ইয়ামিনুল হাসান
জুলাই ১২, ২০২৪, ০১:২৫ এএম
ইয়ামিনুল হাসান
জুলাই ১২, ২০২৪, ০১:২৫ এএম
কোটা সংস্কার দাবিতে গতকাল চতুর্থ দিনের মতো ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচি পালন করেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে পূর্বঘোষিত এ কর্মসূচি ঠেকাতে রাজধানীসহ দেশে ব্যাপক প্রস্তুতি ছিল পুলিশের। কর্মসূচি নিয়ে পুলিশের পক্ষ থেকে অগ্রিম সতর্কও করা হয়েছিল; কিন্তু এসব আমলেই নেননি আন্দোলনকারীরা। তারা ঠিক সময়ে কর্মসূচি শুরু করেন। পুলিশও নিশ্চুপ ছিল না। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পুলিশ শিক্ষার্থীদের নিবৃত্ত করতে চেয়েছে, বেশ কয়েকটি স্থানে লাঠিচার্জও করা হয়েছে। সংঘর্ষও হয় বিভিন্ন স্থানে। কিন্তু এসবেও থামানো যায়নি আন্দোলনকারীদের। তারা সব বাধা-প্রতিবন্ধকতা উপেক্ষা করে ‘বাংলা ব্লকেড’ সফল করে। এ কর্মসূচির অংশ হিসেবে গতকাল বিকাল থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ সড়ক অবরোধ করে রাখেন শিক্ষার্থীরা।
একইসঙ্গে ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-আরিচাসহ বিভিন্ন মহাসড়ক ও আঞ্চলিক মহাসড়ক অবরোধ করে রাখেন তারা। এতে সাধারণ পথচারীরা ভোগান্তিতে পড়েন। পরবর্তীতে আজ শুক্রবার বিকাল ৪টায় দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশের ঘোষণা দেন আন্দোলনকারীরা। গতকাল রাত ৯টায় শাহবাগ থেকে আন্দোলনকারীরা এ কর্মসূচি ঘোষণা করেন।
গত ১০ জুলাই মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিল করে হাইকোর্টের দেয়া রায়ের ওপর চার সপ্তাহের স্থিতাবস্থা দেন আপিল বিভাগ। এ বিষয়ে আগামী ৭ আগস্ট পরবর্তী শুনানির সিদ্ধান্ত দেয়া হয়। এ সময়কালে সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিল করে সরকারের দেয়া পরিপত্র বহাল থাকবে বলে জানান আপিল বিভাগ। এ সিদ্ধান্তের পরই আন্দোলনের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে শিক্ষার্থীরা আন্দোলনের নামে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করলে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করার হুঁশিয়ারি দেয় পুলিশ। হুঁশিয়ারি অনুযায়ী রাজধানীর শাহবাগ, ফার্মগেট, আগারগাঁওসহ দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বিপুলসংখ্যক পুলিশ অবস্থান নেয়। পুলিশি বাধা উপেক্ষা করে রাস্তা অবরোধ করতে গেলে কুমিল্লায় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
গতকাল কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীদের কঠোর বার্তা দিয়ে জান-মাল অনিশ্চয়তায় পড়লে পুলিশ বসে থাকবে না বলে সংবাদ সম্মেলনে জানান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। আর শিক্ষার্থীরা সড়ক অবরোধ করে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করলে পুলিশ কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে বলে হুঁশিয়ারি দেয়া হয়েছিল ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) পক্ষ থেকে।
এদিকে, কোটা ইস্যুতে মুখোমুখি অবস্থান নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করে দেশের বৃহত্তম দুই ছাত্রসংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে সংবাদ সম্মেলন করে আন্দোলনকারীদের ক্লাস-পরীক্ষায় ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানান ছাত্রলীগ সভাপতি সাদ্দাম হোসেন। অপরদিকে রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সরকারি চাকরিতে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের স্বল্পকোটা ছাড়া অন্য সব কোটা বাতিল চেয়ে সংবাদ সম্মেলন করে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল।
অপরদিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, ডিএমপি ও ছাত্রলীগ যখন আন্দোলনবিরোধী বক্তব্য দিচ্ছে, ঠিক একই সময় শাহবাগ, কারওয়ান বাজার, ফার্মগেটসহ দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থান ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে অবস্থান নেয় পুলিশ। সরেজমিনে জানা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, তেজগাঁও কলেজ, রামপুরা এলাকাসহ বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নেন ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। এরই মধ্যে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ফটক ও গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পুলিশি বাধা ভেঙে বাংলা ব্লকেডে অংশ নেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা।
ঢাকা : গতকাল দুপুরের পর থেকে বৃষ্টি নামায় কিছুটা সময় নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল থেকে মিছিল নিয়ে শিক্ষার্থীরা কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে সমবেত হন। সেখানে একটি সংক্ষিপ্ত সমাবেশও হয়। এরপর শিক্ষার্থীরা বিকাল ৫টার কিছু আগে মিছিল নিয়ে শাহবাগের দিকে অগ্রসর হন। ক্যাম্পাস থেকে শাহবাগ মোড়ে যাওয়ার রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়ে এপিসি, জলকামান নিয়ে অবস্থান নেয় পুলিশ। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা সে ব্যারিকেড ভেঙে শাহবাগ মোড়ে গিয়ে অবস্থান নেন। এ সময় আন্দলনকারীদের কেউ কেউ পুলিশের এপিসির ওপরে উঠে উল্লাস প্রকাশ করেন।
শাহবাগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের অবরোধে সমর্থন জানিয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (জবি), ঢাকা কলেজ ও ইডেন মহিলা কলেজের শিক্ষার্থীরাও অংশ নেন। ঢাকা কলেজ ও ইডেন কলেজের শিক্ষার্থীরা নীলক্ষেত মোড় অবরোধ করতে গেলে পুলিশ বাধা দেয়। পরবর্তীতে তারা শাহবাগে এসে জড়ো হন। পুলিশের পক্ষ থেকে বাধা প্রদান করা হয় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদেরও। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকে তালা ঝুলিয়ে বাধা দেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। তবে তালা ভেঙে শিক্ষার্থীরা এগিয়ে আসেন শাহবাগের দিকে। বিভিন্ন স্থানে পুলিশ বাধা দিলেও তা অতিক্রম করে শাহবাগে যুক্ত হন জবি শিক্ষার্থীরা।
অন্যদিকে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ফার্মগেট-মিরপুর সড়ক অবরোধ করতে গেলে পুলিশের বাধার সম্মুখীন হন। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় ফটকের সামনে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশ লাঠিচার্জ করলে ১০ জন আহত হন। পরে শিক্ষার্থীরা সংগঠিত হয়ে পুলিশি বাধা ভেঙে মিরপুর-ফার্মগেট সড়ক অবরোধ করেন।
জাবি : জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) প্রধান ফটকের সামনে থেকে মহাসড়কের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করলে পুলিশের বাধার মুখে পড়লেও বাধা ভেঙে ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
চট্টগ্রাম : চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি) এবং বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা সড়ক ও রেলপথ অবরোধ করতে গেলে নগরীর টাইগারপাস এলাকায় পুলিশি বাধার শিকার হন। এ সময় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর লাঠিচার্জ করে পুলিশ।
কুমিল্লা : কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুবি) শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে অংশ নিতে সমবেত হলে পুলিশ বাধা দেয়। পরে বিভিন্ন হল থেকে শিক্ষার্থীরা এসে যুক্ত হয়ে পুলিশের বাধা অতিক্রম করে অগ্রসর হতে চাইলে পুলিশ প্রথমে লাঠিচার্জ করে। এরপর শটগান দিয়ে কয়েক রাউন্ড গুলির পাশাপাশি টিয়ারশেল নিক্ষেপ করলে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা পুলিশকে লক্ষ করে ইট ও পাথর নিক্ষেপ করেন। পরে প্রতিরোধ গড়ে মিছিল নিয়ে এসে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করেন শিক্ষার্থীরা।
