Amar Sangbad
ঢাকা সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০২৪,

আস্থার শেষ খুঁটিতে আবেদচক্রের ধাক্কা

ফাঁস প্রশ্নে ক্যাডার কারা

নুর মোহাম্মদ মিঠু

জুলাই ৯, ২০২৪, ১১:১৯ পিএম


ফাঁস প্রশ্নে ক্যাডার কারা
  • চক্রের ১৭ সদস্য গ্রেপ্তার, ১৪ জন পলাতক, ১৭ জনের ব্যাংক হিসাব জব্দ
  • কেনা প্রশ্নে কতজনের চাকরি হয়েছে  প্রশাসনের কোন পর্যায়ে আছে— এ নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন  
  • বিসিএসসহ ৩০টি নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস, সবশেষ রেলওয়ের প্রশ্ন ফাঁসে ধরা
  • পিএসসি চেয়ারম্যান বলছেন প্রশ্ন ফাঁস ‘ভীষণ কঠিন’, অথচ আদালতে ফাঁসের দায় স্বীকার করে চক্রের জবানবন্দি

কার কার আমলে প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে বের করতে হবে। ফাঁস প্রশ্নে যারা প্রশাসনে ঢুকেছেন, তাদেরও চিহ্নিত করতে হবে 
—ব্যারিস্টার সুমন

দেশের প্রতিটি সেক্টরে যখন দুর্নীতিবাজদের আস্ফাালন দেখা দিয়েছে, তখন রাষ্ট্রের কাগুজে মালিক জনগণও কেবল উষ্মাই প্রকাশ করছেন। এছাড়া কিছু করারও নেই তাদের। এ অবস্থায়ও তাদের বিশ্বাসের অটল খুঁটিতে আবদ্ধ ছিল বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশন (বিপিএসসি)। যেখানে দুর্নীতির ছিটেফোঁটাও নেই বলেই বিশ্বাস করতেন তারা। এবার তাদের সেই বিশ্বাসের ঘরেও আগুন দিয়েনে তিন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও পিএসসির সাবেক চেয়ারম্যানের গাড়িচালকসহ একঝাঁক দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারী। যেখানে জনগণের গভীর বিশ্বাস ছিল বিসিএস পরীক্ষায় কোনো দুর্নীতিই হয় না, দুর্নীতির বিন্দুমাত্র সুযোগও নেই সেখানে। পিএসসির প্রশ্ন কখনোই ফাঁস হয় না, কারণ এর সঙ্গে যুক্ত সবাই শতভাগ নীতিবান। জনপরিসরের এই ধারণা এখন শুধু ভাবনাতেই সীমাবদ্ধ। গাড়িচালক আবেদ আলীচক্রের ঘটনায় এখন প্রমাণিত হয়েছে, একক প্রচেষ্টায় পিএসসির প্রশ্ন ফাঁস করা যায় না। বরং পুরো প্রক্রিয়ায় অনেক লোক জড়িত। পিএসসির কোন পর্যায়ের কর্মকর্তা এর সঙ্গে জড়িত, সেটিও খুঁজে বের করার কথা বলছেন সংশ্লিষ্টরা। 

শুধু তা-ই নয়— প্রশ্ন উঠেছে, আবেদ আলী বিসিএসের কোন কোন পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস করেছেন বা বিক্রি করেছেন, প্রিলিমিনারি, নাকি লিখিত পরীক্ষা? শুধু বিসিএস নয়, আরও অনেক চাকরির পরীক্ষার প্রশ্ন তিনি ও তার চক্রের লোকজন ফাঁস করেছেন বলেও জানা যাচ্ছে। তারা যাদের কাছে প্রশ্ন বিক্রি করেছেন, তাদের কতজনের চাকরি হয়েছে এবং তাদের মধ্যে কেউ যদি এখন প্রশাসনের বড় পদে থাকেন, তাদের নামও জনপরিসরে জানানোর দাবি উঠছে বিভিন্ন মহল থেকে। 

