অর্থনৈতিক প্রতিবেদক
জুন ৯, ২০২৪, ০৩:৪৫ পিএম
অর্থনৈতিক প্রতিবেদক
জুন ৯, ২০২৪, ০৩:৪৫ পিএম
ব্যাংক থেকে সরকার বেশি ঋণ নিলে বেসরকারি বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাধাগ্রস্ত হবে : এফবিসিসিআই
সব মিলিয়ে প্রস্তাবিত বাজেট হতাশাব্যঞ্জক : বিজিএমইএ
কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দিলে নিরুৎসাহিত হবেন নিয়মিত করদাতারা : সানেম
নিত্যপণ্য কিনতেই পকেট ফাঁকা হচ্ছে সাধারণ মানুষের। এমন পরিস্থিতিতে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য সাত লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করেছে সরকার। এতে বাজেট ঘাটতি দুই লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা। বিশাল এই ঘাটতি মেটাতে সরকারকে ব্যাংক খাতের ওপর নির্ভরশীল হতে হচ্ছে। তবে দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ীদের সংগঠন এফবিসিসিআই, ডিসিসিআই, এমসিসিআই তৈরি পোশাক খাত সংশ্লিষ্ট বিজিএমইএ, বিকেএমইএ ও বিটিএমএ’র মতে, এটি দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। গতকাল শনিবার বাজেটোত্তর পৃথক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন ব্যবসায়ী ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের নির্বাহীরা।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন দ্য ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, ব্যাংক থেকে সরকার বেশি ঋণ নিলে বেসরকারি বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাধাগ্রস্ত হবে। ঘাটতি মেটাতে সরকার ব্যাংক খাত থেকে এক লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ঋণ নেবে। এতে দেশে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান কমার আশঙ্কা রয়েছে।
এফবিসিসিআই সভাপতি বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটে ঘাটতি দুই লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা, যা জিডিপির ৪ দশমিক ৬ শতাংশ। যদিও চলতি অর্থবছরের বাজেটে ঘাটতি রাখা ছিল ৫ দশমিক ২ শতাংশ। তিনি বলেন, ঘাটতি মেটাতে সরকারকে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে এক লাখ ৬০ হাজার ৯০০ কোটি টাকা নিতে হবে। এর মধ্যে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে নিতে হবে এক লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। সেই সঙ্গে সরকারকে সুদের বোঝা টানতে হচ্ছে। ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে অধিক মাত্রায় সরকার ঋণ নিলে ঋণ প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করে। ফলে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে।
বাজেট ঘাটতি মেটাতে স্থানীয় ব্যাংক ব্যবস্থার পরিবর্তে যথাসম্ভব সুলভ সুদে ও সতর্কতার সঙ্গে বৈদেশিক উৎস থেকে অর্থায়নের জন্য নজর দিতে হবে। বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের (সোশ্যাল সেফটি নেট) আওতা বাড়ানো হয়েছে। এসব উদ্যোগ সামাজিক নিরাপত্তা সুসংহত এবং সামাজিক অর্থনীতিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে বলে আমরা মনে করি। তবে প্রকৃত সুবিধাভোগীদের কাছে যাতে এ সুবিধা যথাযথভাবে পৌঁছায় সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। তিনি বলেন, লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আদায়ে ব্যবসা-বাণিজ্যবান্ধব রাজস্ব ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সংস্কার জরুরি। একইসঙ্গে ট্যাক্স-জিডিপি রেশিও করের আওতা বাড়ানো এবং উপজেলা পর্যন্ত কর অফিসের বিস্তৃত করা প্রয়োজন। এ সময় মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এমসিসিআই) সভাপতি কামরান টি রহমান, ঢাকা চেম্বার সভাপতি আশরাফ আহমেদসহ এফবিসিসিআইর পরিচালনা পর্ষদের সদস্য ও ব্যবসায়ীরা উপস্থিত ছিলেন।
তৈরি পোশাক প্রস্তুত কারক ও রপ্তানি কারকদের সংগঠন বিজিএমইএ, বিকেএমইএ ও বিটিএমএ নেতারা উত্তরায় বিজিএমইএ ভবনে আয়োজিত যৌথ সংবাদ সম্মেলনে বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটকে হতাশাব্যঞ্জক উল্লেখ করেন। এ সময় লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি এস এম মান্নান কচি। তিনি বলেন, আমাদের প্রত্যাশা ছিল বাজেটে পোশাকশিল্পের জন্য সহায়ক কিছু নীতি-সহায়তা থাকবে। বিশেষ করে উৎসে কর শূন্য দশমিক ৫ শতাংশে নামিয়ে আনা এবং এটিকে চূড়ান্ত করদায় হিসেবে গণ্য করার বিষয়ে আমাদের গভীর প্রত্যাশা ছিল এবং আছে। পাশাপাশি আরও প্রত্যাশা ছিল- বাজেটে ইনসেনটিভের ওপর আয়কর অব্যাহতি, শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন পণ্য ও সেবা ভ্যাটমুক্ত রাখা, এইচএস কোড ও ওজন সংক্রান্ত জটিলতা নিরসন করা, ইআরকিউয়ের ওপর আয়কর ২০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ করা, অগ্নি ও নিরাপত্তা সরঞ্জাম পুনঃস্থাপনের ক্ষেত্রে আমদানির ওপর কর রেয়াত, পোশাকশিল্পের ঝুটের ওপর ৭.৫ শতাংশ ভ্যাট ও রিসাইকেল ফাইবার সরবরাহের ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট প্রত্যাহার ইত্যাদির ঘোষণা আসবে, যা বাজেটে উঠে আসেনি। এটা আমাদের জন্য হতাশাব্যঞ্জক।