সিলেট : সিলেটে শাবিপ্রবি শিক্ষার্থীদের ওপর লাঠিচার্জ করে পুলিশ। তবে লাঠিচার্জ-বাধা উপেক্ষা করে সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়ক অবরোধ করেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) শিক্ষার্থীরা।
গোপালগঞ্জ : গোপালগঞ্জে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে অবস্থান নেয় বিপুলসংখ্যক পুলিশ। তবে বৃষ্টি ও পুলিশের অবস্থানকে উপেক্ষা করেই গোপালগঞ্জ-ঘোনাপাড়া সড়ক অবরোধ করেন শিক্ষার্থীরা।
রাজশাহী : কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশের হামলার ঘটনায় বিক্ষোভ মিছিল করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) শিক্ষার্থীরা। পরে বৃষ্টি উপেক্ষা করেই ঢাকা-রাজশাহী রেলপথ অবরোধ করে রাখেন তারা।
বরিশাল : পুলিশি বাধা উপেক্ষা করে বরিশাল-কুয়াকাটা মহাসড়ক অবরোধ করেন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (ববি) শিক্ষার্থীরা।
প্রসঙ্গত, সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে এ নিয়ে (১১ জুলাই পর্যন্ত) টানা ১১ দিন ধরে কর্মসূচি পালন করে আসছেন দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। ২০১৮ সাল পর্যন্ত সরকারি চাকরিতে ৫৬ শতাংশ কোটা প্রচলিত ছিল বাংলাদেশে। তার মাঝে ৩০ শতাংশই ছিল মুক্তিযোদ্ধা কোটা। বাকি কোটার মাঝে ১০ শতাংশ নারী, ১০ শতাংশ জেলা, পাঁচ শতাংশ ছিল ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের এবং এক শতাংশ কোটা ছিল প্রতিবন্ধীদের। ওই বছরই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী কোটা সংস্কার দাবিতে কোটাবিরোধী আন্দোলন শুরু করেন। শিক্ষার্থীদের দাবি ছিল— কোটা ৫৬ শতাংশ না হয়ে ১০ শতাংশ করা হোক। তাদের দাবির মুখে সে বছর প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরিতে পুরো কোটা পদ্ধতিই বাতিল করে একটি পরিপত্র জারি করেছিল জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
সে সময় কোটা পদ্ধতি বাতিলের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে বলেছিলেন, কোটা পদ্ধতি থাকলেই এ ধরনের আন্দোলন হবে বারবার। প্রতিবন্ধী বা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী যারা আছে, তাদের আমরা অন্যভাবে চাকরির ব্যবস্থা করে দিতে পারব। কিন্তু ২০২১ সালে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা ফিরে পাবার জন্য উচ্চ আদালতে রিট করেন এবং গত ৫ জুন প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের সরকারি সিদ্ধান্ত অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেয় হাইকোর্ট। হাইকোর্টের ওই রায়ের পর গত ৬ জুন থেকেই আন্দোলন করছেন শিক্ষার্থীরা। তবে কিছুদিন আন্দোলন চললেও মুসলিমদের অন্যতম বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদুল আজহা চলে আসায় ২৯ জুন পর্যন্ত আন্দোলন স্থগিত রাখেন শিক্ষার্থীরা।
এরপর গত ৩০ জুন থেকে ফের আন্দোলন শুরু করেন তারা এবং পয়লা জুলাই থেকে এই আন্দোলন দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। ১০ জুলাই আপিল বিভাগ হাইকোর্টের সেই রায়ে চার সপ্তাহের স্থিতাবস্থার আদেশ দিলেও শিক্ষার্থীরা জানান তারা তাদের আন্দোলন চালিয়ে যাবেন। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের দাবি, সরকারকে কোটা ইস্যুর একটি স্থায়ী সমাধান করতে হবে। শিক্ষার্থীদের দাবি, সব ধরনের সরকারি চাকরিতে কোটা পাঁচ শতাংশে নিয়ে আসতে হবে। দাবি আদায়ের লক্ষ্যে কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তে রয়েছেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা।