Amar Sangbad
ঢাকা রবিবার, ০৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪,

রসিদ ছাড়া অর্থ আদায়ে শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ

রাকিবুল ইসলাম ও জালাল আহমদ

রাকিবুল ইসলাম ও জালাল আহমদ

জুন ১০, ২০২৪, ১২:৪২ এএম


রসিদ ছাড়া অর্থ আদায়ে শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ
  • ইনকোর্স ফি’র নামে দুই দফায় টাকা আদায়

বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে দেয়া বিজ্ঞপ্তিতে উল্লিখিত খাতের বাইরে টাকা নেয়ার সুযোগ নেই 
—জাহিদুল হাসান, সেকশন অফিসার, সাত কলেজ ও ঢাবি পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) অধিভুক্ত বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে নিয়মবহির্ভূত অর্থ আদায়ের অভিযোগ উঠেছে। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ— কলেজ কর্তৃপক্ষ চাপ প্রয়োগ করে ইনকোর্স পরীক্ষার নামে দুইবার অর্থ আদায় করছে। আর এই আদায়কৃত টাকার কোনো প্রকার রসিদও দেয়া হচ্ছে না। তবে কলেজের অধ্যক্ষ বলছেন, নিয়ম মেনেই টাকা নেয়া হচ্ছে। 

জানা যায়, ২০১৭ সালে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজসহ রাজধানীর সাতটি কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হয়। এরপর থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী সাত কলেজ পরিচালিত হচ্ছে। পরীক্ষা-সংক্রান্ত নির্দেশনা অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের জন্য ১০০ মার্কের মধ্যে প্রতিটি কোর্সে সাবজেক্ট অনুযায়ী ২০, ২৫ এবং ৩০ মার্ক ইনকোর্স হিসেবে রাখা হয়েছে। ইনকোর্সের খাতা মূল্যায়নের জন্য শিক্ষার্থী প্রতি ৩০০ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। যার মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফান্ডে জমা হবে ১০০ টাকা এবং কলেজ ফান্ডে জমা হবে ২০০ টাকা। কিন্তু কলেজ কর্তৃপক্ষ নিয়ম বহির্ভূতভাবে অর্থ আদায় করছে ৪০০ টাকা। এর মধ্যে ভাইভা ফি ১০০ টাকা ধরা হয়েছে। আবার সাত কলেজ সংক্রান্ত সমস্ত বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে।  ষ এরপর পৃষ্ঠা ২ কলাম ৩

এদিকে ঢাবির ওয়েবসাইট থেকে বিগত দিনের ফরম পূরণের বিজ্ঞপ্তিগুলো বিশ্লেষণ করে জানা যায়, ইনকোর্স ফির কথা স্পষ্ট উল্লেখ থাকে এবং ঢাবি অধিভুক্ত সব কলেজকেই এই বিধানেই চলতে হয়। যদি ফরম পূরণের সময় এই ফি নেয়া হয় তাহলে আবারও শিক্ষার্থীদের কাছে ইনকোর্স ফি নেয়ার বিষয়টি কতটা যৌক্তিক তা নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে শিক্ষার্থীদের মধ্যে।

ইনকোর্সের নামে যে হারে নেয়া হচ্ছে অতিরিক্ত ফি : তথ্য বলছে, ২০২২ সালে কলেজ ভর্তিতে বিজ্ঞান বিভাগের মোট আসন সংখ্যা ছিল ৫৯০টি। বাণিজ্য বিভাগের মোট আসন সংখ্যা ছিল ১৩০টি এবং কলা ও সামাজিক বিজ্ঞান বিভাগের মোট আসন ছিল এক হাজার ১৮০টি। তিন বিভাগ মিলে শিক্ষার্থীর সংখ্যা দাঁড়ায় এক হাজার ৯০০ জনে। এদের মধ্যে অনিয়মিত থাকে প্রায় ৪০ শতাংশ শিক্ষার্থী। এই সংখ্যা বাদ দিয়ে শিক্ষার্থীদের সংখ্যা দাঁড়ায় (৬০ শতাংশ) এক হাজার ১৪০ জনে। প্রত্যেক শিক্ষার্থীর কাছে যদি নিয়মের বাইরে গিয়ে ৪০০ টাকা নেয়া হয় তাহলে প্রতিবছর (৬০ শতাংশ) এর হিসাব দাঁড়ায় চার লাখ ৫৬ হাজার টাকা। কিন্তু এই টাকা কোথায়, কোন খাতে ব্যয় হয় তা জানেন না অনেকেই। উল্টো ফরম পূরণের সময়ও ইনকোর্স ফি নেয়া হয়।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও তোলপাড় : ইনকোর্স ফির বিষয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও বিভাগের বিভিন্ন ব্যাচের গ্রুপেও রীতিমতো ঝড় উঠছে। এই ঘটনার নিন্দা জানিয়ে ‘কলেজ’ নামের একটি গ্রুপে একটি পোস্ট করা হয়। পোস্টে এক শিক্ষার্থী লিখেছেন, ‘বদরুন্নেসা কলেজের প্রতিটি ডিপার্টমেন্ট এক যোগে টাকা নিয়ে থাকে। কোনো এক ডিপার্টমেন্টের ছাত্রীরা যদি এক সাথে হয়ে প্রতিবাদ করতে যায় তখন তারা উদাহরণ হিসেবে একই কলেজের আরও নানাবিধ ডিপার্টমেন্টের কথা নিয়ে আসে। শুধু কি ইনকোর্স ফি! বলে দেয়া হয়েছে ডিপার্টমেন্টে যখনই কোনো কাগজ জমা নেয়া হবে তার সাথে ২০০ টাকা তাদের দিতে হবে, এবার কত নেয় কে জানে।’ 