২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট প্রসঙ্গে সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, কঠিন বাস্তবতায় নানামুখী চ্যালেঞ্জ নিয়ে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য সংকোচনমূলক বাজেট প্রস্তাবনা করা হয়েছে। উচ্চতর প্রবৃদ্ধি অর্জনের চেয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। বাজেটে শিক্ষা ও দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়ন, কর্মসংস্থান, কৃষি, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, অবকাঠামো ও সামাজিক নিরাপত্তা খাতকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। এগুলো বাজেটের ইতিবাচক দিক। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ) সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন, বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম প্রমুখ।
অর্থনীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেমের মতে, প্রস্তাবিত বাজেটে যেভাবে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ রাখা হচ্ছে এভাবে সুযোগ রাখা হলে অনেকে কালো টাকা রাখার জন্য উৎসাহিত হবেন। সরকারের নেয়া এমন উদ্যোগ যথাযথ হয়নি বলে জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান। গতকাল রাজধানীর মহাখালী ব্র্যাক সেন্টার ইনে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সানেম আয়োজিত ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট পর্যালোচনায় এমন মন্তব্য করেন তিনি। ড. সেলিম রায়হান বলেন, এক বছর আগের তুলনায় অর্থনীতিতে উদ্বেগের মাত্রা এখন আরও বেড়েছে। যদি আমরা সামষ্টিক অর্থনীতির ফান্ডামেন্টালগুলো ঠিক করতে না পারি তাহলে অর্থনীতি আরেক বছর পর আরও খারাপ হবে। এখনই যদি মৌলিক দিকগুলো নিয়ে কাজ না করা হয় তাহলে সামনের দিনগুলোতে অর্থনীতিতে চ্যালেঞ্জ বাড়বে। কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া হলে পরবর্তীতে এ অর্থ সাদা করে ফেলতে পারবেন। এমন আকাঙ্ক্ষা থেকে অনেকে কালো টাকা রাখবেন। তারা সাদা করার জন্য বেশি আগ্রহী হবেন না।
নিম্ন ও মধ্যবিত্তের ওপর করের বোঝা চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। এতে এই শ্রেণির মানুষের মধ্যে বিত্তদের ওপর করের চাপ বেশি পড়বে। যে-সব পণ্য ও সেবার কর বাড়ানো হয়েছে তা লাক্সারি পণ্য নয়। সেগুলো এখন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য। মোবাইল ফোন ও সিমও এখন নিত্যপ্রয়োজনীয় একটি সেবা। এসব পণ্যের কর বৃদ্ধি করার ফলে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষের ওপর চাপ বেশি পড়বে। আর উচ্চবিত্তের ওপর এগুলো তেমন প্রভাব পড়বে না। ধনীদের অনেক ইনকাম করের আওতায় নেই এবং নানা কারণে তারা করের আওতার বাইরে। তাদের যদি এর আওতায় আনা না যায় তাহলে তাদের ওপর করের বোঝা পড়বে না।
প্রতিবছর বাজেটের ৮০ শতাংশ খরচ করা সম্ভব হয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, অনেক খাতের বরাদ্দ খরচ করতে না পেরে সরকারকে আবার ফেরত দেয়া হয়। পূর্বের বাজেটে দেখা গেছে, সব টাকা খরচ হয় না এবং প্রকল্পও বাস্তবায়ন হয় না। আগামী অর্থবছরেও যদি বাজেটের ৮০ শতাংশ খরচ হয় তাহলে অর্থনীতি আরও খারাপ হবে। রিজার্ভ নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করে সানেমের নির্বাহী পরিচালক বলেন, ‘বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ক্ষেত্রে আশাব্যঞ্জক কিছু নেই। বাজেটে বলা হয়েছে, আগামী অর্থবছর শেষে রিজার্ভ বেড়ে ৩২ ডলার হবে। তবে এটা কিভাবে সম্ভব হবে তা কিন্তু উল্লেখ করা হয়নি। অর্থাৎ বাজেটে এরকম অনেক কিছুই প্রাক্কলন করা হয়েছে, যা বাস্তবসম্মত না।’
সানেমের গবেষণা পরিচালক ড. সায়েমা হক বিদিশা বলেন, ‘যারা সৎভাবে ব্যবসা করে বড় ইন্ডাস্ট্রি গড়ে তুলবে এবং কর্মসংস্থান তৈরি করবে তাদেরই প্রণোদনা দেয়া দরকার। যদি ১৫ শতাংশ কর দিয়ে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ রাখা হয় তাহলে সৎ ব্যবসায়ীরা ভীষণভাবে নিরুৎসাহিত হবেন। এর ফলে দেশে ভালোভাবে ব্যবসা করা, কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা এবং দেশে টাকার রাখার ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। তখন টাকা পাচার করার প্রবণতা আরও বাড়বে।’