানে শুধু তারিখ ছাড়া বাকি সব বিবরণ অভিন্ন। প্রতিবেদনে গ্রাহকের গুদামের আয়তন, ধারণ ক্ষমতা, অবস্থান উল্লেখ নেই। জালিয়াতিপূর্ণ প্রতিবেদনে স্বাক্ষর করেছেন মো. তাজুল ইসলাম, মো. কামাল হোসেন ও এ কে এম আমজাদ হোসেন। এ ছাড়া পণ্যের সরবরাহকারী তাজ আয়রন স্টোরের বিক্রয় রেজিস্টারের কপিও পরিদর্শক দলের কাছে উপস্থাপন করতে পারেনি ব্যাংক। ফলে, তাজ আয়রন কর্তৃক কোনো পণ্য বিক্রয় করা হয়নি মর্মে নিশ্চিত হয়েছেন পরিদর্শক দল।

এসব ত্রুটিপূর্ণ তথ্য বিশ্লেষণ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শক দল এই সিদ্ধান্তে উপনীতি হয়েছে যে, ভুয়া নথি সৃজনপূর্বক ব্যাংকের ঋণকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করা হয়েছে; অথবা, পণ্য ক্রয় হয়ে থাকলে সরকারের মূসক ফাঁকি দেয়া হয়েছে। ২০১৫ সালের জুলাই থেকে ২০১৭ সালের নভেম্বর সময়ে তৎকালীন শাখা প্রধান এএনএম মুফীদুল ইসলাম এসব বিনিয়োগ প্রদান করেন। জালিয়াতির স্পষ্ট উদাহরণ সত্ত্বেও বিনিয়োগসমূহ অনুমোদন করেন এ কে এম আমজাদ হোসেন ও মো. মঞ্জুর হাসান। তারা সবাই ব্যাংকটির এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট (ইভিপি) পদমর্যাদার কর্মকর্তা। বহু চেষ্টা করেও এসব বিষয়ে ব্যাংকের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের মুঠোফোনে কল দিলে তিনি সাড়া দেননি। এরপর অনলাইনে লিখিত প্রশ্ন পাঠনো হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাংকের জনসংযোগ বিভাগ থেকে লিখিত প্রশ্ন জমা দেয়ার পরামর্শ দেয়া হয়। গত ২৮ জানুয়ারি লিখিত প্রশ্ন পাঠালে ব্যাংক তা গ্রহণ করে। কিন্তু গতকাল রাত ৯টায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত প্রশ্নের উত্তর দেয়নি আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক পিএলসি। 

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক আমার সংবাদকে বলেন, ‘ইসলামি ধারার কোনো ব্যাংকে শরিয়াহ আইন লঙ্ঘন হলে আমরা ব্যাংকের শরিয়াহ বোর্ডের কাছে তথ্য পাঠাই। শরিয়াহ বোর্ডের মতামতের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হয়।’ প্রসঙ্গত, যেকোনো বিনিয়োগ অনুমোদনের আগে শরিয়াহ বোর্ডের মতামত নেয়া বাধ্যতামূলক। 

প্রসঙ্গত, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের মোট বিনিয়োগ ৪৪ হাজার ৭৬১ কোটি টাকা। ব্যাংকটিতে সাধারণ মানুষের শেয়ারের পরিমাণ ২৬ শতাংশ। গ্রাহকের স্বার্থ বিবেচনায় ব্যাংকের সমুদয় বিনিয়োগ পরীক্ষা করে দেখা উচিত বলে মনে করেন ব্যাংকটির শেয়ারহোল্ডাররা।

 

Link copied!