আনোয়ার হোসাইন সোহেল
জুলাই ৩, ২০২৪, ১২:৪৫ এএম
আনোয়ার হোসাইন সোহেল
জুলাই ৩, ২০২৪, ১২:৪৫ এএম
ক্রেডিট রেটিংয়ের মান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে
—অধ্যাপক আবু আহমেদ
ডিভিডেন্ড ভালো দিলে বাড়বে শেয়ারদর
—ডিএসইর পরিচালক শরীফ আনোয়ার
পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত সাত ব্যাংকের একেকটি শেয়ারের দর ফুটপাতে বিক্রি করা এক কাপ চা থেকেও সস্তা। সাধারণত ফুটপাতে এক কাপ চা পাঁচ থেকে ১০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়ে থাকে। শেয়ারবাজার-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আস্থা সংকটে ব্যাংকগুলো কাঙ্ক্ষিত ডিপোজিট আনতে না পারায় এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রার তীব্র সংকট, ঋণ আদায় কম, তারল্য সংকট, মাত্রাতিরিক্ত খেলাপি ঋণ, মূলধন ও প্রভিশন ঘাটতিসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত দেশের ব্যাংকগুলো। এরপরও (জানুয়ারি-জুন ২০২৪) ছয় মাসে কোনো কোনো ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা বেড়েছে ১০ কোটি থেকে সাড়ে ৫০০ কোটি টাকা পর্যন্ত। যদিও এটি ব্যাংকের প্রকৃত মুনাফা নয়। ফলে প্রশ্ন উঠেছে— তাহলে ব্যাংকগুলোর প্রকৃত মুনাফা কত; কেন ব্যাংকগুলোর শেয়ারদর ফেসভ্যালুর নিচে রয়েছে।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের হালনাগাদ তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ফেসভ্যালুর নিচে শেয়ারদর থাকা ব্যাংকের তালিকায় আছে আইসিবি ইসলামী ব্যাংক, এবি ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, ওয়ান ব্যাংক, এনআরবিসি ব্যাংক এবং মার্কেন্টাইল ব্যাংক। গতকাল সবশেষ লেনদেনের হিসাবে মার্কেন্টাইল ব্যাংকের প্রতিটি ১০ টাকার শেয়ারদর গতকাল মঙ্গলবার ৯ টাকা ৮০ পয়সা ছিল। এনআরবিসি ব্যাংকের শেয়ারদর ছিল ৯ টাকা ৯০ পয়সা। দিনে শেষে এক দশমিক শূন্য এক শতাংশ বেড়ে ১০ টাকা হয়েছে। অপরদিকে গতকাল এবি ব্যাংকের শেয়ারদর এক দশমিক ৪৯ শতাংশ কমে ছয় টাকা ৬০ পয়সায় দাঁড়িয়েছে।
এদিকে তালিকাভুক্ত ইউনিয়ন ব্যাংক নিজেদের ক্রেডিট রেটিং ‘এ প্লাস’ দাবি করে বিজ্ঞাপন প্রচার করছে। ক্রেডিট রেটিং হলো— কোনো প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির সঙ্গে আর্থিক সক্ষমতা বা ঋণ দেয়া হলে সেটা ঠিক সময়ে পরিশোধ করার ক্ষমতা কতটা আছে, সেটাই রেটিংয়ের মাধ্যমে নির্ধারণ করাকে ক্রেডিট রেটিং বলে। ব্যাংক খাত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, লোকাল কোম্পানিগুলোকে টাকা দিয়ে এমন ক্রেডিট রেটিং করিয়ে নেয় ব্যাংকগুলো। তাই এসব রেটিংয়ের মান নিয়ে এবং তার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন রয়েছে।
শেয়ারবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ আমার সংবাদকে বলেন, ‘ক্রেডিট রেটিংটা সাধারণত আমাদের দেশের কিছু লোকাল কোম্পানি করে থাকে। তাদের রিপোর্টিংয়ের মান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। অনেক সময় এসব রেটিংয়ে ব্যাংকের প্রকৃত লেনদেনচিত্র ফুটে ওঠে না। প্রকৃত চিত্র পেতে হলে ব্যাংকটির ডিপোজিট বেড়েছে কি-না দেখতে হবে। যদি কোনো কোম্পানি ভালো অবস্থানে থাকে, তাহলে তারা ভালো ডিভিডেন্ড দিতে পারবে। তবে খেলাপি ঋণের কারণে অনেক ব্যাংকই এখন দুর্বল অবস্থায় রয়েছে। ফেসভ্যালুর নিচে থাকার অর্থ হলো ওই কোম্পানিগুলোর প্রতি মানুষের আস্থা কম।’
এদিকে সবশেষ তথ্যমতে, ইউনিয়ন ব্যাংকের ১০ টাকার প্রতিটি শেয়ার এখন ছয় টাকা ৪০ পয়সা দরে নেমে এসেছে। ইউনিয়ন ব্যাংকের এ ধরনের প্রচারে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বিনিয়োগকারীরা বলছেন, এটা বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে তামাশা। শেয়ারদর এখন ছয় টাকা ৪০ পয়সা, অথচ আমরা ব্যাংকের প্রত্যেকটি শেয়ার কিনেছিলাম ১০ টাকা দিয়ে। এখন তারা প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছে তাদের ক্রেডিট রেটিং ‘এ প্লাস’— এটা কীভাবে সম্ভব।
