Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ০৫ জুলাই, ২০২৪,

পর্যটন কর্পোরেশন ও ট্যুরিজম বোর্ডের প্রচেষ্টায়

সম্ভাবনার শিখরে পর্যটন খাত

ইয়ামিনুল হাসান আলিফ

ইয়ামিনুল হাসান আলিফ

জুলাই ৩, ২০২৪, ১২:৫৫ এএম


সম্ভাবনার শিখরে পর্যটন খাত

পর্যটন কর্পোরেশন ও ট্যুরিজম বোর্ড একই মন্ত্রণালয়ের অধীন হওয়ায় সমন্বয়পূর্বক কাজ করে যাচ্ছি

—মো. মাহমুদ কবীর, পরিচালক (পরিকল্পনা), বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন

ট্যুরিজম বোর্ড ও পর্যটন কর্পোরেশনের কার্যধারায় ভিন্নতা থাকলেও কাজে সমন্বয়ের অভাব নেই

—আবু তাহের মুহাম্মদ জাবের, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড

আনন্দের উৎস পেরিয়ে পর্যটন খাত এখন শিল্প। বর্তমানে পর্যটনশিল্প সেবা খাতের অন্যতম বৃহত্তম অর্থনৈতিক কার্যক্রম হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। প্রাচীনকাল থেকেই ভ্রমণার্থীদের জন্য আকর্ষণীয় একটি নাম বাংলাদেশ। চীনের বিখ্যাত পরিব্রাজক ওয়াংতা ইউয়ান প্রসিদ্ধ ভ্রমণকাহিনি ‘তাও-য়ি-চি-লিয়েহ’ লিখেছিলেন বাংলাদেশে ভ্রমণ করতে এসে। হেঁটে বাংলা ভ্রমণে আসেন চীন দেশের পর্যটক ফা হিয়েন। সপ্তম শতকে বাংলায় আসেন আরেক চীনা নাগরিক ই-সিং। এ দেশে এসে মুগ্ধ হয়েছিলেন হিউয়েং সাং। বাংলার সৌন্দর্যের আকর্ষণ উপেক্ষা করতে পারেননি বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা, আরব দেশের পর্যটক সোলায়মান কিংবা মিসরের ক্লডিয়াস টলেমায়েস টলেমি, গ্রিসের প্লিনি দ্য এল্ডার, পর্তুগালের দুয়ার্তে বারবোসা, ইতালির সিজার ফ্রেডেরিক, নিকোলা মানোচি ইংল্যান্ডের র‌্যালফ ফিচ ও ফ্রান্সের জে বি টেভার্নিয়ার।

প্রাকৃতিকভাবে কল্পনাতীত সুন্দর এ দেশের সৈকত, হাওর, বনাঞ্চল ও পর্বতাঞ্চল যে কাউকেই মুগ্ধ করবে। খুবই সম্ভাবনাময় বাংলাদেশের পর্যটন খাত এখন হাতছানি দিচ্ছে দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের মূল আকর্ষণবিন্দুতে অবস্থান নেয়ার। এ খাতকে আরও এগিয়ে নিতে কাজ করছে বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড ও বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন। পর্যটন খাতের উন্নয়নে নীতিমালা প্রণয়ন, সুপারিশ প্রদান ও বিদ্যমান পর্যটন-সংক্রান্ত নীতিমালা বাস্তবায়নে কাজ করছে বাংলাদেশ পর্যটন-সংক্রান্ত জাতীয় সংস্থা বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড। পর্যটনশিল্পের সার্বিক উন্নয়ন ও পর্যটন আকর্ষণ চিহ্নিতকরণ, সংরক্ষণ, বিকাশ এবং গণসচেতনতা তৈরিতে কাজ করছে সরকারি এ সংস্থাটি। পর্যটনসহায়ক সুবিধাসমূহ সৃষ্টি করতেও সংস্থাটি বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করছে। পর্যটনশিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের আরও দক্ষ করে গড়ে তুলতে সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়ে নিয়মিত অভ্যন্তরীণ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। 

এছাড়া ট্যুর অপারেটর প্রশিক্ষণ, ট্যুর গাইড প্রশিক্ষণ, টুরিস্ট পুলিশের দক্ষতা উন্নয়ন ও প্রশিক্ষণসহ বিভিন্ন প্রশিক্ষণ, সেমিনার ও কর্মশালার আয়োজন করে যাচ্ছে ট্যুরিজম বোর্ড। ফলে এ খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের দক্ষতা বৃদ্ধি পাওয়ায় পর্যটকদের সেবার মান বাড়ছে। আর এসব কারণেই বিদেশি পর্যটকরাও এখন নিয়মিত ভ্রমণ করছেন বাংলাদেশের পর্যটন স্থানগুলোয়। ইতিহাস- ঐতিহ্যসমৃদ্ধ বিভিন্ন স্থাপনা, জমিদারবাড়িগুলোয় আসছেন পর্যটকরা। এ দেশের প্রাচীন সংস্কৃৃতি সম্পর্কে জানতেও বাংলাদেশে আসছেন অনেক পর্যটক। এছাড়া প্রাচীন ধর্মীয় স্থাপনাগুলোতেও ভিড় জমাচ্ছেন অনেক পর্যটক। পুরাতন মসজিদ, ঐতিহাসিক ধর্মীয় স্থাপনা, মন্দির পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণস্থল হিসেবে রূপ নিয়েছে।

