ফেব্রুয়ারি ১১, ২০২৪, ১২:৫০ এএম
বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমারের অধিকাংশ সীমানা বিদ্রোহী গোষ্ঠীর হাতে চলে গেছে, এখন আমাদের নতুন ঝুঁকি তৈরি হলো
—মে. জে. আবদুর রশীদ, নিরাপত্তা বিশ্লেষকবাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমারের ইমিগ্রেশন বা কাস্টমস সবই বিদ্রোহীদের দখলে, এখন সব কিছু বন্ধ থাকা আবশ্যক
—ইশফাক ইলাহী চৌধুরী, নিরাপত্তা বিশ্লেষক
যতক্ষণ পর্যন্ত আরাকান আর্মি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি না পাবে ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক নেই
—ড. আমেনা মহসিন, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক
রাখাইন রাজ্যের বড় অংশ নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি। রাষ্ট্রীয় বাহিনীর উপর হামলা চালিয়ে একের পর চকিগুলো দখলে নিয়ে সর্বোচ্চ শক্তি উপস্থাপন করল বিদ্রোহী গোষ্ঠীটি। তাদের হামলায় টিকতে না পেরে দেশটির সেনাবাহিনী, সীমান্তরক্ষী পুলিশ (বিজিপি), সরকারি কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন সংস্থা সদস্যরা বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছে। রাখাইন থেকে বিদেশি মিশন ও আন্তর্জাতিক সংস্থার লোকজনকে নিরাপদে সরিয়ে নেয়া হচ্ছে। কারণ সেখানেও বিদ্রোহীরা দখল নিচ্ছে। বাংলাদেশের সাথে সীমান্তে মংডু শহরাঞ্চলের টং পিও টহল চৌকি দখল করে নিয়েছে আরাকান আর্মি।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বলছে, রাখাইনের উত্তরাঞ্চলে ম্রাউক-ইউ, কিয়াউকতাও, মিনবিয়া, রামরি, আন এবং মাইবন এলাকাও প্রায় নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে আরাকান আর্মি। বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমার যে সীমান্ত রয়েছে সেখানের রাষ্ট্রীয় বাহিনীর টহল চৌকিগুলো এখন আরাকান আর্মির দখলে। এতে বাংলাদেশের জন্য গভীর চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা বলছেন, যতক্ষণ পর্যন্ত মিয়ানমারের সরকার বিদ্রোহী গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে নেয়া এলাকা দখলে নিতে পারবে, ততক্ষণ পর্যন্ত মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের বর্ডার বন্ধ করে দেয়া উচিত। আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক হিসেবে বংলাদেশের সম্পর্ক মিয়ানমারের সাথে কোনো বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক নেই। যেহেতু বিভিন্ন মাধ্যম থেকে খবর আসছে বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমারের যে সীমানা রয়েছে তার ৭০ শতাংশ বিদ্রোহীদের দখলে চলে গেছে, বাংলাদেশের জন্য ঝুঁকি বাড়ল। বিদ্রোহী গোষ্ঠী ইতোমধ্যে সে দেশের রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে কব্জা করে রাখাইন প্রায় নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে। তাই মিয়ানমারের সঙ্গে সব ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ করে সীমানাও বন্ধ করে দেয়া আবশ্যক। গত কয়েক মাসে মিয়ানমার আন্তর্জাতিক সব ধরনের আইন ভঙ্গ করেছে। সেই দেশের গুলি বাংলাদেশে এলো, আকাশে উড়লো যুদ্ধজাহাজও। তার মধ্যে নয়া ঝুঁকি তৈরি হলো মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের যে সীমানা রয়েছে তার বেশির ভাগ দখলে চলে গেলো বার্মিজ বিদ্রোহী গোষ্ঠীর হাতে।
সামগ্রিক বিষয় নিয়ে জানতে চাইলে নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আবদুর রশীদ আমার সংবাদকে বলেন, ‘মিয়ানমারের অধিকাংশ সীমানা এখন সে দেশের বাহিনীর থেকে বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির দখলে চলে গেছে। এটি নিঃসন্দেহে আমাদের অনেক কিছুই ভাবনার আছে। আগামীতে সীমানার বিষয়ে বোঝাপড়া কিভাবে হবে সেগুলোর কিছু হিসাব-নিকাশ তো আছে বটে। তারা আমাদের এখানে ঢুকে পড়বে কি-না, আমাদের কিছু ব্যবহার করবে কি-না। সব মিলিয়ে ঝুঁকিটা বেড়েছে। মিয়ানমারের সরকারি বাহিনী যদি আন্তর্জাতিক আইনের বাইরে গিয়ে কিছু করে ফেলে আমাদের