জানতে চাইলে কোম্পানিটির সেক্রেটারি মো. আলী হোসেন আমার সংবাদকে বলেন, গত ১৩ জুন থেকে ১৪ জুন পর্যন্ত আমাদের ক্রেডিট রেটিং করা হয়েছে। এতে ব্যাংক পরিচালনায় সুশাসন, ম্যানেজমেন্টে দক্ষতার কারণে ইউনিয়ন ব্যাংককে রেটিং সংস্থা ‘এ প্লাস’ গ্রেড দিয়েছে। এতে শেয়ারবাজারকে যুক্ত করা হয়নি। একাধিক ব্যাংকের শেয়ার ফেসভ্যালুর নিচে থাকা প্রসঙ্গে বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক কাজী আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘বাজারের বর্তমান যে অবস্থা, তাতে কোনো কোম্পানিই ভালো অবস্থায় নেই। এক্ষেত্রে এককভাবে ব্যাংক ধরলেই হবে না। অনেকে আছেন যারা ভালো ডিভিডেন্ড দিচ্ছে, তাদের বিষয়ে আমাদের কোনো বক্তব্য নেই। সেসব ব্যাংকের শেয়ারদরও ভালো। তবে যে ব্যাংকগুলো বছরের পর বছর স্টক ডিভিডেন্ড দিয়ে নিজেদের পকেট ভারী করে বিনিয়োগকারীদের বঞ্চিত করেছে, তাদের শেয়ারদর ফেসভ্যালুর নিচে যাওয়াটা অস্বাভাবিক নয়।
বিনিয়োগকারীরা বলছেন, দুর্বল ব্যাংক ব্যবস্থাপনা, পরিচালকদের স্বেচ্ছাচারিতা, নিয়ন্ত্রক সংস্থার নজরদারির অভাবে আজ আমরা পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব। দীর্ঘদিন ধরে সাত ব্যাংকের শেয়ারদর ফেসভ্যালুর নিচে অবস্থান করছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বিএসইসি ও ডিএসই তেমন কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না।
ফেসভ্যালুর নিচে থাকা গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের প্রতিটি শেয়ারদর এখন ছয় টাকা ৫০ পয়সা, আইসিবি ইসলামী ব্যাংকের প্রতিটি শেয়ার তিন টাকা ৩০ পয়সা। দেশের প্রথম বেসরকারি ব্যাংক এবি ব্যাংকের শেয়ারদর সাত টাকা এবং ওয়ান ব্যাংকের প্রতিটি শেয়ারদর সাত টাকায় নেমে এসেছে।
তবে সংকটের মধ্যেও ভালো করছে তালিকাভুক্ত সরকারি ব্যাংকগুলো। রূপালী ব্যাংক তাদের সবশেষ পরিচালন মুনাফা প্রকাশ করেছে। এতে দেখা যায়, ব্যাংকটি ২০২৪ সালের জুনে ৪৫০ কোটি, ২০২৩ সালে ৩৩০ কোটি এবং ২০২২ সালে ৬৮ কোটি টাকা অবলোপন থেকে ৪৫ কোটি টাকা আদায় করেছে।
এই ব্যাংকের সবশেষ তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ব্যাংকটির প্রতিটি ১০ টাকার শেয়ার এখন ২৪ টাকা ৪০ পয়সায় বিক্রি হচ্ছে। গতকাল তাদের প্রতিটি শেয়ারের দর বেড়েছে এক দশমিক ৬৭ পয়সা।
উল্লেখ্য, খেলাপি হওয়া মন্দমানের ঋণকে ব্যাংকের স্থিতিপত্র থেকে (ব্যালেন্স শিট) বাদ দিয়ে পৃথক হিসাবে রাখাই হচ্ছে অবলোপন। ২০০৩ সাল থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণ অবলোপনের সুযোগ দিয়ে আসছে।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সবশেষ তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ইসলামি শরিয়ািভত্তিক গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক ২০২২ সালে ১০ শতাংশ ক্যাশ ও বোনাস ডিভিডেন্ড দিয়েছে, ওয়ান ব্যাংক ২০২০ সালে দেয় পাঁচ শতাংশ। তবে আইসিবি ইসলামী ব্যাংকের ক্যাশ ও বোনাস ডিভিডেন্ড দেয়ার কোনো তথ্য জানা যায়নি। এরপর থেকে ব্যাংকগুলোর শেয়ারদর কমতে থাকে। ইউনিয়ন ব্যাংক সবশেষ ২০২২ সালে বিনিয়োগকারীদের মাত্র পাঁচ শতাংশ ক্যাশ ডিভিডেন্ড দিয়েছিল, এবি ব্যাংক ২০২২ সালে দেয় দুই শতাংশ বোনাস ডিভিডেন্ড, মার্কেন্টাইল ব্যাংক সবশেষ ২০২৩ সালে ১০ শতাংশ ক্যাশ ডিভিডেন্ড দিয়েছিল। এনআরবিসি ২০২৩ সালে ১১ শতাংশ ক্যাশ ডিভিডেন্ড দিয়েছিল বিনিয়োগকারীদের।
ব্যাংকগুলোর শেয়ারদর এত কম থাকার কারণ কী— জানতে চাইলে ডিএসইর পরিচালক শরীফ আনোয়ার আমার সংবাদকে বলেন, শুধুমাত্র ব্যাংকের শেয়ারদরই ফেসভ্যালুর নিচে এমনটা নয়; বেশকিছু কোম্পানির শেয়ারদরই এখন ফেসভ্যালুর নিচে। বাজার ভালো হলে এগুলোর দরও ভালো হবে। এক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোকে বিনিয়োগকারীদের আস্থা অর্জন করতে হবে। বিনিয়োগকারীদের ভালো ডিভিডেন্ড দিলে শেয়ারদরও বাড়বে।
প্রসঙ্গত, ২০১১ সালে বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) তালিকাভুক্ত সব শেয়ারের অভিহিত মূল্য বা ফেসভ্যালু ১০ টাকা করার সিদ্ধান্ত নেয়।