কমিউনিটি বেইজড ট্যুরিজম উন্নয়ন, পর্যটনশিল্পের প্রচার ও বিপণন কার্যক্রম সম্প্রসারণ, বিভিন্ন প্রতিযোগিতার আয়োজনও করছে ট্যুরিজম বোর্ড। দেশের পর্যটন কেন্দ্রকে তুলে ধরতে দেশি ও আন্তর্জাতিক পর্যটনমেলায় অংশগ্রহণ করছে এই সংস্থা। সংস্থাটির উদ্যোগে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ট্যুরিস্ট ইনফরমেশন সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে। সেখানে বাংলাদেশে আগত পর্যটকদের পর্যটন-সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্যগত সেবা প্রদান করা হচ্ছে। নিয়মিত পর্যটন-সংশ্লিষ্ট তথ্যচিত্র, প্রামাণ্যচিত্র, টিভিসি ও পর্যটন প্রচারণামূলক অনুষ্ঠানের আয়োজন করছে টুরিস্ট বোর্ড। ধর্মীয় ট্যুরিজম খাত, কৃষি ট্যুরিজম, অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরিজম টিভিসিগুলো পর্যটন স্থানগুলো সম্পর্কে আকর্ষণ বাড়াচ্ছে। পর্যটন খাতের উন্নয়ন, বিকাশ ও প্রচার বাড়াতে তথ্য ও প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি করেছে ট্যুরিস্ট বোর্ড। ট্যুর অপারেটর ও ট্যুর গাইড নিবন্ধন করার জন্য অনলাইন নিবন্ধন সফটওয়্যার, গুরুত্বপূর্ণ স্টেকহোল্ডারদের ডেটাবেজ সফটওয়্যারসহ বিভিন্ন সুবিধা অনলাইনে প্রদান করতে কাজ করা হচ্ছে। হোটেল ও রিসোর্টের ডেটাবেজ সফটওয়্যার প্রস্তুত করে ওয়েবসাইটে সন্নিবেশিত করা হয়েছে। দেশি-বিদেশি পর্যটকরা যেন বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে বাঙালি খাবার সম্পর্কে ভালো ধারণা পান, সেজন্য রেস্টুরেন্টের ডেটাবেজ সফটওয়্যারও প্রস্তুত করে ওয়েবসাইটে সন্নিবেশিত করা হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে বাংলাদেশের পর্যটনশিল্পের প্রচার করতে বিভিন্ন পোস্ট, ভিডিও, ফটো ও কনটেন্ট আকারে প্রকাশ করা হচ্ছে। এতে দেশের ভেতরে ও বাইরে ইতিহাস ও ঐতিহ্যসমৃদ্ধ স্থানগুলো সম্পর্কে জানতে পারছেন পর্যটকরা। 

পর্যটন খাতকে আরও এগিয়ে নিতে প্রয়োজন ছিল এ খাতে দক্ষ জনসম্পদ তৈরি, প্রয়োজন ছিল আন্তর্জাতিক মানের ইনস্টিটিউটের। এ লক্ষ্যে গড়া হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি। আন্তর্জাতিক মানের এই ইনস্টিটিউটে গবেষণা পরিচালনার পাশাপাশি বিভিন্ন খ্যাতিসম্পন্ন দেশি-বিদেশি প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কার্যকর অংশীদারিত্ব স্থাপন ও পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে সক্ষমতা বৃদ্ধিতে কাজ করা হচ্ছে। এছাড়া পর্যটনের বিকাশ ও উন্নয়নে জনগণকে সম্পৃক্তকরণ, সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন পরিকল্পনায় সরকারের অন্যান্য দপ্তরের সঙ্গে সমন্বয় করে যাচ্ছে ট্যুরিজম বোর্ড। ট্যুরিস্ট পুলিশের সঙ্গেও বিভিন্ন সেমিনার এবং প্রশিক্ষণ কর্মশালা নিয়ে কাজ করছে ট্যুরিস্ট বোর্ড। একসময় পাহাড়ি অঞ্চলসহ সুন্দরবন, কুয়াকাটায় পর্যটকদের নিরাপত্তার বিষয়টি চিন্তার রেখা ফেলত কপালে। তবে সে অবস্থার অনেকটাই উন্নতি হয়েছে। কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থার কারণে পর্যটন স্থানগুলোয় সব সময়ই পর্যটকদের আনাগোনা বেড়েছে। 