আরেক শিক্ষার্থী লিখেছেন, ‘বদরুন্নেসার ম্যানেজমেন্ট ডিপার্টমেন্টে নানা ফন্দিতে টাকা নেয়। কেউ কিছু বললে তাকে একশটা কথা শুনানো হয়। আর তাদের একটাই কথা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নেয়া হচ্ছে।’ এদিকে ঘটনার নিন্দা জানিয়ে এক বিভাগের গ্রুপে আরেক শিক্ষার্থী (নিরাপত্তার স্বার্থে নাম এবং বিভাগ প্রকাশ করা হলো না) বলেন, ‘কি সুন্দর করে বলে ওসব বাদ বদরুন্নেসাতে নিবে কিসের আবার সাত কলেজ!’ একই গ্রুপে অন্য শিক্ষার্থী বলেন, ‘ঢাকা কলেজ নেয়নি আমাদের কলেজে নিচ্ছে। আমাদের কলেজের অন্য ডিপার্টমেন্টে নিয়েছে পার সাবজেক্ট ৫০ করে। ঢাকা কলেজের ইনকোর্সে ফেল করলে তখন জরিমানা আর আমাদের!’ এছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও নেতিবাচক মতামত ও প্রশ্ন ছুড়ে দিচ্ছেন শিক্ষার্থীদের অনেকেই। 

শিক্ষার্থীরা যা বলছেন : এ বিষয়ে কথা হয় বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজের এক শিক্ষার্থীর সঙ্গে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি আমার সংবাদকে জানান, ‘আমাদের সবার কাছে ইনকোর্স পরীক্ষার ফি বাবদ ৪০০ টাকার কথা বলা হয় পরীক্ষা চলাকালীন সময়। এর মধ্যে ৩০০ টাকা ইনকোর্স ফি এবং ১০০ টাকা ভাইবা ফির জন্য দিতে হবে এমনটাই মৌখিকভাবে বলা হয় আমাদেরকে। আমরা যখন জানতে চাই কেন এই টাকা নেয়া হচ্ছে তখন দর্শন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সুবর্ণা দাস বলেন, টাকা দিতে হবে নয়তো পরীক্ষা দিতে পারবে না কেউ। তখন আমরা প্রশ্ন করি সাত কলেজের কোথাও ইনকোর্স পরীক্ষার ফি দুইবার নিচ্ছে না তাহলে আমরা কেন দেব? তিনি আমাদের রাগান্বিত স্বরে বলেন, সাত কলেজে কি হচ্ছে সেটা দেখার বিষয় না। বদরুন্নেসাতে কি হচ্ছে সেটা দেখার বিষয়। এটা বাধ্যতামূলক।’

আরেক শিক্ষার্থী আমার সংবাদকে জানান, ‘আমার বাবা মানুষের জমিতে কাজ করে সংসার চালান। এদিকে হুট করেই পরীক্ষার ফি ৪০০ টাকা চাওয়া হয় আমাদের কাছে। এ বিষয়ে আগে কোনো নোটিসও দেয়নি। আবার এই টাকা দেয়ার সময় কোনো রশিদও দেয়নি কর্তৃপক্ষ। আমাদের শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন— যদি প্রকৃতপক্ষেই নিয়ম থাকে টাকা দেয়ার, তাহলে রশিদ কেন তারা দিচ্ছে না। আবার প্রতিবছর ফরম পূরণের সময়ও আমরা ইনকোর্স ফি দেই। কিন্তু দুইবার ফি নেয়াটা তো অযৌক্তিক। আমাদের সাথে অন্যায় করছে কলেজ কর্তৃপক্ষ। আমরা অনেকেই সচ্ছল পরিবার থেকে আসিনি। আবার টাকা না দিলে ইনকোর্সের মার্ক দেয়ার সময় সমস্যা করবে এটা বলে। তাহলে কি এটা একরকম হরিলুট না!’