সরকারকে কিছু বলার বিষয় ছিল। এখন যেহেতু সেই সীমানার অধিকাংশ বিদ্রোহী গোষ্ঠীর হাতে চলে গেছে, এখানে হিসাবের নতুন মাত্রা যোগ হবে, সঙ্গে তৈরি হবে ঝুঁকিও। এখন আমাদের সীমানাকে বিশেষভাবে সুরক্ষিত করার জন্য চিন্তা করতে হবে। যেন তারা আমাদের মাটি বা সীমানা কোনোভাবে ব্যবহার করতে না পারে। আমাদের সব সময় মনে রাখতে হবে, বিদ্রোহীদের সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই, কোনো চুক্তি নেই। তারা বৈধ সরকারের দ্বারা পরিচালিত কেউ নয়। এখন আরাকান আর্মি সব কিছু দখল করে সরকার গঠন করবে কি-না সেগুলো দেখার বিষয় আছে। তারা যদি সরকার গঠনের শক্তি অর্জন করে, সরকার গঠনও করে— ফেলে সে ক্ষেত্রে যোগাযোগ স্থাপনে বাংলাদেশেরও ভূমিকার বিষয় আছে। সব সময় আমাদের দৃষ্টি রাখতে হবে শক্তি প্রয়োগের কোনো কিছু যদি আরাকান আর্মি করতে চায় তখন আমাদের আন্তর্জাতিক সহযোগিতার বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে।’
নিরাপত্তা বিশ্লেষক এয়ার কমোডর (অব.) ইশফাক ইলাহী চৌধুরী আমার সংবাদকে বলেন, ‘বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমারের যে সীমানা রয়েছে সেগুলো এখন আরাকান আর্মির দখলে। তাই বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ব্যবসা-বাণিজ্য এবং যাত্রী আসা-যাওয়ার বিষয়গুলো এখন সম্পূর্ণ বন্ধ থাকা আবশ্যক। কারণ এগুলো ইমিগ্রেশন বা কাস্টমস কোনো কিছুই এখন মিয়ানমার অংশে নেই। এর বাইরে যে এলাকা থাকবে সেখানে যোগাযোগ চলতে পারে। এই সংকটের একটি সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশের সীমান্তে অচলাবস্থা বিরাজ করবে এবং স্বাভাবিকভাবেই মিয়ানমারের সাথে ওই সীমান্ত এলাকা দিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য ও যোগাযোগ বন্ধ থাকবে। যতক্ষণ পর্যন্ত সেখানে মিয়ানমার সরকারের ব্যবসা ও ইমিগ্রেশন দেখার জন্য সরকারি কর্মকর্তা থাকবে, ততক্ষণ পর্যন্ত সীমান্ত খোলা থাকবে। এরপর পরিস্থিতি যদি ভেঙে পড়ে এবং কোনো কর্মকর্তা না থাকে তাহলে তো সীমান্তসহ সব কিছুই বন্ধ করে দিতে হবে।’
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক ড. আমেনা মহসিন আমার সংবাদকে বলেন, ‘দেখুন যত দিন পর্যন্ত মিয়ানমারের কেন্দ্রীয় সরকার রয়েছে তাদের সঙ্গেই আমাদের যোগাযোগ ও সম্পর্ক থাকবে। তাদের দেশের নিজস্ব সংঘাতের বিষয়ে আমরা তো কোনো হস্তক্ষেপ করতে পারি না। সেখানে এখন বিভিন্ন গোষ্ঠীর শক্তি প্রয়োগ চলছে। অনেকে শক্তি দেখিয়ে কিছু অবস্থান নিয়েছে শোনা যাচ্ছে। তবে তাদের সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। আমাদের কূটনৈতিক সম্পর্ক সে দেশের সরকারের সঙ্গে। যতক্ষণ পর্যন্ত আরাকান আর্মি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি না পাবে, ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। তবে এখন যেহেতু আরাকান আর্মি আমাদের সীমানার সঙ্গে মিয়ানমারের সীমানা রয়েছে, সেখানে তাদের অবস্থানে যেহেতু শক্তি বাড়ল— তাই বর্ডারে এখন সতর্কতার বিষয় আছে। কারণ আমাদের সঙ্গে বিদ্রোহীদের কোনো সম্পর্ক নেই। আমাদের সম্পর্ক সেই দেশের কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে।’
নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর (অব.) ইমদাদুল ইসলাম এ নিয়ে একটি বিশেষ লেখায় জানিয়েছেন, প্রয়োজনে এই মুহূর্তে বাংলাদেশের সীমান্ত সামরিকভাবে বন্ধ করে দেয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। কোনো বিদেশি নাগরিক বা আশ্রয়প্রার্থী বা আদিবাসীরা এসে যাতে আশ্রয় নিতে না পারে, সে অর্থে বন্ধ করে দেয়া নয়; বরং সীমান্তের ভেতরে নিরাপত্তা ঝুঁকি মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি থাকতে হবে। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী তাদের দখল হয়ে যাওয়া টহল চৌকি পুনরুদ্ধারে অভিযান শুরু করলে বাংলাদেশের ভেতরে এক ধরনের নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি করবে বলে মনে করেন তিনি। আর সেটি মোকাবিলায় বাংলাদেশকে প্রস্তুতি রাখতে হবে।