Amar Sangbad
ঢাকা রবিবার, ০৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪,

পরিদর্শনের নামে কারসাজি

নুর মোহাম্মদ মিঠু

জুন ২৬, ২০২৪, ১১:৩১ এএম


পরিদর্শনের নামে কারসাজি

পাঠদানের অনুমতি পাচ্ছে নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠান!

  • সম্প্রতি ২০ প্রতিষ্ঠানকে পাঠদানের অনুমতি মন্ত্রণালয়ের
  • অস্তিত্বই মিলছে না একাধিক প্রতিষ্ঠানের

বিষয়টি সংশ্লিষ্ট শাখাকে অবহিত করব এবং 
অনিয়ম হলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে
—বিএম আমিনুল ইসলাম, পরিদর্শক কারিগরি শিক্ষা বোর্ড

আবেদনের প্রাথমিক যাচাই-বাছাই করে শিক্ষা বোর্ড। এক্ষেত্রে অনিয়মের অভিযোগ পেলে অবশ্যই ব্যবস্থা গ্রহণ করবে মন্ত্রণালয়
—নজরুল ইসলাম, অতিরিক্ত সচিব (কারিগরি), শিক্ষা মন্ত্রণালয়    

ভোকেশনাল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠদানের অনুমতি প্রদানে ভানুমতির খেল খেলছে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা। যারা সারা দেশ থেকে আবেদন করা ভোকেশনাল প্রতিষ্ঠানগুলোর আবেদনের প্রাথমিক যাচাই-বাচাই ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শনের কাজটি করেন। টাকার বিনিময়ে কোনোরকম পরিদর্শন ছাড়াই নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানকেও অনুমতি প্রাপ্তিতে প্রত্যক্ষ সহায়তা করছেন তারা। গত ৬ জুন সারা দেশ থেকে আবেদনের প্রেক্ষিতে ২০টি প্রতিষ্ঠানকে পাঠদানের অনুমতি প্রদান করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগ। ওই বিভাগের কারিগরি শাখা-৩ থেকে প্রজ্ঞাপন জারির পরই মূলত আলোচনায় আসে আবেদন যাচাই-বাছাই কিংবা পরিদর্শনে অনিয়মের তথ্য। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, কোনোরকম প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি ছাড়াই আবেদনের অযোগ্য মোহাম্মদপুরের ঢাকা উদ্যান এলাকার উদয়ন টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটকেও পাঠদানের অনুমতি প্রদান করা হয়েছে ওই প্রজ্ঞাপনে। এছাড়া আরও একাধিক নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানকেও একই প্রজ্ঞাপনে অনুমতি প্রদান করা হয়েছে বলে জানা গেছে। 

এর মধ্যে তাসকিয়া ইসলাম টেকনিক্যাল স্কুলও একটি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পরিত্যক্ত একটি ভবনের মূল ফটকে শুধু সাইনবোর্ড ঝুলিয়েই অনুমতি পেয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। কার্যত প্রাতিষ্ঠানিক কোনো কার্যক্রমেই নেই প্রতিষ্ঠানটি। ভবনে প্রবেশের রাস্তা কিংবা ভবনটির অবস্থাও এমন যেন বেশ কবছর ধরেই সেখানে মানুষের কোনো যাতায়াত নেই। 

কোনোরকমের ল্যাব কিংবা হাতে-কলমে প্রশিক্ষণেরও কোনো সরঞ্জামাদি নেই সেখানে। কখনো শিক্ষার্থী আসতেও দেখেন না বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। অথচ পাঠদানের অনুমতি পাওয়ার আশায় প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি নিশ্চিতসহ নিয়মিত ক্লাস পরিচালনা করে আসা ঢাকা ও ঢাকার বাইরের বিভিন্ন জেলা-উপজেলার প্রতিষ্ঠানগুলো আবেদন করেও পাচ্ছে না অনুমতি। এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন ভোকেশনাল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মালিক-পরিচালকরা। তাদের অভিযোগ, টাকার বিনিময়ে নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের আবেদনগুলোও যাছাই-বাছাই কিংবা পরিদর্শন না করেই অনুমতি প্রাপ্তির যোগ্য করে দিচ্ছেন শিক্ষা বোর্ডের অসাধু কর্মকর্তারা। 

