community-bank-bangladesh
Amar Sangbad
ঢাকা সোমবার, ০১ জুলাই, ২০২৪,

পশুর দাম পাওয়া নিয়ে শঙ্কা

বেলাল হোসেন

বেলাল হোসেন

জুন ৯, ২০২৪, ১২:১১ এএম


পশুর দাম পাওয়া নিয়ে শঙ্কা
  • কোরবানি সামনে রেখে সীমান্ত দিয়ে ঢুকছে গরু-মহিষ —অভিযোগ খামারিদের
  • গো-খাদ্যের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় বিপাকে খামারিরা 
  • উপকূলীয় খামারিদের পশুপালনে কঠিন অবস্থা

কোরবানির ঈদ সামনে রেখে প্রতিবছরই অল্প কিছু লাভের আশায় থাকেন পশুখামারিরা। প্রকৃতির বিরূপ আবহাওয়ার কারণে মাঠ, চারণভূমিতে দেখা মিলছে না ঘাসের। বাধ্য হয়ে বাজারের ভুসিসহ বিভিন্ন শুকনো খাদ্যের ওপর নির্ভরশীল প্রান্তিক খামারিরা। বাজারে গো-খাদ্যের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাওয়ায় বিপাকে প্রান্তিক খামারি ও কৃষকরা। এছাড়া সম্প্রতি উপকূলীয় ১৯ জেলায় ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় রেমালের আঘাতে প্রাণিসম্পদ খাতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির কারণে অনেক কৃষক দিশাহারা। যেসব পশু বর্তমানে বেঁচে আছে, তাদের ভরণ-পোষণ করা এখন কঠিন হয়ে পড়েছে উপকূলীয় খামারিদের। 
এবার ভারত থেকে কোনো গরু আসবে না সরকারের এমন ঘোষণায় আশায় বুক বেঁধেছিলেন খামারিরা। তবে সীমান্ত দিয়ে গরু প্রবেশ করায় লোকসানের শঙ্কায় রয়েছেন তারা। প্রশাসনের দাবি, ভারত থেকে গবাদি পশুর অনুপ্রবেশ ঠেকানো হচ্ছে।

ঈদ সামনে রেখে গরু লালন-পালনে ব্যস্ত সময় পার করছেন পাবনার বেড়া উপজেলার খামারিরা।  উপজেলার চরাঞ্চলসহ বিভিন্ন স্থানে অনেকেই ছোট-বড় গরুর খামার তৈরি করে ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটিয়েছেন। তবে খামারিরা বলছেন, এ বছর সব ধরনের গো-খাদ্যর দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় বর্তমানে গো-খামারে খুব একটা লাভ হচ্ছে না। কিন্তু অন্যান্য ব্যবসার তুলনায় এ এলাকায় কৃষক গরু পালনে ঝুঁকে থাকেন বেশি, তার কারণ একসঙ্গে অনেক পুঁজি লাগে না, দিনে দিনে স্বল্প খরচ করার কারণে খামারিদের বাড়তি ঝামেলা কম হয় এবং বছর শেষে একসঙ্গে অনেকগুলো টাকা হাতে পাওয়ায় কোরবানি ঈদ সামনে রেখে তারা গরু লালন-পালনে ব্যস্ত সময় পার করে থাকেন। 

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, এ উপজেলায় ছোট-বড় প্রায় চার হাজার গো-খামারি রয়েছে। সম্প্রতি উপজেলার হাটুরিয়া-নাকালিয়া ইউনিয়নের চরনাকালিয়া ও চরসাঁড়াশিয়া গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, প্রায় প্রতিটি বাড়িতে এক থেকে একাধিক দেশি গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া কোরবানির জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। 

এ সময় কথা হয় চরসাঁড়াশিয়া গ্রামের ক্ষুদ্র খামারি সাত্তার বেপারী, ঠান্টু বেপারী, আ. আজিজ মোল্লা, আলামিন মোল্লা, হুমায়ুন, বাবলু মোল্লাসহ অনেক খামারির সঙ্গে। তারা বলেন, বর্তমান হাটবাজারে সব ধরনের গো-খাদ্যের দাম বেশ বৃদ্ধি পেয়েছে। তাছাড়া এ বছর প্রচণ্ড খরতাপে চরাঞ্চলের বিস্তীর্ণ  জমিতে প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো দুর্বা (কাঁচা ঘাস) ও অন্যান্য চাষকৃত অধিকাংশ জমির কাঁচা ঘাস রোদে পুড়ে বিনষ্ট হয়ে যাওয়ায় এবার খামারিরা গো-খাদ্য হিসেবে হাটবাজার থেকে ভুসিসহ বিভিন্ন শুকনো খাদ্যের ওপর অনেকটা নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন। 

