আগস্ট ৫, ২০২৪, ১১:৪৮ পিএম
- ভাষণ রেকর্ডের শেষ সুযোগও মেলেনি
- কার্গো বিমানে বোন রেহানাকে নিয়ে দিল্লিতে অবতরণ
- দেশের ইতিহাসে শেখ হাসিনাই প্রথম যিনি পদত্যাগে বাধ্য হয়ে দেশ ছেড়েছেন
অবশেষে রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিয়ে ছোট বোন শেখ রেহানাকে সঙ্গে নিয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন শেখ হাসিনা। যাকে দেশের ঐক্যবদ্ধ ছাত্র-জনতা ‘স্বৈরাচার’ আখ্যা দিয়ে টানা ৩৬ দিন আন্দোলন করে আসছিলেন। এরই মধ্যে আওয়ামী লীগ দলীয় কেন্দ্রীয় নেতাদের উসকানি আর পুলিশের আগ্রাসী মানসিকতায় ঝরে যায় অসংখ্য তাজা প্রাণ। তবুও ক্ষমতার মসনদ ধরে রাখা সম্ভব হয়নি তার। একপর্যায়ে তিনি আর ক্ষমতায় টিকে থাকতে না পেরে বাধ্য হয়েই গতকাল সোমবার গণভবন থেকে তার নিরাপদ স্থান ভারতের দিল্লিতে চলে যান। তাকে বহনকারী বিমানটি দিল্লির কাছে গাজিয়াবাদের হিন্ডন এয়ারবেস বা বিমানবাহিনীর ঘাঁটিতে অবতরণ করে বলে জানা যায়। জানা গেছে, শেখ হাসিনা ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় চাননি। তাই তার পরবর্তী গন্তব্য নিয়ে জল্পনা শুরু হয়েছে। তবে একটি অসমর্থিত সূত্রের খবর, হাসিনা সম্ভবত লন্ডনে যাবেন।
গতকাল সন্ধ্যা ৬টা নাগাদ দিল্লির উপকণ্ঠে উত্তরপ্রদেশের গাজিয়াবাদে হিন্ডন বিমান ঘাঁটিতে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি মালবাহী (কার্গো) বিমানে হাসিনা গাজিয়াবাদে নামেন। তার সঙ্গে ছিলেন তার বোন শেখ রেহানা এবং কয়েকজন অফিসার। একটি অসমর্থিত সূত্রের বরাতে জানা যায়, ব্রিটেনেও রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন তিনি। তবে গতকাল সোমবার রাতেই তিনি লন্ডনের পথ ধরার কথা। দেশ ছাড়ার আগে তিনি একটি ভাষণ রেকর্ড করে যেতে চেয়েছিলেন। সে সুযোগও পাননি। তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় বলেছেন, মা (শেখ হাসিনা) আর রাজনীতিতে ফিরবেন না। সজীব আরও বলেছেন, ‘তিনি এতটাই হতাশ যে তার কঠোর পরিশ্রমের পরও কিছু লোক তার বিরুদ্ধে (শেখ হাসিনা) দাঁড়িয়ে গেছে।’ এছাড়াও অভিমানের সুরে এক ভিডিও বার্তায় জয় বলেন, ঠিক আছে, শেখ হাসিনার পর আপনাদের কী হবে, তা আমার চিন্তার বিষয় নয়, আমাদের পরিবারেরও চিন্তার বিষয় নয়। আপনারা বুঝবেন। তবে এভাবে হত্যা করে, সংঘর্ষ করে ক্ষমতা দখল করা যাবে না।
এদিকে বাংলাদেশের ইতিহাসে এবারই প্রথম কোনো সরকারপ্রধান, যিনি পদত্যাগে বাধ্য হয়ে দেশ ছেড়েছেন। এর আগে বাংলাদেশের কোনো সরকারপ্রধান বা রাষ্ট্রপ্রধানের ক্ষেত্রে এমন ঘটনা ঘটেনি। প্রবল গণআন্দোলনে এ পর্যন্ত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ও শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়েছে। তবে এরশাদও দেশ ছাড়েননি; তিনি দেশেই ছিলেন। ২০০৬ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। তবে ওই সরকার নির্বাচন করতে না পারলে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব নেয়। এরপর থেকে খালেদা জিয়াকে বিদেশে পাঠানোর কথা বলা হলেও তিনি যেতে রাজি হননি। অথচ চলমান গণআন্দোলনে পদত্যাগের কদিন আগেই কার্যালয়ে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠকে তার পালানোর গুজব প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, ‘শেখ হাসিনা পালায় না।’
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার আমার সংবাদকে বলেন, ছাত্ররা এ দেশে একটা নতুন ইতিহাস তৈরি করেছে। এই কৃতিত্ব তাদের। তিনি বলেন, আমার জানামতে পতনের পর কোনো সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধানের এভাবে পালিয়ে যাওয়ার নজির নেই। একমাত্র গণতান্ত্রিক চর্চা আর মানুষের আস্থাই পারবে ভবিষ্যতে সরকারগুলোতে এমন পরিস্থিতি থেকে নিজেদের রক্ষা করতে।
