জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
জুন ১৩, ২০২৪, ১২:৩৬ এএম
জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
জুন ১৩, ২০২৪, ১২:৩৬ এএম
অপরাধীদের বাঁচাতে তদবির হচ্ছে
—অভিযোগ আনারকন্যার
ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনার হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের শনাক্তে ঘটনার গভীরে অনুসন্ধান চালাচ্ছে পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ। যত দিন যাচ্ছে, ততই বের হচ্ছে নতুন নতুন ক্লু। প্রকৃত অপরাধীদের ধরতে বিরামহীন প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন তদন্ত-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। চাঞ্চল্যকর এই হত্যাকাণ্ডের মূল ঘাতক শিমুল ভূঁইয়াসহ তিনজনের দেয়া তথ্যানুযায়ী আটক করা হয় জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণবিষয়ক সম্পাদক কাজী কামাল আহমেদ বাবু ওরফে গ্যাস বাবুকে। গ্যাস বাবুর দেয়া তথ্যে জেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টুকেও আটক করা হয়। মিন্টুকে আটকের পর এমপি আনার অনুসারীরা সন্তোষ প্রকাশ করে মিছিল করেন। পাল্টা বিক্ষোভ ও মানববন্ধন করেন মিন্টু অনুসারীরা।
এদিকে আটক গ্যাস বাবুকে নিজেদের শত্রু নয় বলে দাবি করেন আনারকন্যা ডরিন; অন্যদিকে মিন্টুকে ছেড়ে দেয়া হতে পারে বলে আভাস দিয়েছেন ডিবিপ্রধান হারুন অর রশীদ। তাকে কিছু প্রশ্নের করার জবাব দিতে হবে; জিজ্ঞাসাবাদে সদুত্তর দিতে পারলে তিনি ছাড়া পাবেন। অপরদিকে গতকাল সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন পিতা হত্যায় জড়িতদের সঠিক বিচারের দাবি জানান। পরে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি অভিযোগ করেন, অপরাধীদের বাঁচাতে বড় বড় জায়গা থেকে তদবির করা হচ্ছে। তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তাকে আশ্বস্ত করে বলেছেন, সঠিক বিচার হবে, অপরাধীদের ছাড় দেয়া হবে না।
ডিবিতে মিন্টু, সদুত্তর দিতে পারলে মিলবে মুক্তি
গতকাল বিকালে রাজধানীর মিন্টো রোডে নিজ কার্যালয়ে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশীদ সাংবাদিকদের বলেন, মিন্টু সদুত্তর দিতে পারলে তার মুক্তি মিলবে। এ সময় তিনি বলেন, এমপি আনার হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টুকে ডিবি কার্যালয়ে আনা হয়েছে। প্রশ্নের যথাযথ জবাব দিতে পারলে তাকে ছেড়ে দেয়া হবে। তিনি বলেন, মূল ঘাতক শিমুল ভূঁইয়াসহ তিনজনের দেয়া জবানবন্দিতে নাম এসেছে ‘গ্যাস বাবুর’। গ্যাস বাবুকের গ্রেপ্তারের পর তার দেয়া তথ্যে নাম আসে ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক মিন্টুর। হারুন বলেন, তথ্য-উপাত্ত বিচার-বিশ্লেষণের জন্যই তাকে ডাকা হয়েছে। তদন্ত কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদে সদুত্তর দিতে পারলে মিন্টুকে ছেড়ে দেয়া হবে। আর না পারলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে। সংসদ সদস্য আনার হত্যাকাণ্ড নিয়ে আরও অনেকের তথ্য-প্রমাণ রয়েছে। যাদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যাবে, তাদের কাউকেই ছাড় দেয়া হবে না বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন ডিবির এই কর্মকর্তা। মামলা তদন্তের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘গোয়েন্দা পুলিশ সব সময় স্বাধীনভাবে মামলা তদন্ত করে। এ বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কোনো চাপ থাকে না।’ এর আগে সংসদ সদস্য আনার হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় গত মঙ্গলবার বিকালে রাজধানীর ধানমন্ডি থেকে সাইদুল করিম মিন্টুকে ডিবি কার্যালয়ে নেয়া হয়। গোয়েন্দা সূত্রের দাবি, আনার হত্যাকাণ্ডের প্রধান হোতা আখতারুজ্জামান শাহিনের সঙ্গে মিন্টুর যোগাযোগ ছিল।
