ফেব্রুয়ারি ১৭, ২০২৪, ১২:৩৩ এএম
দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানির জোগান অনিবার্য। টেকসই উন্নয়নে জ্বালানি খাতকে অগ্রাধিকার দিতে হয়। জ্বালানির পর্যাপ্ত জোগান না থাকলে শিল্পের চাকা থেমে যায়। স্থবির হয়ে পড়ে উন্নয়নযাত্রা। রাশিয়া-ইউক্রেন দ্বন্দ্বের পর প্রবল জ্বালানি সংকটের কবলে পড়ে দেশ। দুই বছরেও রেশ কেটে উঠতে পারেনি বিদ্যুৎ-জ্বালানি বিভাগ। বর্তমানে দৈনিক প্রায় এক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ঘাটতি থাকছে। তবে আসন্ন গ্রীষ্মে বড় লোডশেডিংয়ে ভোগান্তি পোহাতে হতে পারে সাধারণ মানুষকে।
বর্তমান সরকার শতভাগ বিদ্যুৎ নিশ্চিত করে বাহবা অর্জন করলেও চলমান পরিস্থিতিতে নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি সরবরাহে ব্যর্থ হচ্ছে। গত বছর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ এক অনুষ্ঠানে বলেন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের জন্য আগামী দুই বছর ঝুঁকিপূর্ণ। এই দুই বছর আমাদের ‘ব্যাঙলাফ’ দিয়ে এগোতে হবে। এদিকে দেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত বিপুল দেনা নিয়ে বিপাকে পড়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ। এক দিকে তারা টাকার অভাবে বেসরকারি কেন্দ্রগুলোকে বিদ্যুতের দাম যথাসময়ে দিতে পারছে না; অন্যদিকে মার্কিন ডলারের অভাবে বকেয়া রাখতে হচ্ছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের বিদেশি কোম্পানিগুলোর পাওনা। সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো থেকে পাওয়া হিসাবে, দেশে উৎপাদনরত বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) কাছে পাওনা প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা। পিডিবি বাংলাদেশ তেল, গ্যাস, খনিজসম্পদ কর্পোরেশনের (পেট্রোবাংলা) কাছে গ্যাস বিল বকেয়া রেখেছে প্রায় আট হাজার কোটি টাকা।
দেশে ডলার সংকট ও আন্তর্জাতিক বাজারে অসামঞ্জস্য জ্বালানির দামে কারণে গত দুই বছর ধরে এলএনজি, জ্বালানি তেল আমদানি করতে হিমশিম খাচ্ছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়। চাহিদা মতো জ্বালাতি তেল ও গ্যাসের জোগান দিতে পারছে না সরকার। ফলে শিল্পে উৎপাদন কমেছে অর্ধেকেরও কম। বাড়ছে লোডশেডিংয়ের আকার। চলতি সেচ মওসুমে বিদ্যুতে অতিরিক্ত দেড় থেকে দুই হাজার মেগাওয়াটে চাহিদা বেড়েছে। আগামী মাসে রোজ ও গ্রীষ্মে নিবরচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহে বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পর্যাপ্ত জ্বালানির মজুত না থাকলে বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে পড়বে দেশ। অর্থনীতিতে বড় দাগে ছন্দপতনের আশঙ্কা রয়েছে। তারা বলেন, আমরা নিজেদের দোষে বড় বিপদের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছি। দেশের সম্পদ গ্যাসে শুরুতে গুরুত্ব না দিয়ে উচ্চমূল্যে জ্বালানি আমদানি শুরু করেছিল সরকার। সেই থেকে আমরা বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে আমদানি-নির্ভর হয়ে পড়েছি। এতে দেশের অর্থনীতিকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেয়া হয়েছে। যদিও সরকার বলছে, জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকার বদ্ধপরিকর।
