Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৪,

শ্রবণ ব্যামোয় ট্রাফিক পুলিশ

আব্দুল কাইয়ুম

আব্দুল কাইয়ুম

ফেব্রুয়ারি ২৪, ২০২৪, ০১:১৮ এএম


শ্রবণ ব্যামোয় ট্রাফিক পুলিশ
  • যানবাহন ৮০ শতাংশ তৈরি করে
  • ৩৩.৯ শতাংশের শুনতে কষ্ট হয়
  • আইন থাকলেও নেই প্রয়োগ 
  • চোখের সমস্যায়ও ভুগছে 
  • পাচ্ছে না বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা
  • যে কোনো দুর্ঘটনা ও শারীরিক অসুস্থতার জন্য ডিএমপি থেকে সহযোগিতা করা হয় 
    —মো. মুনিবুর রহমান, অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক), ডিএমপি
  • তিন ঘণ্টার বেশি একই স্থানে দায়িত্ব পালন না করা ও নিয়মিত শ্রবণশক্তি পরীক্ষা করা উচিত 
    —ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার, চেয়ারম্যান, ক্যাপ

১৬ বছর ধরে ট্রাফিকের দায়িত্ব পালন করছেন মাজিদুল ইসলাম (ছদ্মনাম)। প্রতিদিন একনাগাড়ে আট ঘণ্টা দায়িত্ব পালন করেন তিনি। কিন্তু ট্রাফিকের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে শব্দদূষণের কারণে প্রায় ১৫ বছর ধরে কানে কম শুনছেন। তার সাথে এ বিষয়ে কথা বললে আমার সংবাদকে বলেন, ট্রাফিকের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে শব্দদূষণের কারণে কানে কম শুনতে পাই। বহু বছর ধরে এই সমস্যায় ভোগছি। অনেকবার ডাক্তার দেখিয়েও কোনো সমাধান হয়নি। ডাক্তার বলেছেন, আমি কখনোই আগের মতো শুনতে পারব না। শুধু কানে নয়, চোখের সমস্যায়ও ভোগছেন বলে জানান তিনি। রাস্তার ধুলাবালি ও বিভিন্ন কারণে চোখে কম দেখেন। কানে কম শুনার কারণে সমাজে চলতে গিয়ে নানা বিভ্রান্তিমূলক পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়। 

তিনি আরও বলেন, আমরা ভালোভাবে বাঁচতে চাই। শব্দদূষণের আইন প্রয়োগ থাকলে কিছুটা কমে আসবে। শুধু আমার নয়, প্রায় ৪৫ শতাংশ ট্রাফিক সদস্য কম শুনার সমস্যায় ভোগছেন। ট্রাফিক দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সমস্যা হলে সরকারিভাবে কোনো চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই বলেও জানান তিনি। অথচ দায়িত্বের কারণে কোনো পুলিশ সদস্যা ক্ষতিগ্রস্ত হলে বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা থাকার কথা। অ্যাম্বুলেন্সের বিকট শব্দে বেশি সমস্যা হয় বলেও জানান তিনি। মামুন নামে আরেক ট্রাফিক পুলিশের সাথে কথা বললে তিনি আমার সংবাদকে বলেন, আমি ট্রাফিকে যুক্ত হয়েছি মাত্র এক বছর হয়। ইতোমধ্যে আমার কানে সমস্যা তৈরি হয়েছে। অন্যদের তুলনায় অনেক কম শুনি। এভাবে চলতে থাকলে কিছু দিন পর হয়তো একেবারে শুনতে পারব না। তা ছাড়া শব্দদূষণে মেজাজ খিটখিটে হয়ে থাকে, ফলে পারীবারিক জীবনেও তার প্রভাব পড়েছে। রাতে ঘুমাতেও পারি না। সব সময় মাথার ভেতর ভনভন শব্দ হয়। মাথাব্যথার মতো অসুস্থতাও প্রতিনিয়ত বয়ে বেড়াচ্ছি। 

বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) গবেষণায় দেখা যায় যে, পেশাগত  দায়িত্বে থাকা ডিএমপি ট্রাফিক বিভাগের ১১ দশমিক ৮ শতাংশ সদস্যের শ্রবণশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং ৩৩ দশমিক ৯ শতাংশ ট্রাফিক পুলিশের অন্যদের কথা শুনতে কষ্ট হয়। শব্দদূষণে ১১ দশমিক ৮ শতাংশ ট্রাফিক পুলিশের শ্রবণশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ১৫ দশমিক ৫ শতাংশ ট্রাফিক পুলিশ জানায় সাধারণভাবে মোবাইলে কথা শুনতে তাদের অসুবিধা হয়। ১৯ দশমিক ১ শতাংশ ট্রাফিক পুলিশ ঘরের অন্য সদস্যদের তুলনায় বেশি ভলিউম দিয়ে তাদের টিভি দেখতে হয়। অপরদিকে ৩৩ দশমিক ৯ শতাংশ ট্রাফিক পুলিশ অন্যরা উচ্চস্বরে কথা বললে শুনতে পান নয়তো শুনতে কষ্ট হয়।