সূত্র জানায়, ফাঁসের প্রশ্নে ৩৩ ও ৩৪তম বিসিএসে চার-পাঁচজন ক্যাডার বানিয়েছে চক্রটি। নন-ক্যাডারও বানিয়েছে একাধিক। গত এক যুগে বিসিএসসহ অন্তত ৩০টি নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁস করা এই চক্রটি ২০-২৫ জন সিনিয়র স্টাফ নার্সও নিয়োগ দিয়েছে। সবশেষ রেলওয়ের উপপ্রকৌশলী পদের নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা ঘটায় চক্রটি। এর সূত্র ধরেই মূলত আবেদ আলীসহ পিএসসির প্রশ্ন ফাঁসের চক্রটির তথ্য প্রকাশ্যে আসায় আবেদ আলী ও তার পুত্রসহ চক্রের ১৭ সদস্যকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। গতকাল আদালতে তোলা হলে দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দেন  ষ এরপর পৃষ্ঠা ১১ কলাম ৩

আবেদ আলীসহ চক্রের সাত সদস্য। জবানবন্দিতে তারা গত ৫ জুলাই বিপিএসসি কর্তৃক আয়োজিত বাংলাদেশ রেলওয়ের সাব-অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার (নন-ক্যাডার) পদে নিয়োগ পরীক্ষার জন্য পরীক্ষা অনুষ্ঠানের নির্ধারিত সময়ের পূর্বে হুবহু প্রশ্নপত্র ফাঁস করে একদল পরীক্ষার্থীর কাছে অর্থের বিনিময়ে প্রশ্ন ও প্রশ্নের উত্তর বিতরণ করেছেন বলে দায় স্বীকার করেন। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আসামিরা একটি সংঘবদ্ধ চক্র হিসেবে বিগত বছরগুলোয় বিভিন্ন সময়ে বিসিএসসহ পিএসসির বিভিন্ন গ্রেডের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র অর্থের বিনিময়ে প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে জড়িত বলেও স্বীকার করেছেন। জবানবন্দি গ্রহণ শেষে চক্রের সদস্য পিএসসির উপপরিচালক আবু জাফর ও জাহাঙ্গীর আলম, সহকারী পরিচালক আলমগীর কবিরসহ বাকি ১০ জনকে কারাগারে প্রেরণের নির্দেশ দেন আদালত। অন্যদিকে গতকাল মঙ্গলবার প্রশ্ন ফাঁসে জড়িত ১৭ জনের ব্যাংক হিসাব জব্দ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। 

এদিকে প্রতিষ্ঠান হিসেবে পিএসসি ও বিসিএস পরীক্ষা সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মধ্যে যে আস্থা ছিল, প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় সেই আস্থায় ভাটা পড়েছে বলে মনে করছেন অনেকেই। বিভিন্ন মহল থেকে প্রশ্ন উঠছে, পিএসসি কর্তৃপক্ষ তদন্ত কমিশন করে পুরো বিষয়টি অনুসন্ধান করবে কী-না। কোন কোন পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে, কোথা থেকে কীভাবে হয়েছে, প্রতিষ্ঠানের কোন কোন পর্যায়ের লোক এর সঙ্গে জড়িত, প্রশ্ন ফাঁস করে কে কত টাকার মালিক হয়েছেন এবং ফাঁস হওয়া প্রশ্নে পরীক্ষা দিয়ে কে কে বিসিএস ক্যাডার হয়েছেন, সেসব উদ্ঘাটনে সাধারণ জনগণ আহ্বান জানিয়েছেন।

