Amar Sangbad
ঢাকা সোমবার, ১৮ নভেম্বর, ২০২৪,

ভোগান্তি আর জনাতঙ্কের শেষ কোথায়

নুর মোহাম্মদ মিঠু

জুলাই ৩১, ২০২৪, ০২:৫৬ পিএম


ভোগান্তি আর জনাতঙ্কের শেষ কোথায়
  • ব্যাহত হচ্ছে অর্থনৈতিক শুমারি ২০২৪-এর তথ্য সংগ্রহের কাজ
  • মেট্রোরেল বন্ধে যানজট ভোগান্তি বেড়েছে
  • বন্ধই রয়েছে বিআরটিএর চার সেবা কার্যক্রম
  • শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধে দুশ্চিন্তায় অভিভাবকরা

আতঙ্কিত না হয়ে কর্মীদের আইডি কার্ড যাচাই করে তথ্য দিন

—বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো

ক্ষয়ক্ষতির গভীরতা বেশি। কবে নাগাদ সেবা কার্যক্রম চালু হবে বলা যাচ্ছে না

—গৌতম চন্দ্র পাল, চেয়ারম্যান, বিআরটিএ

যে ভয়-আতঙ্ক ছড়িয়েছিল, তা ধীরে ধীরে কেটে যাচ্ছে। জনজীবনে স্বস্তি ফেরাতে আমরা কাজ করছি

—ডিএমপি

কোটাবিরোধী আন্দোলনের শুরুটা শান্তিপূর্ণ হলেও শেষটায় ঘটে সংঘাত-সহিংসতা আর প্রাণহানি। শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলনে সৃষ্ট বহুমুখী ভোগান্তি আর আতঙ্ক এখনো বিরাজ করছে জনমনে। আন্দোলন চলাকালে সাধারণ মানুষ হতাহতের ঘটনা আর আন্দোলনের তীব্রতা শেষে ধরপাকড় ও নাগরিক জীবনে কারফিউ জারিসহ আরোপিত নানা সিদ্ধান্ত এখনো বহাল থাকায় ভোগান্তি ও আতঙ্ক যেন কাটছেই না। জনমনে এখন একটাই প্রশ্ন— এই ভোগান্তি আর আতঙ্কের শেষ কোথায়। আন্দোলন-পরবর্তী পরিস্থিতি এখন এমন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে যে, চলমান অর্থনৈতিক শুমারি ২০২৪-এর তথ্য সংগ্রহ করতে বাসাবাড়িতে যাওয়া মাঠকর্মীদের নিয়েও জনমনে দেখা দিয়েছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। এমন আতঙ্কের কারণ জানতে গিয়ে জানা গেছে, সাম্প্রতিক আন্দোলনে নাশকতাকারীদের ধরতে এলাকাভিত্তিক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্লক রেইড চলছে। 

এছাড়া আন্দোলন চলাকালে নাশকতার ঘটনায় জড়িতদের সিসিটিভি ফুটেজ দেখেও শনাক্ত করা হচ্ছে এবং তাদের ধরতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান চলমান রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এমন অভিযানের কারণে হালসময়ে জনমনে কাজ করছে পুলিশভীতি। যে কারণে অপরিচিত কেউ বাসার দরজায় কড়া নাড়লেও দরজা খুলতে অপারগতা প্রকাশ করছেন নগরীর বাসিন্দারা। রাজধানীর রামপুরা, খিলগাঁও, যাত্রাবাড়ী ও শনিরআখড়া এলাকার বাসিন্দাদের মধ্যে এমন আতঙ্ক বিরাজ করছে। বাসার দরজা না খোলায় কোথাও কোথাও ‘সাসপেক্টেড’ লিখে গেছেন বাসায় আসা কর্মীরা। পরবর্তীতে এমন লেখা দেখে আরও আঁতকে উঠছেন তারা। অনেকেই অনুমান করছেন, এটি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভাষা। যে কারণে তারা বুঝতে পারছেন না বাসায় আসলে কারা এসেছিল। এমন আতঙ্কে ব্যাহত হচ্ছে অর্থনৈতিক শুমারি ২০২৪-এর তথ্য সংগ্রহের কাজও।

তবে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর মহাপরিচালকের স্টাফ অফিসার (সহকারী পরিসংখ্যান কর্মকর্তা) নাসির উদ্দিন গতকাল আমার সংবাদকে জানান, গত ৭ জুলাই থেকে শুরু হয়েছে অর্থনৈতিক শুমারির তথ্য সংগ্রহের কাজ। যা কোটা আন্দোলনের কারণে মাঝে কদিন বন্ধ ছিল। এখন আবার শুরু হয়েছে। তবে এ নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। যদি কারো সন্দেহ হয়, তাহলে আমাদের কর্মীদের আইডি কার্ড দেয়া আছে, তা যাচাই-বাছাই করেই তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করার কথা বলেন তিনি।

সাম্প্রতিক আন্দোলনে স্বপ্নের মেট্রোরেলেও নাশকতা চালিয়েছে দুর্বৃত্তরা। ভাঙচুর করা হয় কাজীপাড়া ও মিরপুর-১০-এর স্টেশন, যা নির্মাণের পর চলাচলে স্বস্তির দেখা পায় যানজটের নগরী ঢাকার বাসিন্দারা। নাশকতার কারণে মেট্রোরেল বন্ধ হওয়ার পর থেকেই ফের যানজট ভোগান্তিতে পড়েছে নগরবাসী। রাস্তায় ফিরেছে চিরচেনা যানজট। এতে অফিসগামীরাসহ চরম ভোগান্তিতে পড়েছে রাজধানীবাসী। এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন অনেকেই। মেট্রোরেলে চড়ে উত্তরা কিংবা মিরপুর এলাকা থেকে মতিঝিল, পল্টন কিংবা ঢাকার বাইরে যেতে সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল কিংবা কমলাপুর রেলস্টেশনে যান— এমন বেশ কজনের সঙ্গে কথা হলে তারা ক্ষোভ প্রকাশ করে গতকাল আমার সংবাদকে বলেন, মেট্রোরেলে যারা ভাঙচুর করেছে, তারা দুর্বৃত্ত। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সুযোগ নিয়ে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে তারা মেট্রোরেলের ওই দুটি স্টেশন ভাঙচুর করেছে। যা মেরামতে বছরখানেকের মতো সময় লাগতে পারে বলছে মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ।

একইভাবে বনানীতে অবস্থিত বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) প্রধান কার্যালয় ও মিরপুর-১৪ নম্বরে সার্কেল-১ অফিসেও আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। আগুনে সেখানকার ডেটা সেন্টারসহ অন্যান্য ইলেকট্রনিক ডিভাইস ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে গাড়ির রেজিস্ট্রেশন, লাইসেন্স কার্ড, রুটপারমিটসহ চার ধরনের সেবা এখনো বন্ধ রয়েছে। বিআরটিএর গাড়ির রেজিস্ট্রেশন বন্ধ থাকায় বিপাকে পড়েছেন গাড়ি আমদানিকারকরা। স্বাভাবিক অবস্থায় দিনে ১০০ থেকে ১২০টি গাড়ি রেজিস্ট্রেশন হতো বিআরটিএতে। বর্তমানে তা বন্ধ থাকায় গাড়ি আমদানিকারকদের দিনে ৩০ থেকে ৩৫ কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে বলে জানিয়েছেন রিকন্ডিশন্ড গাড়ি আমদানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ রিকন্ডিশন্ড ভেহিক্যালস ইম্পোটার্স অ্যান্ড ডিলারস অ্যাসোসিয়েশন (বারভিডা)। এছাড়াও গাড়ি রেজিস্ট্রেশন না হওয়ায় গ্রাহকদের থেকে গাড়ি বিক্রির অবশিষ্ট টাকাও আদায় করতে পারছেন না তারা। এতে ক্ষতির মুখে পড়ার পাশাপাশি বন্দর থেকে গাড়ি ছাড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সংস্থানেও জটিলতার মুখে পড়েছেন আমদানিকারকরা। বন্দর থেকে গাড়ি খালাস করতে সমস্যায় পড়ছেন তারা। ফলে বর্তমানে বন্দরগুলোয় বাড়ছে আমদানি করা গাড়িজটও

বিআরটিএর চেয়ারম্যান গৌতম চন্দ্র পাল গতকাল আমার সংবাদকে বলেন, আমরা সার্ভার আপডেটের আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু বেগ পেতে হচ্ছে। তবে দ্রুত যেন করা যায়, সেজন্য চেষ্টা করছি। যদিও এখনো বলতে পারছি না কবে নাগাদ চালু করতে পারব। কারণ বেশকিছু ক্ষতি হয়েছে। আমরা সংশ্লিষ্ট এক্সপার্টদের নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি। সেবাগুলো যেন দ্রুত সময়ের মধ্যে চালু করা যায়, সেজন্য আপ্রাণ চেষ্টা চলছে।

এদিকে দেশের শিক্ষাব্যবস্থায়ও নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে এই আন্দোলনের ফলে। কোমলমতি শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে চলমান এইচএসসি পরীক্ষাসহ বিদ্যালয়গুলোতেও মাধ্যমিক পর্যায়ের ষাণ্মাসিক পরীক্ষা বন্ধ রেখেছে সরকার। যদিও শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান নওফেল বলেছেন, ধাপে ধাপে খোলা হবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। তবে তা কবে নাগাদ খুলতে পারে, এখনো তার সুনির্দিষ্ট দিনক্ষণ জানানো হয়নি। এতে শিক্ষার্থীদের নিয়ে চিন্তিত রয়েছেন অভিভাবকরা।

সার্বিক বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক গতকাল আমার সংবাদকে বলেন, সাম্প্রতিক আন্দোলনের শেষদিকে সরকারি-বেসরকারি গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন স্থাপনায় অগ্নিসন্ত্রাস বা তাণ্ডবের যে চিত্র দেখা গেছে, তা কবে নাগাদ ঠিক হবে— তা বলা যাচ্ছে না। এ বিষয়ে স্পষ্ট করে কেউ কিছু বলতেও পারছেন না। সাধারণ মানুষরা এতদিন যে সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে আসছিল, তাতে ছন্দপতন ঘটেছে। এখন তাদের ভিন্ন ভাবনা ভাবতে হবে। কারণ, এসব কর্মকাণ্ড মানুষের মধ্যে নানাভাবে আতঙ্ক বা প্রশ্ন তৈরি করে। এরপরও ভোগান্তির এ পরিস্থিতি থেকে একটা সময় মেরামতপূর্বক উত্তরণ সম্ভব। কিন্তু এই পরিস্থিতিকে যারা উস্কে দিয়েছে, এদের চিহ্নিত করতে গিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে যেন নিরপরাধ কেউ হয়রানির শিকার না হয়; ক্ষতিগ্রস্ত না হয়; আইন প্রয়োগে যেন কোনো ভুল না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। যদি কোনো ক্ষতি হয়, সেটি কভার করা সম্ভব নয়। তিনি আরও বলেন, নির্দোষ কোনো ব্যক্তির ওপর যেন পুলিশের অভিযান না হয়, তাহলেই আতঙ্ক কিছুটা হলেও কাটবে।

এদিকে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) পক্ষ থেকে গতকাল বলা হয়, আন্দোলন ঘিরে রাজধানীতে ব্যাপক সহিংসতার পর যে ভয়-আতঙ্ক ছড়িয়েছিল, তা ধীরে ধীরে কেটে যাচ্ছে। খুলছে ফুটপাত থেকে শুরু করে মার্কেটের দোকান, বাণিজ্যিক, ব্যাংক-বিমাসহ সব ধরনের প্রতিষ্ঠান। দিনের নির্দিষ্ট কিছু সময় কারফিউ থাকা সত্ত্বেও রাজধানী ফিরছে সেই চিরচেনা রূপে। নগরবাসীর নিরাপত্তা নিশ্চিত, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক ও জনজীবনে স্বস্তি ফেরাতে দিনরাত কাজ করছেন ডিএমপির প্রায় প্রত্যেক সদস্য।

আরএস

Link copied!