একই অনিয়মের মধ্য দিয়েই অনুমতি পেয়েছে নীলফামারীর সেইফ টেকনিক্যাল স্কুলও। আবেদনে দেয়া তাদের ঠিকানায় সরেজমিনে দেখা যায়, সেখানে এই নামে কোনো প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্বই নেই। বরং এনআইএসটি নীলফামারী পলিটেকনিকসহ অন্য একাধিক প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড রয়েছে ওই ঠিকানায়।সেইফ টেকনিক্যাল স্কুলের নামে কোনো সাইনবোর্ডও পাওয়া যায়নি ওই ঠিকানায়।

সূত্র জানায়, কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের কর্মকর্তাদের সঙ্গে পাঁচ লাখ টাকার চুক্তিতে যাচাই-বাছাইয়ে টেকানো হয়েছে ঢাকা উদ্যান এলাকায় উদয়ন টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট নামের অস্তিত্ববিহীন প্রতিষ্ঠানটিকে। প্রতিষ্ঠানটির আবেদনে যে ঠিকানা ব্যবহার করা হয়েছে, সেখানে রয়েছে অন্য আরেকটি প্রতিষ্ঠান। যার নাম অ্যাকটিভ টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ। এছাড়া অনুমতি প্রাপ্তির যেসব শর্ত রয়েছে, তার মধ্যে কম্পিউটার, সেলাই মেশিন, বিজ্ঞান ল্যাব, আইটি সাপোর্ট কিংবা ম্যানুফেকচারিং বেসিকসের কোনো ল্যাবেরও পূর্ণাঙ্গ অস্তিত্ব  নেই উদয়নের। সূত্র আরও জানায়, অ্যাকটিভ টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের পরিচালক জনৈক মো. বাহাউদ্দিন তার এই প্রতিষ্ঠানে পাঠদানের অনুমতি চেয়ে পূর্বে আবেদন করলেও অনুমতি পাননি। যে কারণে টাকার বিনিময়ে শিক্ষা বোর্ডের অসাধু কর্মকর্তাদের হাত করে এবার উদয়ন টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটের নামে অনুমতি ভাগিয়ে নেন।

এদিকে বিষয়টি জানাজানি হওয়ায় এখন অ্যাকটিভ টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের সাইনবোর্ডসহ সব চিহ্ন মুছে ফেলার চেষ্টা করছে কর্তৃপক্ষ। গত সোমবার সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, অ্যাকটিভ টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের সাইনবোর্ডের পরিবর্তে সেখানে উদয়ন টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটের নামে একটি ব্যানার সাঁটানো হয়েছে। যদিও ভর্তি বিজ্ঞপ্তিসহ আরও দুটি সাইনবোর্ড এখনো রয়ে গেছে অ্যাকটিভ টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের নামেই। তার প্রমাণও রয়েছে আমার সংবাদের হাতে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সাংবাদিকদের ফোন পেয়েই রোববার রাতে দায় সারতেই উদয়নের ব্যানার সাঁটানো হয়েছে। অ্যাকটিভ স্কুল অ্যান্ড কলেজের গেটে থাকা এক কর্মচারীর কাছে পরিচয় গোপন রেখে জানতে চাইলে তিনিও বলেন, ব্যানারটি রোববার রাতে লাগানো হয়েছে। এর আগে ওই স্থানে অ্যাকটিভ টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের ব্যানারই ছিল। সরেজমিনে এও দেখা যায়, ওই ভবনের মূল ফটকেই অ্যাকটিভ টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভর্তি বিজ্ঞপ্তির যে সাইনবোর্ড রয়েছে, তাতে পরিচালক বাহাউদ্দিনের ফোন নম্বরও উল্লেখ রয়েছে।

