Amar Sangbad
ঢাকা রবিবার, ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪,

বিতর্কিত শিক্ষাসনদে সিইও সাইদুল আমিন

মো. ইমরান খান

মো. ইমরান খান

জুন ২৭, ২০২৪, ১২:১৭ এএম


বিতর্কিত শিক্ষাসনদে সিইও সাইদুল আমিন
  • পূর্ববর্তী কর্মস্থলে টার্গেট অর্জনে ব্যর্থ, দিয়েছেন অযোগ্যতার পরিচয়
  • অনুমোদনবিহীন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নিয়েছেন বিবিএ ও এমবিএ ডিগ্রি  
  • একই সেশনে করেছেন স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাস, যা অসম্ভব
  • সিইওর পদ পেতে ৪০ লাখ টাকা ঘুস লেনদেনের অভিযোগ   

আইডিআরএ তার সব কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করেই নিয়োগ দিয়েছে। তারপর আরও যাচাই-বাছাই শেষে নিশ্চিত হয়ে এ বিষয়ে কথা বলা যাবে
—জাহাঙ্গীর আলম, মুখপাত্র,বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ

দি ইউনিভার্সিটি অব কুমিল্লার অনুমোদন নেই, এই প্রতিষ্ঠানের সনদ ব্যবহার করে চাকরি করার সুযোগ নেই
—ওমর ফারুক, পরিচালক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শাখা, ইউজিসি

প্রশ্নবিদ্ধ শিক্ষাসনদে শেয়ারবাজারের তালিকাভুক্ত বিমা খাতের কোম্পানি প্রগ্রেসিভ লাইফ ইন্স্যুরেন্স লিমিটেডের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবে মুহাম্মদ সাইদুল আমিন নিয়োগ  পেয়েছিলেন। সনদ নিয়ে প্রশ্ন থাকা সত্ত্বেও তার এই নিয়োগে অনুমোদন দিয়েছে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)। একটি শিক্ষাসনদ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের, অন্যটি বিতর্কিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় দি ইউনিভার্সিটি অব কুমিল্লার। সিইও হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএর সঙ্গে মোটা অঙ্কের আর্থিক লেনদেন করা হয়েছে বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। পূর্ববর্তী কোম্পানিতে প্রতিষ্ঠান পরিচালনা এবং ব্যবসায়িক টার্গেট অর্জনেও মুহাম্মদ সাইদুল আমিন হয়েছেন ব্যর্থ। আগের কর্মস্থল মার্কেন্টাইল লাইফ ইন্স্যুরেন্সে সনদ জালিয়াতির বিষয়টি প্রকাশ পেলে তাকে পদত্যাগ করতে বলে বোর্ড কর্তৃপক্ষ। এর আগে মার্কেন্টাইল লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে সিইও হিসেবে নিয়োগ অনুমোদনের আগেই তার এমন জালিয়াতির কথা প্রকাশ পায়। স্পষ্ট জালিয়াতির প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও পরবর্তীতে এমন ব্যক্তি কীভাবে সিইও হিসেবে নিয়োগ পান— তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন খোদ বিমা-সংশ্লিষ্টরা। সাইদুল আমিন গত বছরের ২৩ নভেম্বর প্রগ্রেসিভ লাইফ ইন্স্যুরেন্সে যোগদান করেন। এরপর প্রগ্রেসিভ কর্তৃপক্ষের আবেদনের প্রেক্ষিতে ২০২৪ সালের মার্চে তাকে অনুমোদন দেয় আইডিআরএ। তিনি মাসিক বেতন হিসেবে নিচ্ছেন তিন লাখ ৩০ হাজার টাকা।

মুহাম্মদ সাইদুল আমিনের দি ইউনিভার্সিটি অব কুমিল্লার শিক্ষাসনদ বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, তিনি ব্যাচেলর অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রে+শন বা বিবিএ সনদ অনুযায়ী মার্কেটিং বিভাগ থেকে ২০০১ সালে সিজিপিএ ৩.৪৮ পেয়ে পাস করেছেন। আর সনদ ইস্যু করা হয়েছে ২০০২ সালের জানুয়ারি মাসের ২৩ তারিখে। সনদে আইডি/রোল উল্লেখ করা হয়েছে ৯৮১৯১৯। আইডিআরএতে দাখিল করা সনদে রোল নম্বরটির জায়গা অস্পষ্ট থাকায় এটা ভালোভাবে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। রেজিস্ট্রেশন নম্বর উল্লেখ করা হয়েছে ৯৮১৯। সনদটির সিরিয়াল নম্বর ৯৮। 