খামরিরা জানান, প্রতি বস্তা ভুসি এক হাজার ৮৫০ থেকে দুই হাজার টাকা, খড় ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা মণ, ফিড ২৫ কেজির বস্তা ৮০০ থেকে এক হাজার ৪০০ টাকা, কুড়া ৪০ কেজির প্রতি বস্তা ৮৫০ টাকা, গম ৪০ কেজির প্রতি বস্তা এক হাজার ৫০০ টাকা, ভুট্টা ৪০ কেজির প্রতি বস্তা এক হাজার ১৫০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। খামারিরা বলছেন, প্রচণ্ড খরতাপে গরুর শরীরে তুলনামূলকভাবে মাংস বাড়ছে না। তাছাড়া সব ধরনের গো-খাদ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণে গরু পালনে খরচ ভাড়ছে বেশি; তাই কোরবানির জন্য প্রস্তুতকৃত গরু-মহিষ, ছাগল-ভেড়ার আশানুরূপ দাম পাওয়া নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন খামারিরা। তারা আরও জানান, কোরবানির জন্য প্রস্তুত করা এক মণ ওজনের একটি গরু প্রস্তুতে খরচ পড়ে যাচ্ছে ৩০-৩২ হাজার টাকা। সে হিসাব ধরে হাটে গরু বিক্রি করতে গেলে গরুপ্রতি খুব একটা লাভ থাকে না। আবার কোরবানি ঈদ উপলক্ষে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত থেকে অবৈধভাবে দেশে গরু নিয়ে আসছে এমন খবর ছড়িয়ে পড়েছে। এমন অবস্থায় ব্যাপক লোকসানের মুখে পড়ার শঙ্কা প্রকাশ করেছেন এ অঞ্চলের গরু খামারিরা। 

এ বিষয়ে বেড়া উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মিজানুর রহমান এ প্রতিবেদককে জানান, এ উপজেলায় তিন হাজার ৩৫০ খামারি ৮৮ হাজার ৭৬৫টি গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া কোরবানির জন্য প্রস্তুত করেছেন। তিনি আরও জানান, বেড়া উপজেলায় কোরবানি উপলক্ষে চাহিদা রয়েছে ৬৫ হাজার ৩৮০টি পশুর। চাহিদার তুলনায় প্রস্তুতকৃত পশুর সংখ্যা বেশি থাকলেও খামারিরা কম-বেশি লাভবান হবেন বলে তিনি আশাবাদী।

পাবনার বেড়ার মতো দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে চরম সংকটে আছেন প্রান্তিক খামারিরা। এতে করে পশু পালনে অনাগ্রহ প্রকাশ করেছেন অনেক খামারি। ভুসি, ক্যাটল বুস্টার, গম ইত্যাদির দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় গরুকে খাদ্যের চাহিদার তুলনায় কম খাওয়ানো হচ্ছে। এতে দুধ উৎপাদন ও পশু মোটাতাজাকরণে প্রভাব পড়েছে। খামারিরা বলছেন, এবার কোরবানির ঈদে চাহিদার তুলনায় মাংস উৎপাদন কম হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এ ছাড়াও কৃষকরা গবাদিপশুসহ বহু মানুষ হাঁস-মুরগি, কবুতর, ছাগল, ভেড়াসহ বিভিন্ন পশু-পাখি পালন করেন। খাদ্যের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় তারাও পশু পালন করতে হিমশিম খাচ্ছেন। কেউ কেউ ছেড়ে দিয়েছেন পশু পালন।