বিদ্যুৎ, শিল্পসহ অন্যান্য খাতের জ্বালানি চাহিদা মেটাতে আমদানি করা হচ্ছে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি), কয়লা ও জ্বালানি তেল। এসব খাতে প্রতি বছর ক্রমবর্ধমান হারে দেশে জ্বালানি চাহিদা বাড়ছে। সরকারের জ্বালানি ব্যয়ের প্রাক্কলন ধরে ব্যবসায়ীরা বলছেন, ২০৩০ সাল নাগাদ দেশে জ্বালানি আমদানিতে ব্যয় হবে ২৪ থেকে ৩০ বিলিয়ন ডলার। এ জন্য দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন ব্যবসায়ীরা। বিশ্বের দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির একটি বাংলাদেশের অর্থনীতি মূলত টেক্সটাইল এবং তৈরি পোশাক রপ্তানির ওপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ পোশাক রপ্তানিকারক দেশ। ক্রমবর্ধমান জ্বালানি সংকট যদি সঠিকভাবে মোকাবিলা না করা হয়, তবে তা দেশের পোশাক শিল্পের দক্ষ পরিচালনাকে প্রভাবিত করবে। শিল্পের কর্মীরা তাদের আন্তর্জাতিক ক্লায়েন্টদের সময়সীমা পূরণ করার জন্য একটি কঠোর সময়সীমার মধ্যে কাজ করে। এটি একটি শক্তি-নিবিড় শিল্প এবং দৈনিক ভিত্তিতে ঘন ঘন বিদ্যুৎ কাটার ফলে অনেক শিল্প জেনারেটরের ওপর নির্ভর করে যাতে কাজের প্রবাহ ব্যাহত না হয়, উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পায় এবং শেষ পর্যন্ত শিল্পের কার্যকারিতা প্রভাবিত করে।
এদিকে দেশে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয়ের বড় অংশই ব্যয় হয় বিদ্যুৎকেন্দ্রের জ্বালানি আমদানিতে। সূত্র থেকে জানা যায়, ২০২৭ সাল নাগাদ দেশে বিদ্যুৎকেন্দ্রের সক্ষমতা হবে গ্যাসভিত্তিক ১৬ হাজার ৬৫০ মেগাওয়াট, ফার্নেস অয়েলভিত্তিক ছয় হাজার ৪৯৭ মেগাওয়াট ও কয়লাভিত্তিক সাত হাজার ৯১ মেগাওয়াট। পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সক্ষমতা হবে দুই হাজার ৪০০ মেগাওয়াট। নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের উৎপাদন সক্ষমতা তৈরি হবে ৫৯১ মেগাওয়াট। আমদানি করা হবে দুই হাজার ৭৬০ মেগাওয়াট সক্ষমতার বিদ্যুৎ। এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের জ্বালানি চাহিদা ও বিদ্যমান বাজার দর হিসাব করলে জ্বালানি আমদানিতে ব্যয় বাড়বে ২০ বিলিয়ন ডলারের বেশি। এ অতিরিক্ত ব্যয়ের ছয়-সাত বিলিয়ন ডলার যাবে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর জন্য। এ ছাড়া কয়লায় পাঁচ বিলিয়ন এবং আমদানিনির্ভর বিদ্যুৎ, ফার্নেস অয়েল, নিউক্লিয়ার ফুয়েলের জন্য ব্যয় বাড়বে ৯ বিলিয়ন ডলার।
অর্থনৈতিক সমীক্ষা-২০২৩ অনুযায়ী, দেশে ২০২৫-২৬ অর্থবছর নাগাদ গ্যাসের চাহিদা দাঁড়াবে সাড়ে পাঁচ হাজার মিলিয়ন ঘনফুটের বেশি। বিদ্যমান গ্যাসের সরবরাহ সক্ষমতা রয়েছে তিন হাজার মিলিয়ন ঘনফুটের কিছু বেশি (এলএনজিসহ)। স্থানীয় গ্যাসের সরবরাহ একই পরিমাণ থাকলে দৈনিক আরো প্রায় আড়াই হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের ঘাটতি তৈরি হবে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতে আমরা বিভিন্ন সময় দীর্ঘ ও মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়েছি। কিন্তু সেগুলো ঠিকঠাকমতো কাজ করেছে কি-না তা পরীক্ষা করা হয়নি। জ্বালানি খাতে বিভিন্ন সময়ে উচ্চাভিলাষী ও অবাস্তব পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। এসব পরিকল্পনার বড় অংশজুড়েই ছিল আমদানি-নির্ভর জ্বালানি।
অর্থনীতির বিশ্লেষকরা বলছেন, গত অর্থবছরে জ্বালানির দাম সব কিছুকে প্রভাবিত করেছে। ব্যক্তি, হাউজহোল্ড, ব্যবসা, কৃষি— সব খাতেই জ্বালানির দামের প্রভাব পড়ে। জ্বালানির মূল্যই মূল্যস্ফীতির চাপ বাড়িয়েছে। জ্বালানি নিরাপত্তায় অনিশ্চয়তা তৈরি হওয়ায় ফিকে হচ্ছে দেশের অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোর সম্ভাবনা। ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) আওতায় ১০০ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য রয়েছে সরকারের। এসব অঞ্চলে স্থানীয় বিনিয়োগের পাশাপাশি বিদেশি বিনিয়োগের প্রত্যাশা রয়েছে। জাপান, ভারত ও চীনের জন্য পৃথক অর্থনৈতিক অঞ্চলের কার্যক্রমও কমবেশি এগিয়েছে। তবে বিদ্যমান জ্বালানি ও অর্থনৈতিক সংকটে বেজার উজ্জ্বল সম্ভাবনায় এখন চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন বলেন, যতদিন পর্যন্ত আমরা আমদানি-নির্ভর জ্বালানি থেকে বের হতে না পারব, ততদিন আমাদের অর্থনীতিতে যেসব সংকট চলছে, তা থেকে বেরিয়ে আসতে পারব না।
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘আমাদের যদি জ্বালানি কেনার ওপর নির্ভরশীলতা না থাকত তাহলে সংকট এত ভোগাতে পারত না। অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে উত্তোলন, উদ্ভাবনের দিকে আমরা নজর দেইনি। আমরা যে কিনব সেখানেও বৈদেশিক মুদ্রার সংকট। জ্বালানিভিত্তিক কার্যক্রমগুলো বন্ধ হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রার চাপের কারণে। জ্বালানির পুরো সরবরাহ চেইনে একক কোম্পানি হিসেবে বিপিসির একচেটিয়া কার্যক্রমও একটি সমস্যা।’
এফবিসিসিআইয়ের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু বলেন, ‘জ্বালানি যদি ঠিকমতো আনতে না পারি, বিদ্যুৎ যদি না থাকে, গ্যাস যদি না থাকে তাহলে তো উৎপাদন বাড়বে না। তখন কর্মসংস্থান কম হবে, প্রবৃদ্ধি কম হবে, ব্যাংক লোন ব্যবসায়ীরা শোধ করতে পারবেন না। তাই আমাদের মূল কাজ হবে জ্বালানি নিশ্চিত করা। এটি নিশ্চিত করতে হলে আমাদের পর্যাপ্ত ডলার নিশ্চিত করতে হবে।’
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. ম. তামিম মনে করেন, ‘বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রাথমিক জ্বালানি আমদানির অর্থ জোগান দিতে যে আমরা বিপদে পড়তে পারি, সেই আশঙ্কা আগেই ছিল। বিদ্যুৎ খাত নিয়ে আমাদের যে পরিকল্পনা, তাতে আমার হিসাব অনুযায়ী ২০৩০ সাল নাগাদ ৯০ শতাংশই আমদানি করা জ্বালানির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ার কথা।’ বুয়েটের এই অধ্যাপক আমার সংবাদকে জানান, আমাদের উচিত ছিল আমদানির পাশাপাশি নিজস্ব গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলন বাড়ানোর দিকে নজর দেয়া। ২০১৮ সালে আমরা এলএনজি আমদানি শুরু করেছি। তখন বলা হয়েছে, আমাদের নিজস্ব উৎপাদনে সময় লাগবে। এই যুক্তি দিয়ে আমরা সমান্তরালভাবে নিজেদের গ্যাস অনুসন্ধানের দিকে নজর না দিয়ে পুরোপুরি আমদানিনির্ভরতার দিকে ঝুঁকেছি।’
সম্প্রতি বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, ‘বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে তেল ও গ্যাসের সার্বিক মূল্য বৃদ্ধির ফলে জ্বালানি নিরাপত্তা স্থিতিশীল রাখা বেশ দুষ্কর। দেশীয় প্রাকৃতিক গ্যাস ও আইটিএফসি আগে থেকেই তেল আমদানিতে আমাদের সহযোগিতা করে আসছে। এখন তেলের পাশাপাশি গ্যাস ক্রয়েও সহযোগিতা করবে। প্রায় ৫০০ মিলিয়ন ডলার নিয়ে গ্যাস ক্রয় করা যাবে, যা আগামীতে সংকট নিরসনে অনেকটা সহায়তা করবে। তেল অনুসন্ধান এবং উত্তলোন কার্যক্রম বাড়ানোর পাশাপাশি তেল-গ্যাস সমৃদ্ধ দেশগুলোর সহযোগিতা নেয়ার উদ্যোগ অব্যাহত রয়েছে।’