ঢাকার আদাবর ও মোহাম্মদপুর এলাকায় অনুমতি প্রাপ্তির যোগ্য এবং প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি রয়েছে— এমন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা অন্তত দুই শতাধিক। সেসব প্রতিষ্ঠান বছরের পর বছর অনুমতি ছাড়াই পূর্ণাঙ্গ প্রাতিষ্ঠানিক রূপে পাঠদান করে যাচ্ছে। সব যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও পাঠদানের অনুমতি পাচ্ছে না ওইসব প্রতিষ্ঠান। সংশ্লিষ্টরা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলছেন, এসবের কলকাঠি নাড়ছেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অসাধু কর্মকর্তারা। টাকার বিনিময়ে তারা যাচাই-বাছাইয়ে নয়ছয় করে এসব নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানকে অনুমতি পাইয়ে দিতে সহায়তা করছে। যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও একাধিকবার আবেদন করেও অনুমতি পাননি— এমনসব প্রতিষ্ঠানের মালিকরা বলছেন, উদয়ন টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট পাঁচ লাখ টাকার বিনিময়ে অনুমতি পেয়েছেন। যাচাই-বাছাইয়ের সময় কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের সংশ্লিষ্ট অসাধু কর্মকর্তাদের প্রথম দফায় তিন লাখ টাকা দিয়েছে উদয়ন টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট। পুরো প্রক্রিয়া শেষে বাকি টাকা দেয়ার চুক্তি রয়েছে বলেও চাউর রয়েছে। এছাড়াও ৬ জুনের ওই প্রজ্ঞাপনে অনুমতি পাওয়া সারা দেশের ২০টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আরও অনেক প্রতিষ্ঠানেরই এমন অনিয়ম থাকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ নিয়ে তদন্তের দাবি জানিয়েছেন এসব ভোকেশনাল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মালিক-পরিচালকরা।

মোহাম্মদপুর এলাকার এমন একটি প্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষক নাম প্রকাশ না করে বলেন, প্রতিষ্ঠান ছাড়া কীভাবে উদয়ন টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট পাঠদানের অনুমোদন পেলো, এটা আশ্চর্যজনক ঘটনা। দেশে অনেক ভালো ভালো ভোকেশনাল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে; তাদের অনুমোদন না দিয়ে ভুঁইফোঁড় প্রতিষ্ঠানকে পাঠদানের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এতে শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। এমন অনিয়মের বিষয়ে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের পরিদর্শক প্রকৌশলী বিএম আমিনুল ইসলামকে জানালে তিনি বিষয়টি সংশ্লিষ্ট শাখাকে অবহিত করবেন বলে জানান এবং অনিয়ম হলে অবশ্যই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলেও জানান তিনি।

উদয়ন টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রাতিষ্ঠানিক অবস্থানের বিষয়ে জানতে চেয়ে ফোন করা হলে অ্যাকটিভ টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটের পরিচালক মো. বাহাউদ্দিন সরাসরি গিয়ে কথা বলতে বলেন। ফোনে কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করে তিনি আরও বলেন, আরও এক সাংবাদিক ফোন করেছিলেন, এখন তাকে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তবে সার্বিক বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের কারিগরি অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. নজরুল ইসলাম মুঠোফোনে আমার সংবাদকে বলেন, এসব আবেদনের প্রাথমিক যাচাই-বাছাই করে শিক্ষা বোর্ড। এক্ষেত্রে অনিয়মের অভিযোগ পেলে অবশ্যই ব্যবস্থা গ্রহণ করবে মন্ত্রণালয়। উদয়ন টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটের অনুমতি প্রাপ্তিতে অনিয়মের বিষয়ে মন্ত্রণালয়ে আবেদন করার কথাও বলেন তিনি।
 

Link copied!