নিজেদের ভাবমূর্তি রক্ষায় তদন্ত কমিশন গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে কী-না, এমন প্রশ্নের উত্তর জানতে চেয়ে পিএসসির চেয়ারম্যান সোহরাব হোসাইনের মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। তবে গতকাল কর্মকমিশন ভবনে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি দাবি করেন, পিএসসি থেকে প্রশ্ন ফাঁস ‘ভীষণ কঠিন’। প্রশ্নপত্রের সেট লটারির মাধ্যমে নির্ধারণ করা হয়। লটারিতে কোন সেট আসবে— সেটা তো আল্লাহ ছাড়া কেউ বলতে পারবেন না। সেক্ষেত্রে প্রশ্ন ফাঁস খুবই কঠিন। তবে প্রশ্ন ফাঁস যে হয়নি বা হতে পারে না, তাও শতভাগ নিশ্চিত করে বলা যায় না। তিনি বলেন, যে প্রক্রিয়ায় চূড়ান্ত পর্যায়ে প্রশ্নপত্র পাঠানো হয়, সেখানে ফাঁস করার সুযোগ খুব কম। তারপরও বিষয়টি নিয়ে তদন্ত হচ্ছে। যদি কারো সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়, তাহলে সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নেয়া হবে। তিনি বলেন, গত ৫ জুলাই রেলওয়ের পরীক্ষা ছাড়া যেসব পরীক্ষা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, সেগুলোও প্রমাণিত হলে আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। দীর্ঘদিন গত হয়ে যাওয়ায়  সেসব পরীক্ষা বাতিলের বিষয়টিও জটিল বলে অকপটে স্বীকার করেন তিনি। 

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার সুমনও গতকাল কোর্ট প্রাঙ্গণে সাংবাদিকদের বলেন, কার কার আমলে প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে— সেটা বের করতে হবে। এ ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে যদি কোনো ব্যবস্থা না নেয়া হয়, তাহলে হাইকোর্টের শরণাপন্ন হবো। প্রশ্ন ফাঁসের মাধ্যমে কারা কারা প্রশাসনে ঢুকেছেন, তাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে হবে। তিনি বলেন, ছাত্ররা সারা দেশে কোটার জন্য আন্দোলন করছে। কিন্তু তারা কী জানে সবচেয়ে বড় কোটা ‘চোর কোটা’, ‘দুর্নীতিবাজ কোটা’। এই কোটার বিরুদ্ধে আন্দোলন করলে আমরা সব সুবিধা পেতাম। তিনি আরও বলেন, আমি দেখতে চাই কী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। না হলে প্রধানমন্ত্রী ও চিফ জাস্টিসের কাছে যাব। কেননা, এভাবে একটি দেশ চলতে পারে না। এরপর প্রশ্ন ফাঁস তদন্তে কমিটি গঠনের সমালোচনা করে সুমন বলেন, যারা চোর, পুলিশ তাদের ধরবে। কমিটি করার দরকার কী। কমিটি করা মানে ঘটনা হজম করার জন্য সময় নেয়া।

সিআইডি সূত্র জানায়, প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগের মামলায় প্রতিষ্ঠানটির সাবেক সহকারী পরিচালক নিখিল চন্দ্র রায়সহ ১৪ জন পলাতক রয়েছেন। পলাতক অন্য আসামিরা হলেন শরীফুল ইসলাম ভূঁইয়া, দীপক বণিক, খোরশেদ আলম খোকন, কাজী মো সুমন, একেএম গোলাম পারভেজ, মেহেদী হাসান খান, গোলাম হামিদুর রহমান, মুহা. মিজানুর রহমান, আতিকুল ইসলাম, এটিএম মোস্তফা, মাহফুজ কালু, আসলাম ও কৌশিক দেবনাথ। 

এছাড়া এ মামলায় আরও ৬০ জনকে অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে। গত সোমবার পল্টন থানায় পুলিশ বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করে। এ মামলায় পিএসসির সাবেক চেয়ারম্যানের গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলীসহ ১৭ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। তাদের মধ্যে পিএসসির উপপরিচালক, সহকারী পরিচালক ও আবেদের ছেলে ছাত্রলীগ নেতা সৈয়দ সোহানুর রহমান সিয়াম রয়েছেন। রোববার দেশের বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়।
 

Link copied!