Amar Sangbad
ঢাকা সোমবার, ১৮ নভেম্বর, ২০২৪,

বুয়েটে ছাত্ররাজনীতির পক্ষে হাইকোর্টের আদেশ

বুয়েটে ফিরছে ছাত্ররাজনীতি

মো. নাঈমুল হক

এপ্রিল ২, ২০২৪, ১১:৩৬ এএম


বুয়েটে ফিরছে ছাত্ররাজনীতি

আদালতের আদেশ শিরোধার্য 
—বুয়েট উপাচার্য

বুয়েটে রাজনীতি ফিরবে জানলে ভর্তি হতাম না 
—আবরার ফাইয়াজ, আবরার ফাহাদের ভাই

রাজনীতি নিষিদ্ধে শিক্ষার্থী শিক্ষকদের পাশে চান শিক্ষার্থীরা

টেন্ডারবাজি চাঁদাবাজি, ফাও খাওয়া, ছাত্র হয়ে ছাত্র টর্চারের রাজনীতি বন্ধ হোক 
—কামরুল হাসান মামুন অধ্যাপক, ঢাবি

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) ছাত্র রাজনীতি স্থগিত করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের দেয়া জরুরি বিজ্ঞপ্তির আদেশ স্থগিত করেছেন হাইকোর্ট। এর ফলে দেশের শীর্ষ এ প্রকৌশল প্রতিষ্ঠানে ছাত্ররাজনীতি চলতে বাধা নেই। আদালতের এমন সিদ্ধান্তের পর সংবাদ সম্মেলন করেছেন বুয়েটের শিক্ষার্থীরা। ক্যাম্পাসে নিরাপদ পরিবেশ বজায় রাখার জন্য ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ চান তারা। এই দাবিতে শিক্ষকদেরও পাশে থাকার আহ্বান জানিয়েছে শিক্ষার্থীরা। আদালতে সিদ্ধান্তের পরই নিজে অবস্থান জানিয়েছেন বুয়েটের উপাচার্য। তিনি বলেন, আদালত যেটা বলবেন, আমাকে সেটিই মানতে হবে। তবে শিক্ষাবিদরা মনে করেন, শিক্ষার্থীদের জন্য ছাত্র রাজনীতি হওয়া উচিত। টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, ফাও খাওয়া, ছাত্র হয়ে ছাত্রদের টর্চারের রাজনীতি বন্ধ হোক। 

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করে জারি করা বিজ্ঞপ্তি স্থগিত করেছেন হাইকোর্ট। এর ফলে বুয়েটে রাজনীতি চলতে বাধা নেই বলে জানিয়েছেন আইনজীবীরা। একইসঙ্গে রুল জারি করেছেন আদালত। এ সংক্রান্ত রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে গতকাল সোমবার বিচারপতি মো. খসরুজ্জামান ও বিচারপতি কে এম জাহিদ সারওয়ার কাজলের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এসব আদেশ দেন। আদালতে রিটের পক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট শাহ মঞ্জুরুল হক। এর আগে সকালে বুয়েটের শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগ নেতা ইমতিয়াজ রহিম রাব্বি রিটটি দায়ের করেন। রিটকারীর আইনজীবী হলেন ব্যারিস্টার হারুনুর রশিদ। রিটে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সচিব, বুয়েটের ভিসিসহ সংশ্লিষ্টদের বিবাদী করা হয়।

২০১৯ সালে বুয়েটের তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক ড. সাইফুল ইসলাম ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করেন। তখন তিনি জানান, নীতিমালা অনুযায়ী শিক্ষক রাজনীতিরও সুযোগ নেই। এদিকে ছাত্র রাজনীতিমুক্ত ক্যাম্পাসের দাবিতে পরীক্ষা বর্জনসহ আন্দোলন করেছেন বুয়েটের শিক্ষার্থীরা। তবে অনতিবিলম্বে বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি ফেরাতে আল্টিমেটাম দিয়েছেন ছাত্রলীগ সভাপতি সাদ্দাম হোসেন। পাশাপাশি বুয়েট শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতা ইমতিয়াজ হোসেন রাহিম রাব্বির হলের সিট ফিরিয়ে দেয়ার দাবি জানিয়েছেন তিনি। রোববার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সমাবেশে এ আল্টিমেটাম দেয়া হয়।