অন্য বিভাগের এক শিক্ষার্থী জানান, ‘এ ধরনের দুর্নীতি করলে যদি প্রতিবাদ করা হয় তাহলে অনেক সমস্যার মধ্যে পড়তে হয় শিক্ষার্থীদের তাই বাধ্য হয়েই তারা টাকা দেয় কোনো রশিদ ছাড়াই। যেই টাকাটা নিচ্ছে তার কোনো প্রমাণ নেই যে, এটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নেয়া হচ্ছে। রশিদ চাইলেও দোষ হয়ে যায়। তাই কোনো প্রকার আওয়াজ না করে টাকা দিয়ে দেয় শিক্ষার্থীরা। যেন ভোগান্তিতে না পড়তে হয়।’

যা বলছেন অধ্যক্ষ : বাড়তি ফির বিষয়ে কলেজটির অধ্যক্ষ প্রফেসর সাবিকুন নাহারের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এ ধরনের তথ্য আমার কাছে নাই। ভর্তির সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে টাকা দেয়া হয় ওইটা দিয়েই চলে। আমরা কোনো ফি নিচ্ছি না। আমাদের এরকম কোনো প্রক্রিয়াই নাই। প্রথম বর্ষে যখন মেয়েরা ভর্তি হয় তখন ওই টাকাটা ওরা দিয়ে দেয় অফিসে। প্রথম বর্ষ থেকেই অফিস ইনকোর্স আর টেস্টের টাকা হিসেবে আমাদের দিয়ে দেয়। কিন্তু পরবর্তীতে পরের ইয়ারগুলো শুধু টেস্টের (টেস্ট পরীক্ষা) টাকাটা আমরা অফিস থেকে পাই। আর ইনকোর্সের টাকাটা ডিপার্টমেন্ট থেকে তোলে পার স্টুডেন্ট ৪০০ টাকা। ভাইবার জন্য কোনো টাকা নেয়া হয় না। আপনারা খোঁজ নিয়ে দেখতে পারেন। আমরা প্রথম শুনলাম ভাইবার জন্য টাকা দিতে হয়। আর আমরা টাকাটা দুই ভাগে উঠাই। প্রথম ইনকোর্স এবং দ্বিতীয় ইনকোর্স। আবার এই টাকা একবারই তোলা হয়।’

রশিদ ছাড়া ফি কেন নেয়া হচ্ছে এ বিষয়ে তিনি আরও বলেন, ‘রশিদ অন্য সময় ভর্তি হলে তো আমরা দেই। কিন্তু এটা তো ভর্তি না। এই ফি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নেয়। আপনারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে প্রশ্ন করেন। কাগজের দাম অনেক বেশি।’ এই ফির বিষয়ে পূর্বে কোনো নোটিস শিক্ষার্থীদের দেয়া হয়েছিল কিনা বিষয়টি জানতে প্রশ্ন করা হলে তিনি উত্তেজিত হয়ে বলেন, ‘এতকিছু তো আমার জানা নাই। এভাবেই বহুবছর ধরে কলেজ চলছে।’

সাত কলেজের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক কার্যালয় যা বলছে : বিষয়টি নিয়ে আমার সংবাদের কথা হয় সাত কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের সেকশন অফিসার জাহিদুল হাসানের সাথে। তিনি এ প্রতিবেদককে জানান, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা নিয়ম আছে যেখানে ফরম ফিলাপের সময় সবকিছু স্পষ্ট উল্লেখ থাকে এবং এটি ওয়েবসাইটে বিজ্ঞপ্তি হিসেবে প্রকাশ করা হয়। এবং এই ফি কোথায় কত লাগবে সব উল্লেখ থাকে। আমাদের যে বিজ্ঞপ্তি দেয়া থাকে সেভাবে নিলে তো কোনো সমস্যা নাই। আবার কলেজ ইচ্ছে করলেই যে ফি নেবে এমনটাও না। আমি ইচ্ছে করলেই তো কোনো ফি অ্যাড (যোগ) করতে পারব না। এর জন্যেও একটি পরিপত্র থাকে এবং কোন ফান্ডে কত টাকা নেবে সেগুলো উল্লেখ থাকে যেটি মন্ত্রণালয় থেকে দেয়া থাকে।’ 
 

Link copied!