১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতার পর থেকে গত ৫৩ বছরে যারা সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন, তাদের মধ্যে কেউ রাষ্ট্রপতি, কেউ প্রধানমন্ত্রী, কেউ প্রধান উপদেষ্টা, আবার কেউ সামরিক শাসন জারি করে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে দেশ পরিচালনা করেছেন। বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে রাষ্ট্রপতি এবং সরকারপ্রধান হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৫ সালের আগস্টের ১৫ তারিখে একদল সামরিক কর্মকর্তার হাতে শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হন। তার হত্যাকাণ্ডের পর আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতা খন্দকার মোশতাক আহমেদকে রাষ্ট্রপতির পদে অধিষ্ঠিত করা হয়। ওইদিনই দেশে সামরিক আইন জারি করেন তিনি। ওই বছরের ৬ নভেম্বর পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি থাকার সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি। ওইদিনই তিনি ক্ষমতাচ্যুত হন। ওই সময় ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানে সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমান পদচ্যুত হন। অভ্যুত্থানের নেতা ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ নিজেকে সেনাপ্রধান ঘোষণা করেন এবং ৬ নভেম্বর তৎকালীন প্রধান বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমকে রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত করেন। পরদিন খালেদ মোশাররফ নিহত হন। তখন সেনাপ্রধান পদে আবার আসেন জিয়াউর রহমান। এরপর ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল রাষ্ট্রপতি সায়েমকে সরিয়ে নিজেই রাষ্ট্রপতি হন মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান। এর এক বছর পর গণভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন তিনি। ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামে এক ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানে নিহত হন জিয়াউর রহমান। তার মৃত্যুর পর রাষ্ট্রপতি হন আবদুস সাত্তার। তবে বেশিদিন ওই পদে থাকেননি তিনি। এক বছর পর সেনাপ্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে তার শাসনামল শেষ হয় ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর। এছাড়া অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে সাহাবুদ্দীন আহমদ, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে বিচারপতি হাবিবুর রহমান, বিচারপতি লতিফুর রহমান, অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিন আহমেদ ও ড. ফখরুদ্দিন আহমেদ দায়িত্ব পালন করে পরবর্তী সরকারের হাতে দায়িত্ব হস্তান্তর করেন।
১৯৯৬ সালের ২৩ জুন প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন শেখ হাসিনা। এরপর ২০০৮ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত টানা তিন মেয়াদে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বড় মেয়ে শেখ হাসিনা। ১৯৪৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় তার জন্ম। শিক্ষাজীবন থেকেই রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হন। সে সময় শেখ হাসিনা ও তার বোন শেখ রেহানা বিদেশে থাকায় বেঁচে যান। ছয় বছর নির্বাসিত জীবন শেষে ১৯৮১ সালে ১৭ মে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হিসেবেই দেশে ফেরেন তিনি।