মে ২৬, ২০২৪, ১২:১৭ এএম
রাজনীতি ও প্রশাসনে শৃঙ্খলা সম্পূর্ণ অনুপস্থিত
—ড. বদিউল আলম মজুমদার সম্পাদক, সুজন
জবাবদিহিতা না থাকলে এগুলো ঘটবেই
—ড. সাব্বির আহমেদ অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
টানা চতুর্থবারের মতো সরকার পরিচালনা করছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। তবে এ মেয়াদের শুরুতেই সরকার বেশকিছু ক্ষেত্রে হোঁচট খাচ্ছে। পড়ছে বিব্রতকর পরিস্থিতিতেও। বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলের একজন সংসদ সদস্য বিদেশের মাটিতে খুন হওয়ায় এবং এই খুনের নেপথ্যের ঘটনাগুলো জনসম্মুখে আসায় বেশ অস্বস্তি ও বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়া ওই সংসদ সদস্যের অবৈধ কাজ কারবার নিয়ে সামাজিক মাধ্যমেও বেশ ট্রল হচ্ছে। মাদক ও সীমান্তে চোরা কারবারের সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তি আওয়ামী লীগের মতো একটি দলের মনোনয়ন পাওয়া নিয়ে নানা কথা হচ্ছে। একইভাবে দেশের একজন সাবেক সেনাপ্রধান ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা এবং সাবেক একজন পুলিশ প্রধান ও তার স্ত্রীর নামে কোটি কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের সন্ধান এবং ওইসব সম্পদ জব্দের আদেশ সরকারকে অস্বস্তিতে ফেলেছে।
মন্ত্রিসভা গঠনের পর এ বছরের শুরুতেই সরকার নিত্যপণ্যের মূল্য নাগরিকদের ক্রয়-ক্ষমতার মধ্যে রাখতে কঠোর অবস্থান নেয়। বেশকিছু পণ্যের মূল্যও নির্ধারণ করে দেয়। সরকারের নির্ধারিত ওই মূল্যে কিছু পণ্য বিক্রি হলেও বেশিরভাগ পণ্যই বিক্রি হচ্ছে সরকার নির্ধারিত মূল্যের বাইরে। নিত্যপণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে না পারায় সরকার যখন বিকল্প কৌশল খুঁজছিল, তখন বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ কমে যাওয়ার খবরে সেদিকেও সতর্ক নজর রাখছিল সরকার। কিন্তু এরই মধ্যে সংসদ সদস্য খুন হওয়া, সাবেক সেনাপ্রধানের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা এবং সাবেক পুলিশ প্রধানের অবিশ্বাস্য অবৈধ সম্পদ সন্ধানে ভিন্ন পরিস্থিতির জন্ম দেয়।
গত ১৩ মে ভারতে হত্যাকাণ্ডের শিকার হন ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম। দলীয় সংসদ সদস্যের এই হত্যাকাণ্ডে আওয়ামী লীগ নানা প্রশ্নের মুখে পড়ে। তার বিরুদ্ধে নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের অভিযোগ থাকার পরও কেন আওয়ামী লীগের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ দল তাকে মনোনয়ন দিলো তা নিয়ে নানা প্রশ্ন তৈরি হয়। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদককেও নাগরিকদের এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়েছে, কেন তাকে মনোনয়ন দেয়া হয়েছিল। তার ব্যাখ্যাও দিতে হয়েছে ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদককে। এটি ক্ষমতাসীন দলের জন্য স্বস্তির নয় বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। কেননা, হত্যাকাণ্ডের শিকার সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিমকে ধরিয়ে দিতে ২০০৭ সালে পুলিশের আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেড নোটিস জারি করেছিল বাংলাদেশ পুলিশ। তার বিরুদ্ধে দেশের আদালতেও তখন গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছিল। এরপরও তিনি পলাতক থাকায় ২০০৮ সালে চুয়াডাঙ্গার একটি বিশেষ ট্রাইব্যুনাল সংবাদমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে তাকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেন। তাছাড়া সর্বশেষ অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন কমিশনে দেয়া হলফনামায় নিজের বিরুদ্ধে ২১টি মামলা থাকার বিষয়টি উল্লেখ করেন। এখন ভারতে হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়ার পর দুই দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্রগুলো মনে করছে, এই হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে ছিল সীমান্তে চোরাচালান-সংক্রান্ত বিরোধ।