মুহাম্মদ সাইদুল আমিন একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বা এমবিএ করেছেন ২০০২ সালে। মার্কেটিং বিভাগে পেয়েছেন ৩.৬৩। তার এই সনদটি ইস্যু করা হয়েছে ২০০৪ সালের ২৩ জানুয়ারি। সনদ দুটি ইস্যুর তারিখ নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।

বিশ্ববিদ্যালয়টির অনুমোদন আছে কি না— এমন তথ্য অনুসন্ধান করা হয়। বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) ওয়েবসাইট বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন অমান্য, প্রশাসনিক অব্যস্থাপনা, অর্থনৈতিক অসচ্ছতা এবং মানহীন শিক্ষাব্যবস্থার কারণে ২০০৬ সালে প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষাকার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করে ইউজিসি। পরবর্তীতে সরকার কর্তৃক বন্ধ আদেশের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট মামলা দায়ের করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, যার রিট পিটিশন নং-১৬৭১/২০১৪। এরপর প্রায় এক দশক পর আদালতের রায় প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষা কার্যক্রমের পক্ষে গেলেও নানা জটিলতার কারণে অনুমতি পায়নি ইউজিসির। ফলে এখনো স্থগিত রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষাকার্যক্রম।
ইউজিসির বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শাখার পরিচালক মো. ওমর ফারুক আমার সংবাদকে বলেন, ইউনিভার্সিটি অব কুমিল্লা, এর তো অনুমোদনই নেই; সুতরাং এখান থেকে যে সার্টিফিকেট প্রদান করা হবে, সেটা ভুয়া। এই প্রতিষ্ঠানের সনদপত্র ব্যবহার করে চাকরি করার সুযোগ নেই।

এদিকে খবর নিয়ে জানা গেছে, সাইদুল আমিন পূর্ববর্তী কর্মস্থলেও করতে পারেননি ভালো পারফরম্যান্স। প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় অদক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন তিনি এবং ব্যবসায়িক টার্গেটও পূরণ করতে পারেননি। অযোগ্যতা ও অদক্ষতার কারণে চাকরি ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন পূর্ববর্তী কর্মস্থল মার্কেন্টাইল ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স থেকে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মুখ্য নির্বাহী হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার জন্য নানা তদবির ও ফন্দি-ফিকিরের আশ্রয় নিয়েছিলেন তিনি। তার এসব অপকর্মের অভিযোগ নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়, এমনকি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়েও চিঠি চালাচালি করেছেন কোম্পানির এক কর্মকর্তা। নিরাপত্তার স্বার্থে ওই কর্মকর্তার নাম প্রকাশ করা হয়নি। ওই চিঠিতে উল্লিখিত তথ্য বলছে, সিইও হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার জন্য সাইদুল আমিন প্রায় ৪০ লাখ টাকা লেনদেন করেছিলেন নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএর কিছু কর্মকর্তার সঙ্গে। তার সনদ জালিয়াতির কথাও তুলে ধরা হয় ওই চিঠিতে।

এদিকে মার্কেন্টাইল ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স লিমিটেডে যোগদানের পূর্বে তিনি যে কোম্পানিতে কাজ করেছেন, সেখানে জমা দেয়া সিভিতে তিনি বিএ পাস উল্লেখ করেছেন। তার সেই শিক্ষাসনদও এসেছে আমার সংবাদের হাতে। বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যায়ের অধীনে তৎকালীন সরকারি জগন্নাথ কলেজ থেকে ১৯৯৪-৯৫ সেশনে রসায়ন বিভাগ থেকে দ্বিতীয় শ্রেণিতে তিনি স্নাতক শেষ করেন। পরীক্ষা দেন ১৯৯৭ সালে। এই সনদটি ইস্যু করা হয় ২০০০ সালের ৪ জানুয়ারি। সনদ অনুযায়ী তার রোল নম্বর ১৫৭৬৫।