ক্যাপসের গবেষণায় দেখা যায়, ৮ দশমিক ২ শতাংশ ট্রাফিক পুলিশ কয়েক ঘণ্টা দায়িত্ব পালনের পর তারা ঘূর্ণিরোগ মাথা ভনভন করা, বমি বমি ভাব ও ক্লান্তির সমস্যায় ভোগেন। কানে কম শুনা ছাড়াও বধিরতা, হূদরোগ, মেজাজ খিটখিটে হওয়াসহ নানা রকম সমস্যা দেখা যায়। স্বল্পমেয়াদি শব্দদূষণ মানসিক চাপ সৃষ্টি করে। আবার, দীর্ঘমেয়াদি শব্দদূষণ শ্রবণশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত করে। শ্রবণশক্তি হ্রাসের ফলে বিরক্তি, নেতিবাচকত, রাগ, ক্লান্তি, চাপা উত্তেজনা, মানসিক চাপ, বিষণ্নতা, সামাজিক কর্মকাণ্ড পরিহার, ব্যক্তিগত ঝুঁকি বাড়া এবং স্মৃতিশক্তি ও নতুন কিছু শেখার ক্ষমতা হ্রাস পায়।

যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর অকুপেশনাল সেফটি অ্যান্ড হেলথ ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ৮৫ ডেসিমেল শব্দের সর্বোচ্চ অনুমোদনীয় স্থিতিকার প্রতিদিন আট ঘণ্টা। ১০০ ডেসিবল শব্দের সর্বোচ্চ অনুমোদনীয় স্থিতিকার প্রতিদিন ১৫ মিনিট এবং ১২০ ডেসিবল শব্দের সর্বোচ্চ অনুমোদনীয় স্থিতিকার প্রতিদিন ৯ সেকেন্ড। ১২০ ডেসিমেল শব্দের শব্দ সম্পূর্ণ বধিরতা সৃষ্টি করতে পারে। আমাদের দেশে শব্দদূষণের ৮০ শতাংশ হয় যানবাহন থেকে। আর যানবাহনের হর্ন কিন্তু ট্রাফিক পুলিশের কানের দুই কিংবা তিন ফুটের মধ্যে বাজে। এ কারণেই ট্রাফিক পুলিশের শ্রবণশক্তি বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার আমার সংবাদকে বলেন, শব্দদূষণ একটি নীরব ঘাতক। শব্দদূষণ সম্পর্কে নিজেদের ও অন্যকে সচেতন হতে হবে। শব্দদূষণ নিরসনে যথাযথ কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ একান্ত জরুরি। শব্দদূষণের এই ভয়াবহ ক্ষতি থেকে বাঁচতে ট্রাফিক পুলিশদেরকে সর্বপ্রথম এর স্বাস্থ্যঝুঁকি সম্পর্কে জানতে হবে। নিয়মিত শ্রবণশক্তি পরীক্ষা করা উচিত। কোনো এলাকায় একটানা তিন ঘণ্টার বেশি দায়িত্ব পালন না করা। তিন ঘণ্টা পর পর নীরব এলাকায় গিয়ে দায়িত্ব পালন করা উচিত। উচ্চ শব্দযুক্ত স্থানে দায়িত্ব পালন করার সময় ইয়ার মাফ বা ইয়ার প্লাগ ব্যবহার করা জরুরি।  

তিনি আরও বলেন, ট্রাফিকদের বসার জন্য পুলিশ বক্স থাকলেও নেই পর্যাপ্ত সুবিধা। সরকার তাদের জন্য বিনামূল্যে স্বাস্থ্য পরীক্ষার ব্যবস্থা করেছে কিন্তু সবাই পাচ্ছে না। শব্দদূষণ রোধকল্পে সরকার শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা-২০০৬ বাস্তবায়ন জরুরি। সরকার ২০২২ সালে নতুন ট্রাফিক আইন প্রণয়ন করে নিষিদ্ধ স্থানে হর্ন বাজানোর শাস্তি হিসেবে তিন মাসের জেল অথবা ১৫ হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় নির্ধারণ করে যথাযথ প্রয়োগ করতে হবে। নির্মাণকাজে ব্যবহূত যন্ত্রপাতি থেকে উৎপন্ন শব্দ, বিভিন্ন শিল্প ও কলকারখানা থেকে উৎপাদিত শব্দ, বিভিন্ন প্রচারণায় কাজে ব্যবহূত মাইক ও লাউড স্পিকারের শব্দ, বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বা উৎসবে ব্যবহূত স্পিকারের শব্দ এবং ধর্মীয় উৎসব, ওয়াজ, রাজনৈতিক সভা ও প্রচারণায় ব্যবহূত মাইকের শব্দ ইত্যাদিও শব্দদূষণের অন্যতম প্রধান কারণ। 

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) ট্রাফিকের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মো. মুনিবুর রহমান আমার সংবাদকে বলেন, ট্রাফিকে কাজ করা পুলিশ সদস্যদের নিয়ে আমরা কাজ করছি। শব্দদূষণের কারণে তারা তুলনামূলক কম শুনতে পান, বিষয়টি খুবই দুঃখজনক। তাদের যেকোনো সমস্যা অর্থাৎ যেকোনো দুর্ঘটনা, শারীরিক অসুস্থতা বা অন্যান্য সব কিছুর জন্য আমাদের পক্ষ থেকে সহযোগিতা করা হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে আমাদের কিছু হাসপাতাল ও সরকারি হাসপাতালে সম্পূর্ণ বিলামূল্যে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। সাধারণত তাদের খরচ সরকার বহন করে। যদি কোনো কারণে বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে হয় সে ক্ষেত্রে তাকেই বহন করতে হবে। শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে আইনগত যত পদক্ষেপ আছে আমরা তা নেয়ার চেষ্টা করছি। ট্রাফিক পুলিশরা চাকরি শেষে অবসরে গেলেও তাদের জন্য চিচিৎসার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
 

Link copied!