এদিকে সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদ ও তার পরিবারকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে দুর্বল করা ও দুর্নীতিতে জড়িত থাকার কারণ দেখিয়ে সম্প্রতি মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর এই নিষেধাজ্ঞা জারি করে। অবশ্য নিষেধাজ্ঞার প্রতিক্রিয়ায় সাবেক এ শীর্ষ সেনা কর্মকর্তা দাবি করেছেন, শাস্তি পাওয়ার মতো কোনো অপরাধ তিনি করেননি। যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু ঢাকা সফর করে যাওয়ার পরপরই এমন একটি নিষেধাজ্ঞার জন্য সরকার মোটেও প্রস্তুত ছিল না।
অপরদিকে, ঢাকা, গোপালগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, ও কক্সবাজারে একাধিক ফ্ল্যাট, রিসোর্ট, বাংলা বাড়ি ও জমিসহ বিপুল সম্পদের মালিক হওয়ার অভিযোগ সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে। গত ২৩ মে তার সম্পদ জব্দের নির্দেশ দিয়েছেন ঢাকা মহানগর আদালত। সেই সাথে তার ৩৩টি ব্যাংক হিসাব ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সব লেনদেন বন্ধের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এ সরকারের সময় নিয়োগ পাওয়া এই কর্মকর্তার অবৈধ সম্পদের সন্ধানও আওয়ামী লীগের মধ্যে স্বস্তির ছিল না।
চলমান ঘটনাবলি প্রসঙ্গে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ও বিশ্লেষক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘এখন একটা যথেচ্ছা (যা ইচ্ছা তা করার) সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। এখানে আইনের শাসন নেই।’ আমার সংবাদের এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, ‘এখানে দুর্নীতি, দুর্বৃত্তায়ন এবং স্বেচ্ছাচার সীমাহীন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। তিনি বলেন, আমাদের রাজনীতিতে, আমাদের প্রশাসনে সব জায়গায়ই শৃঙ্খলার পরিপূর্ণ অনুপস্থিতি। এটা আমাদের জন্য একটা ভয়াবহ পরিস্থিতি।’
সংসদ সদস্য খুন, সাবেক একজন সেনাপ্রধানের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা এবং সাবেক একজন পুলিশ প্রধানের অবৈধ সম্পদ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সাব্বির আহমেদ বলেন, ‘আধুনিক রাজনৈতিক ব্যবস্থায় সরকার তার সব কার্যক্রমের জন্য জনগণের কাছে জবাবদিহি করবে এবং সেই জবাবদিহি হবে একটা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। যে প্রক্রিয়াটা হচ্ছে একটা প্রাতিষ্ঠানিক প্রসেস (নিয়মের মধ্যে)। সেই প্রসেস হচ্ছে পার্লামেন্ট প্রসেস। আমাদের দেশে দীর্ঘদিন ধরে পার্লামেন্টের প্রসেসটা দুর্বল হয়ে যাওয়ায় জবাবদিহিমূলক শাসন অত্যন্ত দুর্বল। এই দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছে নানা শক্তি। তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটছে নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে। হয়তো এগুলোই শেষ না। এগুলো চলতেই থাকবে কোনো না কোনোভাবে।’
তিনি বলেন, ‘যখন রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থার সংকট হয়, তখন জনগণ নির্বাচনে ভোট দিতে আগ্রহ বোধ করে না। সুতরাং এখানে একটা শূন্যতা দীর্ঘদিন ধরেই হয়েছে। এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে নানা শক্তি নানা রকম কাজ করবে। কারণ, জবাবদিহিতা নেই। অনেকগুলো ঘটনা ঘটার পর জড়িতদের আইনের আওতায় আনা হয়। কিন্তু আপনি যদি আগে ব্যবস্থা নিতে পারেন, তাহলে তো অপরাধ আগে থেকেই সামাল দেয়া সম্ভব। অপরাধী একদিনে অপরাধী হন নাই, তারা দীর্ঘসময় ধরে এ অপরাধের সঙ্গে জড়িত। তারা প্রশাসন ও রাজনীতি যারা করেন, তাদের চোখের সামনেই দীর্ঘসময় কাটিয়েছেন। কিন্তু তারা তো ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিলেন।’ আমার সংবাদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, ‘আমার মূল কথা হচ্ছে, জবাবদিহিতা না থাকলে এগুলো (নানা অপরাধ) ঘটবেই।’