মুহাম্মদ সাইদুল আমিন স্নাতকোত্তরও করেছেন স্নাতকের সেশন অর্থাৎ ১৯৯৪-৯৫ সেশনে! জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে সরকারি জগন্নাথ কলেজ থেকে রসায়ন বিভাগ থেকে দ্বিতীয় শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হন তিনি। তবে তার এই সনদটি কবে ইস্যু করা হয়েছে তা নিশ্চত হওয়া যায়নি। কারণ, প্রাপ্ত সনদটিতে বেশকিছু জায়গায় ঘষামাজা করা হয়েছে। ওই সনদে তার রোল নম্বর ৩৭৪৮৬। পরীক্ষা দিয়েছেন ১৯৯৮ সালে। আর পাসের সন দেখানো হয়েছে ২০০১।

তবে দুটি সনদ নিয়েই ‘সন্দেহ’ প্রকাশ করছেন খাত-সংশ্লিষ্টরা। খোদ বিমা খাতের নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান আইডিআরএ তার শিক্ষাসনদে ‘আস্থা’ রাখতে পারছে না। এ জন্য সনদ যাচাইয়ের কার্যক্রম শুরু করেছে।

শিক্ষাবিদদের মতে, একই সেশনে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর পাস করার কোনো সুযোগ নেই। সাইদুল আমিনের সনদ দুটির যথার্থতা যাচাইয়ের জন্য জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করে আমার সংবাদ। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কর্মকর্তা বলেন, একজন শিক্ষার্থী একই সেশনে অনার্স ও মাস্টার্সে ভর্তি হতে পারেন না। তাই সাধারণভাবেই বোঝা যায় এই সনদ সঠিক নয়।

তবে আইডিআরএ তার এই সনদে বিশ্বাস রাখতে না পেরে যাচাইয়ের প্রক্রিয়া শুরু করেছিল। এর অংশ হিসেবে গত বছরের ১১ জুন মুহাম্মদ সাইদুল আমিনের পূর্ববর্তী কর্মস্থল ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের মুখ্য নির্বাহী বরাবর চিঠিও দিয়েছিল প্রতিষ্ঠানটি।

কর্তৃপক্ষের পরিচালক (উপসচিব) মোহা. আব্দুল মজিদ স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের সাবেক এসইভিপি মুহাম্মদ সাইদুল আমিনের শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদের সঠিকতা কর্তৃপক্ষ কর্তৃক যাচাই করা প্রয়োজন। এ লক্ষ্যে ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে সাইদুল আমিনের নিয়োগের সময়ে দাখিলকৃত সব শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ এবং জীবনবৃত্তান্তের দলিলাদি কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠাতে তিন কার্যদিবস সময় দেয় আইডিআরএ। 

এদিকে দি ইউনিভার্সিটি অব কুমিল্লা শুরু থেকেই সনদবাণিজ্যের জন্য বিতর্কিত। এই অপরাধে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান ইউজিসি ২০০৬ সাল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়টির সনদ অবৈধ ঘোষণা করে। 

গত বছর এক বিজ্ঞপ্তিতে দি ইউনিভার্সিটি অব কুমিল্লার বিষয়ে ইউজিসি বলে, এ বিশ্ববিদ্যালয়টি ১৯৯৫ সালে সরকারের অনুমোদন পায়। কিন্তু আইন না মানায় ২০০৬ সালে সরকার এটি বন্ধ করে দেয়। এ বিষয়ে আইডিআরএর মুখপাত্র জাহাঙ্গীর আলম আমার সংবাদকে বলেন, আইডিআরএ তার সব কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করেই নিয়োগ দিয়েছে। তারপরও আরও যাচাই-বাছাই শেষে নিশ্চিত হয়ে এ বিষয়ে কথা বলা যাবে।

এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে সাইদুল আমিনের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হয়েছে; একাধিবার কল রিসিভও করেছিলেন তিনি। তবে অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি মিটিংয়ে আছেন, এ বিষয়ে পরবর্তীতে কথা বললেন বলে জানিয়ে মোবাইল ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। পরবর্তীতে ফোন রিসিভ করে তিনি রাস্তায় আছেন বলে জানান। এরপর তিনি এ প্রতিবেদকের ফোন আর রিসিভ করেননি। আর এ কারণে তার বক্তব্য জানা যায়নি।
 

Link copied!