ট্যুরিস্ট বোর্ডের মতোই দেশের পর্যটন খাতকে এগিয়ে নিতে ভূমিকা রাখছে বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন। বাংলাদেশের পর্যটনশিল্পের বিকাশে কাজ করে যাওয়া স্বায়ত্তশাসিত এ সংস্থাটি জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে।
সংস্থাটি পর্যটন খাতের উন্নয়ন, প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধাসহ পর্যটনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যাবতীয় কার্যাদি প্রণয়ন করতে কাজ করছে। পর্যটন কর্পোরেশন বলছে, যাতায়াত, আবাসন ব্যবস্থা এবং এ-সংক্রান্ত সেবা প্রদানের মাধ্যমে বিদেশি কিংবা স্থানীয় পর্যটকদের জন্য আতিথেয়তা এবং তথ্য-সংক্রান্ত বিষয়াবলি প্রদানে তারা কাজ করে যাচ্ছে। ট্যুরিস্ট বোর্ডের মতো পর্যটনের সঙ্গে জড়িতদের জন্যে নির্দেশনা ও প্রশিক্ষণবিষয়ক প্রতিষ্ঠান গড়ে সংশ্লিষ্টদের জনসম্পদ হিসেবে গড়ে তুলতে কাজ করছে পর্যটন কর্পোরেশন। 

প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন রাষ্ট্রীয় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করছে। দেশের পর্যটন খাতকে এগিয়ে নিতে অভ্যন্তরীণ পর্যটন অবকাঠামো সৃষ্টির পাশাপাশি পর্যটকদের জন্য হোটেল, রেস্টুরেন্ট, রেস্টহাউস, পিকনিক স্পট, ক্যাম্পিং সাইট, থিয়েটার, বিনোদন পার্ক ইত্যাদি সুবিধা নিশ্চিতের পাশাপাশি এসব অবকাঠামো ও কার্যক্রম পরিচালনাও করে থাকে সংস্থাটি। এসব সুবিধা নিশ্চিতের ফলে দেশের বিভিন্ন পর্যটন স্থানে উপচেপড়া ভিড় লক্ষ করা যায়।
এক সময় কক্সবাজার, কুয়াকাটা ছাড়া তেমন কোনো পর্যটন স্পটে যাতায়াতের ভালো ব্যবস্থা থেকে শুরু করে পর্যটকদের থাকার জন্য যথেষ্ট নিরাপত্তা ও আবাসন ব্যবস্থা ছিল না। অপ্রতুল এই আবাসন, রেস্টুরেন্টের ব্যবস্থা  এবং এসবের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের দক্ষ করে গড়ে তোলার কাজ করে চলেছে পর্যটন কর্পোরেশন। ফলে পর্যটকরা উৎসাহিত হচ্ছেন। নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদারের ফলে দক্ষিণ এশিয়ার পর্যটন স্থানগুলোর মধ্যে অন্যতম প্রধান গন্তব্যস্থলে রূপ নিয়েছে ইতিহাস, ঐতিহ্য ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত বাংলাদেশ। 

বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড ও বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনের কাজের ভিন্নতা রয়েছে। একটি প্রতিষ্ঠান পর্যটন খাতের সেবা-সংশ্লিষ্ট ও উন্নয়নকাজে নীতিনির্ধারণে মূল ভূমিকা রাখছে; অন্যটি পর্যটন খাত-সংশ্লিষ্ট সেবার মান বাড়াতে ও অবকাঠামো নির্মাণ-পরিচালনায় মূল ভূমিকা রাখছে। এ দুটি প্রতিষ্ঠানের একক ও সমন্বিত প্রচেষ্টায় পর্যটন খাত এখন হাতছানি দিচ্ছে সম্ভাবনার চূড়ান্ত শিখরে।  

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (অতিরিক্ত দায়িত্ব) আবু তাহের মুহাম্মদ জাবের বলেন, আমাদের ও পর্যটন কর্পোরেশনের কার্যধারায় ভিন্নতা রয়েছে। তবে কাজে সমন্বয়ের অভাব নেই। 

বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনের পরিচালক (পরিকল্পনা) মো. মাহমুদ কবীর (যুগ্ম সচিব) বলেন,  পর্যটন কর্পোরেশন ও ট্যুরিজম বোর্ড আলাদা প্রতিষ্ঠান হলেও একই মন্ত্রণালয়ের অধীন হওয়ায় সমন্বয়ের মাধ্যমে পর্যটন খাতকে এগিয়ে নিতে কাজ করে যাচ্ছে।
 

Link copied!