আনোয়ার হোসাইন সোহেল
জুন ৩০, ২০২৪, ১২:১৭ এএম
আনোয়ার হোসাইন সোহেল
জুন ৩০, ২০২৪, ১২:১৭ এএম
মূল্যস্ফীতি নিশ্চয়ই বাগে আনা সম্ভব
—ড. আতিউর রহমান,সাবেক গভর্নর
টাকার মূল্যমান বৃদ্ধি ডলারের নীতি সুদহার পরিবর্তন ছাড়া সম্ভব না
—ডিসিসিআইয়ের প্রেসিডেন্ট
ডলারের বিপরীতে কমছে টাকার মূল্যমান। এমন পরিস্থিতিতে আরেকটি মুদ্রানীতির ঘোষণা হতে যাচ্ছে জুলাইয়ের মধ্যভাগে। সুদহার বাড়িয়ে ঘোষিত মুদ্রানীতির ব্যর্থতায় দেশে বেড়েছে মূল্যস্ফীতি। এবারের মুদ্রানীতির প্রধান লক্ষ্য থাকবে মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরা। নতুন করে ঘোষণা আসতে পারে ডলারের দর বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়ার। বাদ দেয়া হতে পারে বহুল আলোচিত ক্রলিং পেগ পদ্ধতি। এমন আভাস দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা।
তারা জানান, বর্তমান রিজার্ভ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক উদ্বিগ্ন। এর কারণ হিসেবে ডলারের বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে না দেয়াকে দায়ী করা হচ্ছে। তাই ডলারের দর বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়ার বিষয়টি এবার মুদ্রানীতিতে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হচ্ছে। ব্যাংকগুলোতে আমদানি বিল পরিশোধ নিয়ে আগের মতো ঝামেলার অভিযোগ নেই। খোলাবাজারেও পর্যাপ্ত ডলার পাওয়া যাচ্ছে। এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের তৃতীয় কিস্তির এক দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলারের ঋণ যোগ হয়েছে রিজার্ভে। সেই সঙ্গে বেড়েছে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সও। রিজার্ভের থার্মমিটারের পারদ ওপরে রাখতে জুনে ডলার বিক্রি বন্ধ রেখেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সার্বিকভাবে ২৭ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার হাতে থাকায় রিজার্ভ পরিস্থিতি এখন অনেকটা-ই স্বাভাবিক বলা যায়। এমতাবস্থায় নতুন মুদ্রানীতিতে গভর্নর ডলারের রেট বাজারের ওপর ছেড়ে দিতে প্রাথমিকভাবে একমত হয়েছেন। জানা গেছে, জুলাই মাসের শুরুতে মুদ্রানীতি ঘোষণার নিয়ম থাকলেও বর্তমানে গভর্নর ফ্রান্সে রয়েছেন। মনিটরিং পলিসির একজন সদস্য রয়েছেন চীন সফরে। এজন্য আগামী ৭ জুলাই থেকে মুদ্রানীতি নিয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বৈঠক হবে। ১১ জুলাই মুদ্রানীতি সংক্রান্ত কমিটির চূড়ান্ত বৈঠক হতে পারে। ওই বৈঠক থেকে গভর্নরের কাছে একটি তারিখ চাইবে কমিটি। সব কিছু ঠিক থাকলে জুলাই মাসের মধ্যভাগে ঘোষিত হবে নতুন মুদ্রানীতি।
সুদহার বৃদ্ধির কারণে বেসরকারি বিনিয়োগ ও ব্যবসা বাণিজ্যে স্থবিরতার পাশাপাশি দ্রব্যমূল্যের চাপ সরকারের অনেক অর্জনই ম্লান হয়েছে। এতে চাপে রয়েছে গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। তাই এবারের মুদ্রানীতির মূল লক্ষ্যই থাকবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ। জিনিসপত্রের লাগামহীন দামের চাপে টানা ১৪ মাস ধরে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপর। গত জানুয়ারিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতি ঘোষণার মূল লক্ষ্য ছিল মূল্যস্ফীতি কমিয়ে ‘সাড়ে ৬ শতাংশে’ আনা। সেটি সম্ভব হয়নি; বরং উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর ও সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. হাবিবুর রহমান বলেন, ‘কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান চ্যালেঞ্জ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা। লক্ষ্য বাস্তবায়নে সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি প্রণয়ন করা হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে ডলারের দাম এবং সুদহার নির্ধারণে চুলচেরা বিশ্লেষণ করা হবে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নতুন করে পদক্ষেপ নেয়ার সুযোগ কম। ব্যাংকঋণের সুদহার ইতোমধ্যে ৯ শতাংশ থেকে বেড়ে ১৫ শতাংশ ছাড়িয়েছে। তারপরও নীতি সুদহার বাড়িয়ে টাকাকে আরও দামি করে তোলা হতে পারে। এতে ঋণের সুদহার আরও বাড়বে।
আসন্ন মুদ্রানীতি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান আমার সংবাদকে বলেন, মুদ্রানীতিকে আরও কিছুদিন সংকোচনমূলকই রাখতে হবে। সেজন্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতি সুদহার আবারও বাড়াতে হবে। ক্ষুদে ও ছোট উদ্যোক্তাদের জন্য রিফাইন্যান্স কর্মসূচির পরিধি বাড়িয়ে যেতে হবে। তবে এসএমইর জন্য সুদের হারের চেয়ে কত সহজে ব্যাংক থেকে ঋণ পাওয়ার বিষয়টি বেশি গুরুত্বপূর্ণ। যে কারণে এমএফআইগুলো থেকে সুদের হার বেশি থাকা সত্ত্বেও তারা বেশি করে ঋণ নেন এবং সময় মতো ফেরত দেন। মুদ্রানীতিকে কার্যকরে সরকারি খরচকে আরও দক্ষতার সঙ্গে ও সংকোচনমূলক করার কোনো বিকল্প নেই। আমাদের মুদ্রানীতি ও রাজস্বনীতিকে সমানতালে ব্যবহার করতে হবে। বাজার ব্যবস্থাপনা আরও সুশৃঙ্খল করা এবং পথে পথে চাঁদাবাজি বন্ধ করা, নিত্যপণ্যের বাজারকে প্রতিযোগিতামূলক রাখা এবং টাকা ও ডলারের বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখা গেলে মূল্যস্ফীতি নিশ্চয়ই বাগে আনা সম্ভব। তবে তা হঠাৎ করেই কমবে না। সময় লাগবে।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স ইন্ডাস্ট্রিজের (ডিসিসিআই) প্রেসিডেন্ট আশরাফ আহমেদ আমার সংবাদকে বলেন, ডলারের দাম বাড়া-কমা ডলারের ইন্টারেস্ট রেটের ওপর ডিপেন্ড করে। সে কারণে আমাদের টাকার মূল্যমানের ব্যাপারটাও আসলে ডলারের নীতি সুদহার পরিবর্তন না হলে খুব একটা পরিবর্তনের জায়গা আছে বলে আমি মনে করি না। এখানে আমাদের নিজস্ব যে ব্যাপারগুলো থাকে, আমাদের ব্যালেন্স অব পেমেন্টস ম্যানেজমেন্টের ব্যাপারটা যে শর্টটার্মে কাজে দেয় তা না। এটি আসলে কাজ করতে সময় নেয়। যে কারণ আমি মনে করি, যতক্ষণ ইউএস ডলারের সুদহারের পরিবর্তন হচ্ছে, ততক্ষণ আসলে এই যে ট্রেন্ড, এর কোনো পরিবর্তন আসছে না। ইএমই কিংবা ইন্ডিয়ান রুপি সবারই এলসির রেট বেড়ে যাচ্ছে এই ট্রেন্ডের কারণেই। সুদহার বৃদ্ধির ব্যাপারটা আসলে, কনট্রাকশনারি মানিটরি পলিটি এবং কনট্রাকশনারি বাজেট এই দুটির ইমপেক্টের কারণে সুদের হার বাড়ছে। যদি সুদের হার সাড়ে ১৩ বা ১৪ শতাংশ ওপর গড় হার বেড়ে যায় তখন ব্যাংক ব্যবস্থাপনার ওপর চাপ পড়বে। এক্ষেত্রে সাধারণ ব্যবসায়ীদের সাসটেইন করা সম্ভব হবে কম। এই কারণেই আমরা মনে করি, মুদ্রানীতিতে এই জিনিসটা মাথায় রাখা, একটা পয়েন্ট পরে যদি ইন্টারেস্ট রেট বেড়ে যায়, তখন আমাদের কনট্রাকশনারি মানিটরি পলিসির সেন্স থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।’