Amar Sangbad
ঢাকা সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০২৪,

ঐতিহাসিক ভাষণের সাক্ষী ‘কলরেডি’

সাহিদুল ইসলাম ভূঁইয়া

সাহিদুল ইসলাম ভূঁইয়া

মার্চ ৭, ২০২৪, ০৪:৪৯ পিএম


ঐতিহাসিক ভাষণের সাক্ষী ‘কলরেডি’

বিয়েবাড়ি, উৎসব, কনসার্টসহ রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ মাইক ও সাউন্ড সিস্টেম ছাড়া যেন চলেই না। ঢাকায় এই মাইক সার্ভিস ১৯৪৮ সালে প্রথম নিয়ে আসে কলরেডি। মাইক যারা ভাড়া করবেন তারা কল করলেই যেন তাদের প্রতিষ্ঠান রেডি থাকে এই ভাবনা থেকেই কলরেডি নামকরণ। 

অর্থাৎ কল করলেই মুহূর্তে মাইক পৌঁছে যাবে। ১৯৪৮ সালে ঢাকা এই মাইক প্রথম নিয়ে আসেন পুরান ঢাকার হরিপদ ঘোষ ও দয়াল ঘোষ নামে দুই ভাই। এরপর থেকে দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে স্মরণীয় অধ্যায় হয়ে ওঠে কলরেডি। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে, ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৬৬ সালের ছয় দফা, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান এবং ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের সভা-সমাবেশে এই প্রতিষ্ঠানের মাইক্রোফোনের সামনে অগ্নিঝরা বক্তৃতা করেছেন দেশবরেণ্য রাজনীতিকরা। বি

দেশিদের মধ্যে কলরেডির মাইক্রোফোনের সামনে কথা বলেছেন দক্ষিণ আফ্রিকার অবিসংবাদিত নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা, ভারতের ইন্দিরা গান্ধী, ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি, যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন প্রমুখ। দেশের রাজনৈতিক ব্যাক্তিত্বের মধ্যে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক এবং জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ। তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে কলরেডি মাইক সার্ভিসের মাইকে ঐতিহাসিক ভাষণের এক পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। এই ভাষণ শুনে সাত কোটি বাঙালি নিজেদের যোদ্ধা হিসেবে তৈরির শক্তি পেয়েছিল। যে ভাষণ জাতির মুক্তির স্বপ্নে জড়িয়ে আছে। আর সেই ভাষণের সঙ্গে ইতিহাসের অংশ হয়ে আছে কলরেডি। প্রতিষ্ঠানটি সেদিন রেসকোর্স ময়দানের জনসভায় সাউন্ড সিস্টেমের দায়িত্ব পালন করে। কলরেডির ইতিহাস থেকে জানা যায়, হরিপদ ঘোষ ও দয়াল ঘোষ নামে দুই ভাই, পুরান ঢাকায় ব্যবসা করার সিদ্ধান্ত নেন। বাবার ইচ্ছে ছিল দুই সন্তান ইসলামপুরে কাপড়ের পাইকারি দোকান দেবেন। কিন্তু পুরান ঢাকায় তখন কাপড়ের দোকানের ছড়াছড়ি থাকায় তাদের আগ্রহ ছিল না এ ব্যবসায়। তখন দুই ভাই সিদ্ধান্ত নেন বাতি ও লাইটের ব্যবসা করবেন। পুরান ঢাকার মানুষ আলোকসজ্জা পছন্দ করে, বেশ ভালো চলবে। এরপর দুজন ১৯৪৮ সালে ‘আরজু লাইট হাউস’ নামে একটি দোকান চালু করেন। দোকানের প্রথম গ্রাহক ছিলেন স্থানীয় শ্যামলকান্তি বড়াল। তখনকার অগ্রিম তিন টাকা দিয়ে তিনি বিয়েবাড়ির আলোকসজ্জার দায়িত্ব দিয়ে যান দুই ভাইকে।

কিন্তু সমসাময়িক আরও অনেক দোকান গড়ে ওঠায় শঙ্কায় পড়েন তারা। এমন সময় বুদ্ধি খাটিয়ে লাইটের পাশাপাশি ব্যবসায় সাউন্ড সিস্টেম যুক্ত করার কথা চিন্তা করেন হরিপদ ঘোষা। শুরুতে তারা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গ্রামোফোন ভাড়া ও আলোকসজ্জার কাজ করতেন। চাহিদা দিন দিন বাড়তে লাগল। প্রথম দিকে ভারত থেকে কয়েকটি মাইক নিয়ে এসে এবং নিজেরাই হ্যান্ড মাইক তৈরি করে বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও সভা-সমাবেশে ভাড়া দেয়া শুরু করেন। কিন্তু এক সময় চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় চীন, তাইওয়ান ও জাপানসহ অন্যান্য দেশ থেকেও মাইক আনতে হয় দুই ভাইকে। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির দায়িত্বে আছেন সাগর ঘোষ, রানা ঘোষ, বিশ্বনাথ ঘোষ ও শিবনাথ ঘোষ। তারা চার ভাই। প্রতিষ্ঠানেই সাগর ঘোষের সাথে দেখা। সাগর ঘোষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে দেখেননি। তবে বাবা হরিপদ ঘোষের মুখে অনেক গল্প শুনেছেন। বঙ্গবন্ধু হরিপদকে স্নেহ করে ‘পাগলা’ ডাকতেন, বলেন সাগর ঘোষ। পুরান ঢাকার বিউটি বোর্ডিং কিংবা তার আশপাশে এলে বঙ্গবন্ধু হরিপদের খোঁজখবর নিতেন বলে ছেলে সাগর ঘোষকে জানিয়েছেন তার বাবা।

৭ মার্চ, ১৯৭১ সালের ভাষণের আগের ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলে সাগর ঘোষ জানান, ৭ মার্চের আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ধানমন্ডির বাসভবনে হরিপদ ঘোষ ও দয়াল ঘোষকে ডেকে নেন। তিনি রেসকোর্স ময়দানে মাইক লাগানোর নির্দেশ দেন। এ সময় দুই ভাই জানতে চান কত মাইক লাগাতে হবে? বঙ্গবন্ধু সেদিন সংখ্যাটি বলেননি। উদীপ্ত কণ্ঠে নির্দেশ দেন— যত পারো তত, বলেন সাগর ঘোষ। এরপর একশর অধিক মাইক লাগানো হয় জনসমাবেশ স্থলে। সমাবেশের তিন দিন আগে থেকেই রাতের আঁধারে মাইকগুলো প্রস্তুত রাখার কাজ শুরু করে কলরেডি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও কিছু মাইক মজুত রাখা হয়। সে সময় পাকিস্তানি শাসকের ভয় উপেক্ষা করে কাজ করেছিল ঐতিহাসিক এ প্রতিষ্ঠানটি। ‘ইতিহাসের অংশ আমাদের এই প্রতিষ্ঠান। খুব গর্ব হয়। বঙ্গবন্ধু আমাদের মাইকে কথা বলে যুদ্ধের ডাক দিয়েছেন— এর চেয়ে গর্বের আর কী হতে পারে!

 

Link copied!