ইয়ামিনুল হাসান আলিফ
আগস্ট ২১, ২০২৪, ০৩:২৩ পিএম
ইয়ামিনুল হাসান আলিফ
আগস্ট ২১, ২০২৪, ০৩:২৩ পিএম
রাজধানীবাসীর নাগরিক সুবিধা নিশ্চিতে কাজ করছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। আর এই রাজউকে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই চলছে দুর্নীতি-অনিয়ম ও ঘুসবাণিজ্য। অভিযোগ রয়েছে, কর্মচারী থেকে অনেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে টাকা না দিলে এক টেবিল থেকে আরেক টেবিলে নড়ে না কোনো ফাইল। রাজউকের সেবা আর ঘুস-দুর্নীতি যেন ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সেবাগ্রহীতারা বিষয়গুলো জেনেও কিছুই করতে পারছেন না। বিভিন্ন সময় কর্মচারীদের বিপুল সম্পদের বিষয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হলেও মূল কুশীলবরা থাকে ধরাছোঁয়ার বাইরে। আওয়ামী লীগের দীর্ঘমেয়াদি ক্ষমতায় থাকায় রাজউকের বিভিন্ন স্তরে দাপটে ছিলেন ওইসব সরকার সমর্থক। অনেক কর্মচারীও কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। ভবনের প্ল্যান পাস, অনুমোদনবিহীন নকশাবহির্ভূত ভবন ভাঙা, প্লট হস্তান্তর, প্লটের শ্রেণি পরিবর্তন, নকশা অনুমোদন— সব জায়গাতেই চলে ঘুুসের খেলা।
নতুন ভবনের প্ল্যান পাস করতে দিতে হয় চা-পানি তথা নাশতার খরচ। সেই নাস্তার খরচ গিয়ে ঠেকে ৫, ১০, ১৫ লাখ টাকায়ও।
২০১৯ সালে রাজউকের দুর্নীতি কমাতে অনলাইনে নিবন্ধন ও আবেদন কার্যক্রম শুরু করা হয়। হাতে হাতে নেয়ার পরিবর্তে ভূমি ব্যবহারের ছাড়পত্র ও ভবনের নকশা অনুমোদন প্রক্রিয়া ওয়েবসাইটেই সম্পন্ন করা হয়। কিন্তু এরপরও ঠেকানো যায়নি দুর্নীতি। অনলাইনে সেবা চালু হওয়ার পরও উৎকোচ বন্ধ হয়নি; বরং অভিনব উপায়ে বেড়েছে দুর্নীতি। কর্মচারী-কর্মকর্তাদের পাশাপাশি দৌরাত্ম্য বেড়েছে দালালদের। এসব মিডলম্যানকে ব্যবহার করে ঘুসের রমরমা ব্যবসা চলছে রাজউকে। অনলাইনে আবেদন প্রক্রিয়া চললেও কাজ শেষ হতে বিলম্ব হয়, থাকে ফাইল আটকে। এরপর সেই ফাইল পাস করতে আবির্ভূত হয় দালালরা। বিভিন্ন ফাইল পাস করাতে ক্ষেত্রবিশেষে পাঁচ লাখ থেকে ১৫ লাখ টাকার প্রয়োজন হয়। এমন একটি মিডলম্যানের হোয়াটসঅ্যাপের স্ক্রিনশট আসে আমার সংবাদের হাতে। রাজিব নামে ওই মিডলম্যান ফাইল এক টেবিল থেকে আরেক টেবিলে নিতে টাকা বিনিময়ের কথা বলেন। উঠে আসে রাজউকের কর্মকর্তা আশুতোষ ও ৬নং জোনের পরিচালক সালেহ আহমেদ জাকারিয়ার নাম। বিষয়টি নিয়ে আমার সংবাদের সঙ্গে কথা হয় সালেহ আহমেদ জাকারিয়ার। রাজিব নামে কাউকে তিনি চেনেন কী না জানতে চাইলে তিনি তা অস্বীকার করেন। তার নাম ভাঙিয়ে কেউ অপরাধ করলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলেও জানান তিনি। তবে রাজিব নামে ওই মিডলম্যান যে ৬নং জোনের পরিচালকের হয়ে কাজ করেন, সে বিষয়ে রাজউকের একাধিক কর্মচারী নিশ্চিত করেন। হোয়াটসঅ্যাপে উঠে আসা আরেক কর্মকর্তা আশুতোষ মিডলম্যানের বিষয়টি স্বীকার করে আমার সংবাদকে বলেন, টাকা এককভাবে নেয়ার সুযোগ নেই। এখানে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মিডলম্যানরা কাজ করে থাকে।
বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধান করে আমার সংবাদ। আর এতেই কেচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে আসে। রাজউকের লিফটম্যান তোফায়েল আহমেদ শিকদার সৎ ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত। এ বছর পেয়েছেন শুদ্ধাচার পুরস্কার। আমার সংবাদ তার কাছেই পরিচয় গোপন করে সহযোগিতা চাইলে তিনি রাজি হলেন সহযোগিতা করতে। বললেন, চা-পানি-নাশতার খরচেই হয়ে যাবে কাজ। নিয়ে যাওয়া হলো আরেক লিফটম্যান কুদ্দুস মিয়ার কাছে। ছাড়পত্র ও প্ল্যান পাসের সব কাজ করে দেবেন কুদ্দুস মিয়া নিজেই। এ জন্য চা-নাশতা বাবদ দিতে হবে পাঁচ লাখ টাকা। এ সময় সরকারি ফি কত জানতে চাইলে জানান, ফি লাগে ১০ হাজার টাকা। বাকি টাকা লাগবে টেবিল পার করতে। তিনি জানান, মিরপুর-১২সহ একাধিক জায়গার জন্য তিনি এ কাজ করে থাকেন। পাঁচ লাখ টাকার নিচে কাজ করা সম্ভব নয়। দালালরা হলে আরও বেশি দিতে হয়।
ভালো কাজের জন্য শুদ্ধাচার পুরস্কারজয়ী কর্মচারীর কাজের নমুনা দেখেই বোঝা যায় পুরো রাজউকের চিত্র। এর অনেকটাই উঠে এসেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) একটি প্রতিবেদনে। ২০২০ সালের সেই প্রতিবেদন ঘিরে তৎকালীন সময়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়। গবেষণায় বেরিয়ে আসে ফাইল পাস করতে কোটি টাকা ঘুসবাণিজ্যের বিষয়টি। টিআইবির গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, অধিকাংশ ক্ষেত্রে রাজউক কর্মকর্তা, দালাল ও সেবাগ্রহীতার মধ্যে ত্রিপক্ষীয় আঁতাতের মাধ্যমে চুক্তি করে সুনির্দিষ্ট হারে নিয়মবহির্ভূত টাকা নেয়া হয়। ছাড়পত্র অনুমোদনে ব্যক্তি পর্যায়ে ১৫ হাজার থেকে ৮০ হাজার টাকা পর্যন্ত এবং রিয়েল এস্টেট-ডেভেলপার পর্যায়ে এক লাখ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত দিতে হয়। সেবাগ্রহীতারা ইমারত নকশা অনুমোদনের সেবা গ্রহণেও নির্ধারিত ফি’র অতিরিক্ত অর্থ দিতে বাধ্য হন। ব্যক্তি পর্যায়ে ১০ তলা পর্যন্ত ইমারতের নকশা অনুমোদনে ফি’র অতিরিক্ত ৫০ হাজার থেকে চার লাখ ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত এবং রিয়েল এস্টেট-ডেভেলপার পর্যায়ে দুই লাখ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত আদায় করা হয়। আবার ১০ তলার ঊর্ধ্বের ইমারতের নকশা অনুমোদনে রিয়েল এস্টেট-ডেভেলপার পর্যায়ে ফি’র অতিরিক্ত ১৫ লাখ থেকে ৪০ লাখ টাকা পর্যন্ত আদায় করা হয়। বৃহদায়তন বা বিশেষ প্রকল্পের ক্ষেত্রে রিয়েল এস্টেট-ডেভেলপার পর্যায়ে অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের পরিমাণ ১৫ লাখ থেকে দুই কোটি টাকা পর্যন্ত পৌঁছায়।
এদিকে আমার সংবাদের অনুসন্ধানের বিষয়ে উঠে আসা বিষয়গুলো সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে রাজউকে দালালদের দৌরাত্ম্যের কথা স্বীকার করে রাজউক চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) মো. ছিদ্দিকুর রহমান সরকার বলেন, আমি কয়েক মাস হলো দায়িত্ব নিয়েছি। এখন প্ল্যান পাসের হার্ডকপি লাগে না। অনেকটাই চেষ্টা করেছি এগুলো কমিয়ে আনার; বর্তমানে কমে আসছে। কিন্তু এগুলো অনেক ডিফিকাল্ট। তথ্যগুলো দিন; আমরা এসব বিষয়ে সিরিয়াস। অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে।
অভিযুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিষয়ে তিনি বলেন, বিষয়টি ভেরি আনফরচুনেট। লোয়ার লেভেল থেকে সবাই প্রশংসা করেছিলেন তার (শুদ্ধাচার পুরস্কারজয়ী তোফায়েল আহমেদ বিষয়ে)। সঠিক তথ্য পেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।