ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০২৪, ০১:২৩ এএম
চলমান জ্বালানি সংকটের মধ্যেও সম্ভাবনার আলো জ্বালাচ্ছে ভোলার তিনটি গ্যাসক্ষেত্র। প্রায় ৩০ বছরের পুরোনো শাহবাজপুর গ্যাসফিল্ডের সঙ্গে নতুন আবিষ্কৃত দুই ক্ষেত্র থেকে দেড় ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস প্রাপ্তির সম্ভাবনা দেখছে সরকার। বাপেক্স কর্তৃক খননকৃত ভোলার নর্থ-২ গ্যাসকূপ থেকে দৈনিক ২০ মিলিয়ন বা দুই কোটি ঘনফুট গ্যাস মিলবে, যা শুধু ভোলা জেলায়ই নয়, দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
গত মার্চের শুরুতে ভোলা সদর উপজেলার পশ্চিম ইলিশা ইউনিয়নে মালের হাটসংলগ্ন এলাকায় বাপেক্সের নকশা ও নির্দেশনা অনুযায়ী রাশিয়ার প্রতিষ্ঠান গ্যাজপ্রম খননকাজ শুরু করে। প্রায় চার কিলোমিটার বিস্তৃত এলাকায় গত ২৪ এপ্রিল প্রাথমিকভাবে গ্যাসের সন্ধান পেলে খনন শেষে অন্যান্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু হয়। এরপর গত ২৮ এপ্রিল কূপের মুখে আগুন জ্বালিয়ে সেখানে প্রথম গ্যাসের অস্তিত্ব মিললে তিনটি স্তরে পরীক্ষা করে গ্যাসের অস্তিত্ব ও মজুতের পরিমাণ নিশ্চিত হয় বাপেক্স। এর আগে ভোলায় আরও দুটি গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার হয়েছে। ওই দুটি হলো শাহবাজপুর ও ভোলা নর্থ গ্যাসক্ষেত্র।
ভূতত্ত্ববিদদের মতে, দ্বীপ জেলাটিতে আরও গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনার ইঙ্গিত রয়েছে। এই প্রেক্ষিতে ভোলার আরও কিছু এলাকায় এবং সংলগ্ন মেঘনা নদীতে গ্যাস অনুসন্ধানের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অদূর ভবিষ্যতে ভোলার গ্যাস জাতীয় অর্থনীতিতে নবজাগরণ সৃষ্টি করবে।
ভোলায় বর্তমানে তিনটি গ্যাসক্ষেত্রের (শাহবাজপুর, ভোলা নর্থ ও ইলিশা) প্রমাণিত মজুত প্রায় এক হাজার ৪৩৩ বিসিএফ (বিলিয়ন ঘনফুট)। এ পর্যন্ত উত্তোলিত গ্যাসের পরিমাণ ১৪৫ বিসিএফ। দেশে বর্তমানে মজুত থাকা আট দশমিক ৪৬ ট্রিলিয়ন ঘনফুট (টিসিএফ) গ্যাসের ১৫ শতাংশের বেশি বিদ্যমান দ্বীপজেলাটির তিন গ্যাসক্ষেত্রে।
ভোলায় আবিষ্কৃত তিনটি গ্যাসক্ষেত্রের ৯টি কূপের মোট গ্যাস উৎপাদন ক্ষমতা দৈনিক ১৮০ মিলিয়ন ঘনফুট (এমএমসিএফ)। তবে চাহিদা না থাকায় বর্তমানে শুধু শাহবাজপুর গ্যাসক্ষেত্র থেকে দৈনিক উৎপাদন করা হচ্ছে ৮০ থেকে ৮৫ মিলিয়ন ঘনফুট; যা স্থানীয় তিনটি বিদ্যুৎকেন্দ্র, কিছু শিল্পকারখানা ও বাসাবাড়ির রান্নার কাজে সরবরাহ করা হচ্ছে।
পর্যাপ্ত গ্যাস পাওয়া গেলে ঘোলাশার ও আশুগঞ্জের মতো সার কারখানা করার চিন্তা করছেন জনপ্রতিনিধিরা। এর ফলে বাইরে থেকে আর ভোলায় সার আমদানি করতে হবে না। বর্তমানে দেশে সারের চাহিদা ২৭ লাখ মেট্রিক টন। এর মধ্যে ১৬ লাখ টনই আমদানির ওপর নির্ভর করতে হয় প্রতিবছর। এর ফলে ডলার সাশ্রয় হবে এবং দেশের মানুষের কর্মসংস্থানও সৃষ্টি হবে।
এদিকে সারা দেশে গ্যাস সংকটে হাহাকার করছেন ব্যবসায়ীরা। এমন অবস্থায় ভোলার গ্যাস জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করতে পাইপলাইন নির্মাণের পথে হাঁটছে জ্বালানি বিভাগ। এই গ্যাস যাবে বরিশাল ও পটুয়াখালীতে। ভবিষ্যতে গ্যাসের ফ্লো আরও বাড়তে পারে বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা। ভোলার পাইপলাইনে ইতোমধ্যে প্রিভিজিবল একটা স্টাডি করেছে জ্বালানি বিভাগ।