এদিকে বাংলাদেশ ডেইরি ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিডিএফএ) সভাপতি ইমরান হোসেন বলেন, ঈদুল আজহা সামনে রেখে নানা কৌশলে ভারত ও মিয়ানমার সীমান্ত দিয়ে ঢুকছে গরু-মহিষ। কিছু সীমান্তে কড়া নজরদারি থাকলেও বেশ কয়েকটি এলাকা দিয়ে অন্য বছরের চেয়ে বেশি পশু ঢুকছে এবার। কখনো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীকে ফাঁকি দিয়ে, আবার কখনো প্রশাসনের সঙ্গে যোগসাজশে আনা হচ্ছে গরু। চোরাইপথে আসা এসব পশু বিক্রি হচ্ছে প্রকাশ্যে, রীতিমতো সীমান্ত এলাকায় হাট বসিয়ে। এসব হাট থেকে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ছে পশু। ইমরান বলেন, কোরবানি উপলক্ষে ভারত ও মিয়ানমার থেকে গরু আসবে না— সরকারের এমন ঘোষণার আশায় রয়েছেন দেশি খামারিরা। এখন সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে গরু ঢোকায় লোকসানের শঙ্কায় আমরা। এমন পরিস্থিতিতে সীমান্তপথে গরু আসা বন্ধে কঠিন নজরদারি আহ্বান জানান তিনি।

এ বিষয়ে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. মোহাম্মদ রেয়াজুল হক আমার সংবাদকে বলেন, আমাদের দেশের কোরবানির গরু চাহিদার তুলনায় কয়েক লাখ বেশি। গতবার অনেকেই গরু বিক্রি করতে না পেরে কান্না করেছেন। তাহলে অন্য দেশের গরু কিনবে কে। তিনি বলেন, সীমান্ত দিয়ে প্রচুর গরু দেশে আসছে এটা ঠিক না, কিছু লোক প্রোপাগাণ্ডা ছড়াচ্ছে। সীমান্ত দিয়ে সামান্য কিছু আসতে পারে এগুলো ব্যতিক্রম। আমাদের মন্ত্রী মহোদয় এ বিষয়ে বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছেন। গবাদিপশুর খাবারের দাম বৃদ্ধি নিয়ে প্রশ্ন করলে মহাপরিচালক বলেন, গরুর প্রধান খাদ্য ঘাস সেটা না থাকলে তো ফিড, অন্যান্য দানাদার খাবার দিয়ে গরু পালন করার দরকার নেই। খামার করতে হলে ঘাসের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রয়োজনে জমি বর্গা নিয়ে ঘাস চাষ করতে। এখন তো অনেকেই সাইলেজের প্রতি ঝুঁকে গেছে। আর প্রাকৃতিক দূর্যোগে আমাদের কিছু ক্ষতি হয়েছে এগুলো কাটিয়ে ওঠার জন্য আমরা কাজ করে যাচ্ছি।

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী মো. আব্দুর রহমান জানিয়েছেন, এবার ঈদে কোরবানির জন্য এক কোটি ২৯ লাখ ৮০ হাজার ৩৬৭টি পশু প্রস্তুত আছে। কোরবানির ঈদে প্রতিবছর উদ্বৃত্ত থাকে ২০ লাখের বেশি পশু। এবারও চাহিদার চেয়ে ২৩ লাখ বেশি পশু প্রস্তুত আছে। 

কোরবানির বাজারে ক্রেতা-বিক্রেতাদের অনুকূল পরিবেশ নিশ্চিত করা হবে জানিয়ে পশুসম্পদমন্ত্রী বলেন, বাজারের নিরাপত্তা নিশ্চিতে নির্ভেজাল ও নিষ্কণ্টকভাবে কাজ করা হচ্ছে। দেশের গরুতেই এবার স্বয়ংসম্পূর্ণ কোরবানির বাজার। তিনি বলেন, দেশে যেন অবৈধ উপায়ে গবাদিপশুর অনুপ্রবেশ ঘটতে না পারে সেজন্য সীমান্তবর্তী জেলাগুলোয় ইতোমধ্যে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। চোরাই গরু প্রবেশের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে সরকার। কোরবানির দিনটি শেষ না হওয়া পর্যন্ত সব পর্যায়ে নিবিড় পর্যবেক্ষণ থাকবে বলে জানান মন্ত্রী। 

(প্রতিবেদনটি প্রস্তুতে সহায়তা করেছেন পাবনার  বেড়া প্রতিনিধি)
 

Link copied!