অপরাধীদের বাঁচাতে তদবির হচ্ছে— অভিযোগ আনারকন্যা ডরিনের : পিতা হত্যার বিচার চাইতে গতকাল বাংলাদেশ সচিবালয়ে গিয়েছিলেন ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনারের মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন। সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সঠিক বিচার দাবি করেন তিনি। পরে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন ডরিন। এ সময় তিনি বলেন, এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য এরই মধ্যে অনেককে আটক করা হয়েছে। আমি শুনেছি, অপরাধীদের বাঁচাতে অনেক জায়গা থেকে তদবির করা হচ্ছে। তাদের যেন ছেড়ে দেয়া হয়, সেজন্য চেষ্টা করা হচ্ছে। কোনো তদবিরের চাপে পড়ে এই হত্যাকাণ্ডের বিচার যাতে বন্ধ করার চেষ্টা না করা হয়, চাপের মুখে যাতে সঠিক তদন্ত বন্ধ হয়ে না যায়, সেই দাবি জানিয়েছি। আমি যেন সঠিক বিচার পাই— সেটাই বলেছি। তিনি বলেন, গ্যাস বাবু নামে যাকে আটক করা হয়েছে, তিনি বাবার প্রতিপক্ষ নন। আমাদের সঙ্গে তার কোনো শত্রুতা নেই। আমার মনে অনেক প্রশ্ন জাগছে। গত মাসের ১৭ তারিখে তার সঙ্গে ভাঙ্গায় দেখা হয়েছে। সেখানে একটা টাকা দেয়ার লেনদেনের কথা উঠেছে, যা আমি খবরে শুনেছি। আমার কথা হলো, ওই টাকার জোগানদাতা কে? কেন তারা এটা করিয়েছিল? আপনারা দেখেছেন, তাকে আটকের আগে থানায় তিনি জিডি করেছেন তার তিনটি ফোন হারিয়ে গেছে। একই দিনে একজন মানুষের তিনটি ফোন কীভাবে হারিয়ে যায়, সেটাও আমার প্রশ্ন। এগুলো কী পরিকল্পিতভাবে করা হয়েছে, তিনি তো আমার বাবার শত্রু নন। এ কাজগুলো কে করাচ্ছে, সেটা আমি বারবার বলেছি।
সঠিক বিচারের আশ্বাস দিয়ে তাকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, এক্ষেত্রে কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। যেটা আইনে আসবে, যেটা সত্য, সেটার বিচার হবে। ডরিন বলেন, আমি বিশ্বাস করি অপরাধীদের তিল পরিমাণও ছাড় দেন না প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
মিন্টু আটকে পাল্টাপাল্টি বিক্ষোভ : ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টু আটক হওয়ার পর আওয়ামী লীগে পাল্টাপাল্টি বিক্ষোভ সমাবেশ ও মানববন্ধন কর্মসূচি পালিত হয়েছে। গতকাল দুপুরে মিন্টু অনুসারীরা ঝিনাইদহ শহরের পায়রা চত্বরে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করে মিন্টুকে মুক্তির ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দেন। অন্যদিকে সাইদুল করিম মিন্টু আটক হওয়ায় সন্তোষ প্রকাশ করে কালীগঞ্জ শহরে মিছিল-সমাবেশ করেছে এমপি আনার অনুসারীরা। তারা সাইদুল করিম মিন্টুকে এমপি আনার হত্যার মূল ষড়যন্ত্রকারী বলে দাবি করেন। গতকাল দুপুর ১২টার দিকে ‘জনতার নেতা মিন্টু ভাইকে জনতার কাছে ফিরিয়ে দেয়ার দাবি নিয়ে’ মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেন আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠনের কয়েকশ’ নেতাকর্মী। পায়রা চত্বর থেকে ঝিনাইদহ কেসি কলেজ পর্যন্ত বিস্তৃত মানববন্ধন কর্মসূচিতে জেলা আওয়ামী লীগ নেতা মাসুদ আহম্মেদ সনজু, আনিছুর রহমান খোকা, আব্দুল মালেক মিনা, রাসেল, রানা হামিদ, উজ্জ্বল ও আল ইমরান বক্তব্য রাখেন।
এদিকে মিন্টু আটক হওয়ায় সন্তোষ প্রকাশ করে গত মঙ্গলবার রাত ৮টার দিকে কালীগঞ্জ শহরে দলীয় কার্যালয় থেকে মিছিল বের করেন এমপি আনার অনুসারীরা। মিছিলটি কালীগঞ্জ শহরের প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ শেষে আবার একই স্থানে গিয়ে শেষ হয়। সেখানে সংক্ষিপ্ত সমাবেশে কালীগঞ্জ উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান শিবলী নোমানী, পৌরসভার মেয়র আশরাফুল আলম, ভাইস চেয়ারম্যান শফিকুজ্জামান রাসেল ও ইউপি চেয়ারম্যান নাসির চৌধুরী বক্তব্য রাখেন। সমাবেশে উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান শিবলী নোমানী বলেন, জনপ্রিয় নেতা এমপি আনারকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। এই হত্যার নেপথ্যে জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণবিষয়ক সম্পাদক কাজী কামাল আহমেদ বাবু ওরফে গ্যাস বাবুকে আটক করা হয়েছে। তার স্বীকারোক্তি মোতাবেক জেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টুকেও আটক করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, সাইদুল করিম মিন্টু এমপি আনার হত্যার ষড়যন্ত্রকারী।
প্রসঙ্গত, ঝিনাইদহ-৪ আসনের তিনবারের সংসদ সদস্য আনার কালীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। গত ১১ মে তিনি চিকিৎসার জন্য ভারতে যান। প্রথমে কলকাতার বরাহনগরে তার বন্ধু স্বর্ণ ব্যবসায়ী গোপাল বিশ্বাসের বাড়িতে ওঠেন। সেখান থেকে বেরিয়ে নিখোঁজ হন। এরপর স্থানীয় থানায় জিডি করেন গোপাল বিশ্বাস। তদন্ত শুরু হয় দুই দেশে। ২২ মে সকালে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে খবর আসে নিউটাউনের এক বাড়িতে খুন হন এমপি আনার। এরপরই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ভারতের পুলিশের বরাত দিয়ে হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি নিশ্চিত করেন।