প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, ভোলার গ্যাসের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করাই সরকারের লক্ষ্য। এখান থেকে উত্তোলিত গ্যাসের একটি অংশ দিয়ে তিনটি বিদ্যুৎকেন্দ্র চলছে। চাহিদা অনুযায়ী শিল্প-কারখনা ও কিছু আবাসিক সংযোগে গ্যাস দেয়া হচ্ছে। এরপরও গ্যাস উদ্বৃত্ত থেকে যাচ্ছে। দৈনিক পাঁচ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সিএনজি (রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস) করে ঢাকায়, বিশেষ করে যেখানে শিল্পে গ্যাসস্বল্পতা আছে, সেখানে সরবরাহ করা হচ্ছে উল্লেখ করে প্রতিমন্ত্রী বলেন, পর্যায়ক্রমে তা ২৫ মিলিয়ন ঘনফুটে উন্নীত করা হবে।
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রোডাকশন কোম্পানি লিমিটেড (বাপেক্স) সূত্র জানায়, ভোলা নর্থ ও ইলিশা গ্যাসক্ষেত্রের তিনটি উৎপাদনক্ষম গ্যাসকূপ হতে গ্যাস উৎপাদনের জন্য ৬০ মিলিয়ন ঘনফুটের আরও একটি প্রসেস প্লান্ট স্থাপন কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন।
পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার জানিয়েছেন, প্রতিদিন দেশে গ্যাসের চাহিদা আছে প্রায় চার হাজার মিলিয়ন ঘনফুটের মতো। আর সরবরাহ হচ্ছে তিন হাজার মিলিয়ন ঘনফুটের নিচে। এর মধ্যে দেশীয় গ্যাসক্ষেত্র থেকে পাই ২১০০ মিলিয়নের মতো, আর আমদানি করা হচ্ছে কম-বেশি ৮০০ মিলিয়নের মতো। ২০৪১ সালের পরিকল্পনা অনুযায়ী দেশে দুটি এলএনজি টার্মিনাল চালু হবে।
ব্যাপক নগরায়ণ ও শিল্পায়নের কারণে দেশে গ্যাসের চাহিদা অনেক বেড়েছে বলে মন্তব্য করেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও ভূতত্ত্ববিদ ড. বদরূল ইমাম। তিনি বলেন, দেশীয় গ্যাসের সরবরাহ ঘাটতি বিদেশ থেকে আমদানি করা এলএনজি দিয়ে পূরণ করার উদ্যোগ দুটি কারণে সফল হতে পারছে না।
প্রথমত, এলএনজি উচ্চমূল্যের জ্বালানি। প্রয়োজনীয় এলএনজি আমদানি করার জন্য যে অর্থ প্রয়োজন, সেখানে আমাদের সক্ষমতার অভাব রয়েছে। দ্বিতীয়ত, দেশে এলএনজি এনে তা গ্যাসে রূপান্তরিত করার পর্যাপ্ত টেকসই ব্যবস্থাপনার ঘাটতি রয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপক আরও বলেন, বাংলাদেশকে গ্যাসকূপে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড বজায় রাখতে হলে উন্নততর কারিগরি ব্যবস্থাপনার ওপর জোর দিতে হবে।
প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদবিষয়ক উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বীর বিক্রম বলেন, দেশে বর্তমানে গ্যাসের বেশ সংকট রয়েছে। যেসব এলাকায় গ্যাসের সমস্যা বেশি, সেখানে ভোলার গ্যাস সরবরাহ করা হবে। তিনি বলেন, সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ আসবে, সেভাবে ব্যবস্থাও নেয়া যাবে। বর্তমান সমস্যার উৎস আমরা নই— ইউরোপে শুরু হয়েছে; ফলে জ্বালানির দাম বেড়ে গেছে, সারের দাম বেড়ে গেছে আর আমরা দুর্ভোগের শিকার হচ্ছি।