ছাত্র রাজনীতির পক্ষে আদালতের রায় পাওয়ার পরই বিকেলে সংবাদ সম্মেলন করেন বুয়েটের সাধারণ শিক্ষার্থীরা। এ ব্যাপারে বুয়েটের শিক্ষার্থীরা বলেন, আমরা বিচার ব্যবস্থার প্রতি পূর্ণ আস্থা রাখি। বুয়েট ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকার পরও ২৮ মার্চ মধ্যরাতে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ক্যাম্পাসে এলে এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিমালা লঙ্ঘন হয়। ৭ অক্টোবর আবরার ফাইয়াজকে হত্যার পর ৯ অক্টোবর গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, অনেকগুলো প্রতিষ্ঠানেই তো ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ আছে। বুয়েটে যদি মনে করে ছাত্র রাজনীতি থাকবে না, তাহলে সেখানে রাজনীতি থাকবে না। এরপর শিক্ষার্থীদের দাবির প্রেক্ষিতে বুয়েট প্রশাসন সব প্রকার রাজনীতি ক্যাম্পাস থেকে নিষিদ্ধ করে। রাজনীতি বন্ধের ব্যাপারে শিক্ষার্থীরা বলেন, ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি না থাকার ব্যাপারে আমরা ঐক্যবদ্ধ। যে ছাত্র রাজনীতি ক্যাম্পাসে র্যাগিং কালচার তৈরি করে। যার বলি হতে হয় সাধারণ শিক্ষার্থীদের। এটি আমাদের জন্য ভালো কিছু বয়ে আনেনি ও আনবেও না। এর চরমতম দৃষ্টান্ত হলো বুয়েটের সাবিকুন্নাহার সনি ও আবরার ফাহাদ। ছাত্র রাজনীতিবিহীন বুয়েটের পরিবেশ ছিল নিরাপদ ও শিক্ষার্থীবান্ধব। মৌলবাদী শক্তিকেও আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিরোধ করতে পারি।

শিক্ষকদের পাশে চেয়ে শিক্ষার্থীরা বলেন, বর্তমান শিক্ষকরা আমাদের অভিভাবক। আমরা তাদের কাছ থেকে কখনোই এমনটি অনুভব করিনি যে, তারা চান ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি থাকুক। তারা সবসময় আমাদের সঙ্গেই ছিলেন। আমরা আমাদের সব শিক্ষকের কাছে আর্জি জানাচ্ছি, তারা যেন এমন সংকটের সময় আমাদের পাশে থাকেন। আমরা ভিসি স্যারের উপর আস্থা রাখি। তিনি সবসময় আমাদের পক্ষেই ছিলেন। গত তিন দিনও তিনি আমাদের সাথে দেখা করে গেছেন। সব শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর রাজনীতি মুক্ত ক্যাম্পাসের যে আকাঙ্ক্ষা সেটি যেন তারা পূরণ করেন। 

বুয়েটের ছাত্র রাজনীতি ফেরায় আতঙ্কের কথা জানিয়ে আবরার ফাহাদের ভাই আবরার ফাইয়াজ আমার সংবাদকে বলেন, বুয়েটে আবরার ফাহাদ ভাইকে হত্যার পরই ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়। আবরার ভাইকে হত্যার পর যখন ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ হয়, তখন শিক্ষার্থীরা ভেবেছে দেশে বিচার আছে। যেকোনো কাজে তারা প্রতিবাদ করতে সাহস দেখিয়েছে। কিন্তু হঠাৎ উচ্চ আদালতের এ রায়ে আমরা অবাক হয়েছি। এখন আর কাউকে নির্যাতন করা হলে কেউ সাহস দেখাতে পারবে না। ছাত্র রাজনীতি ফিরবে এমনটি জানলে বুয়েটে ভর্তি হতাম না।

হাইকোর্ট স্থগিত করার পর বুয়েট উপাচার্য সত্য প্রসাদ মজুমদার গণমাধ্যমে বলেছেন, আদালত যেটি বলবেন, আমাকে সেটি মানতে হবে। আদালতের আদেশ শিরোধার্য। আমরা আদালত অবমাননা করতে পারব না। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, রাজনীতির পরিবেশ ঠিক রাখার জন্য শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও প্রশাসন— সবাই মিলে একটি রূপান্তর করতে হবে। কীভাবে সেটি করা যায়, তা আলোচনার মাধ্যমে বের করতে হবে। বর্তমানে ইউকসুর (ছাত্র সংসদ) কার্যক্রম বন্ধ আছে। সব পক্ষের মতামত নিয়েই একটা কিছু করতে পারবেন তারা। তিনি একা কিছু করলে, তা বাস্তবায়ন করা যাবে না। সেটি সিন্ডিকেটে অনুমোদিত হতে হবে, অর্ডিন্যান্সে যুক্ত হতে হবে। রাষ্ট্রপতি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলরের অনুমোদন নিতে হবে। তা না হলে এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্ডিন্যান্সে ঢুকবে না। তাদের সীমাবদ্ধতা আছে। তারা আদালতের আদেশ পালন করেন। বিশ্ববিদ্যালয় তার নিয়মে চলে। 

কিন্তু আদালতের আদেশ শিরোধার্য। ছাত্রদের নিয়ে রাজনীতি দেখেন না জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. কামরুল হাসান মামুন আমার সংবাদকে বলেন, অন্ধকারের রাজনীতি ঢুকে আমাদের দেশে ক্ষমতাকেন্দ্রিক ছাত্র রাজনীতি হয়েছে। তারা তাদের দলের আদর্শ ছড়িয়ে দিতে রাজনীতি করে না। নিজের দল ক্ষমতায় থাকা মানে যেন তাদেরকে সব অন্যায় থেকে পার পেয়ে যাওয়ার ভ্যাকসিন দেয়া হয়। এরা তখন ‘বেপরোয়া হয়ে পড়ে। অথচ তলে তলের অন্ধকারের যেই রাজনীতি ছড়ায় তাকে বন্ধ করতে দরকার ক্যাম্পাসে অধিকতর সাংস্কৃতিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ড আর খেলাধুলার প্রসার। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মাধ্যমেও রাজনীতি সম্ভব এবং এসবই হওয়া উচিত ছাত্রদের দ্বারা, ছাত্রদের জন্য ছাত্র রাজনীতি। টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, ফাওয়া খাওয়া, ছাত্র হয়ে ছাত্রদের টর্চার ইত্যাদি চলবে আর সেই রাজনীতি খোলার জন্য আমাদের মায়াকান্না দেখাতে হবে? লেখাপড়া করার বয়সে ক্ষমতা আর সম্পদের সাধ পেয়ে গেলে অল্প বয়সেই মানুষ পচে যায়। তার দ্বারা আর দেশের মঙ্গল হয় না; বরং দেশকে কিভাবে লুটেপুটে খেয়ে দেশকে সর্বনাশ করা যায় সেই রাজনীতি শিখে। আমার কথা সহজ কথা। 

তলে তলে কিংবা উপরে উপরে সব প্রকার ছাত্র রাজনীতি বন্ধ হোক। ছাত্ররা করবে সামাজিক ও সাংস্কৃৃতিক কর্মকাণ্ড এবং এর মাধ্যমেই ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব শিখবে। উল্লেখ্য, বিগত ২০১৯ সালের অক্টোবরে আবরার ফাহাদ হত্যার পর শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করে কর্তৃপক্ষ। তবে গত বছর বুয়েট শিক্ষার্থীদের পদ দিয়ে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণা করা হলে বিষয়টি নিয়ে ফের আলোচনা তৈরি হয়। গত বুধবার দিবাগত রাত ১টার দিকে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা বুয়েট ক্যাম্পাসে প্রবেশ করেন বলে অভিযোগ শিক্ষার্থীদের।
 

Link copied!