আনোয়ার হোসাইন সোহেল
আগস্ট ২৬, ২০২৪, ০৪:৪০ পিএম
আনোয়ার হোসাইন সোহেল
আগস্ট ২৬, ২০২৪, ০৪:৪০ পিএম
বাংলাদেশ ব্যাংকের বিতর্কিত দুই নির্বাহী পরিচালক দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতা ও দুর্নীতির বলয়ের মধ্যে ছিলেন। এবার ক্ষমতাধর ওই দুই নির্বাহী পরিচালক ডেপুটি গভর্নর হতে মরিয়ে হয়ে উঠেছে। তারা হলেন সাইফুল ইসলাম ও মো. মেজবাউল হক। বাংলাদেশ ব্যাংকের পদচ্যুত ডেপুটি গভর্নর কাজী ছাইদুর রহমানের অবৈধ ক্ষমতাবলয়ের অন্যতম সহযোগী হিসেবে কাজ করেছেন নির্বাহী পরিচালক সাইফুল ইসলাম। দীর্ঘদিনের ব্যাংকিং প্রবিধি নীতি ও নীতি বিভাগের কাজের সূত্রে ‘ব্যাংক খাতের মাফিয়া’ চট্টগ্রামভিত্তিক এস আলম গ্রুপ, বেক্সিমকো গ্রুপ, বসুন্ধরা গ্রুপ, থার্মেক্স গ্রুপের সঙ্গে গড়ে তুলেছেন সখ্য। এমনকি এস আলমসহ বিভিন্ন গ্রুপকে অনৈতিক সুবিধা দিতে প্রয়োজনে ব্যাংকিং আইন ও নিয়মনীতি পরিবর্তন করে দিতেন সাইফুল ইসলাম।
ব্যাংক-সংশ্লিষ্টরা জানান, এস আলম গ্রুপকে ‘ব্যাংক খাতের মাফিয়া’ বানানোর বড় কারিগর এই সাইফুল ইসলাম। তার হাত ধরেই এই গ্রুপের ব্যাংক খাতে আগমন ঘটে। ২০১৬ সালে ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগের উপমহাব্যবস্থাপক থাকাকালীন সময়ে বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক লিমিটেডকে এস আলম গ্রুপের হাতে তুলে দেয়ার ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন তিনি।
এর ফলেই এস আলম গ্রুপের ব্যাংক খাত ডাকাতির হাতেখড়ি হয়। ওই বিভাগের উপমহাব্যবস্থাপক হিসেবে এর ধারাবাহিকতায় ২০১৭ সালে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেডে এস আলমের একই দিনে ব্যাংক দখল ও নতুন বোর্ড গঠনে রাত ১০টার সময়ে অনুমোদন প্রদানের মাধ্যমে সহযোগিতা করেন।
পরবর্তীকালে সাবেক ডেপুটি গভর্নর কাজী ছাইদুর রহমানের আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে পরিচালক হিসেবে ফরেক্স রিজার্ভ অ্যান্ড ট্রেজারি ম্যানেজমেন্ট ডিপার্টমেন্টের দায়িত্ব পান সাইফুল ইসলাম। সেখানেও তিনি বিভিন্ন শিল্পগ্রুপকে বিশেষ সুবিধা পাইয়ে দেয়ার লক্ষ্যে কাজী ছাইদুর রহমানের নেতৃত্বে অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হতে এক্সপোর্ট ডেভেলপমেন্ট ফান্ড (ইডিএফ) তহবিলের আকার বৃদ্ধিতে বড় ভূমিকা রাখেন। কোনো কিছু বাছবিচার না করেই কতিপয় বিতর্কিত শিল্পগ্রুপের অনুকূলে ইডিএফ ঋণ ছাড় করার খেসারত এখন পুরো দেশকেই দিতে হচ্ছে।
ইডিএফ হতে ঋণ নিয়ে অর্থ পাচারের ফলে দেশের রিজার্ভের তহবিলও অনাদায়ি হয়ে পড়েছে। এ তহবিল হতে বেক্সিমকো গ্রুপ নিয়েছে বিপুল পরিমাণ অর্থ, যা ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। এছাড়া রিজার্ভ হতে দেশের গুটিকয়েক গ্রুপের এলসির পেমেন্ট করার ক্ষেত্রেও কলকাঠি নেড়েছেন সাইফুল ইসলাম।
মাঝখানে নির্বাহী পরিচালক হিসেবে সিলেট অফিসের দায়িত্ব পালনের পর কাজী ছাইদুরের সহায়তায় আবারও দায়িত্ব পান ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগের। নতুন দায়িত্ব পেয়ে ব্যাংকিংয়ে ‘ডি গ্রেড’ পাওয়া গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের অনুমোদন নিয়ে বিভিন্ন নীতিমালা জারি করেছেন— যা ব্যাংক খাতের গুড গভর্ন্যান্সকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়েছে।
এছাড়া বেক্সিমকো গ্রুপসহ কতিপয় গোষ্ঠী যাতে ইসলামি বাজার হতে সহজে অর্থ উত্তোলন করতে পারে, সেভাবে সুকুক বন্ডের নীতিমালা প্রণয়নে ওতপ্রোতভাবে ভূমিকা রেখেছেন। এর ফলে বেক্সিমকো গ্রুপ সুকুক বন্ড ইস্যু করে এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রভাব খাটিয়ে বিভিন্ন ব্যাংককে ওই বন্ড কিনতে বাধ্য করে। ওই বন্ড কিনে ব্যাংকগুলো এখন বিপুল পরিমাণ ক্ষতির সম্মুখীন।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আরেক ক্ষমতাধর নির্বাহী পরিচালক ও বর্তমানে ব্যাংকের মুখপাত্রের দায়িত্বে রয়েছেন মো. মেজবাউল হক। তিনি তার ক্ষমতার স্বাক্ষর রেখেছেন বিভিন্ন ক্ষমতাশীল গোষ্ঠীর সহযোগী হয়ে। দীর্ঘদিন যাবৎ পেমেন্ট সিস্টেমস ডিপার্টমেন্টের পরিচালক ও নির্বাহী পরিচালকের দায়িত্ব পালনকালে ২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি ধামাচাপা দেওয়াসহ বেআইনি বিভিন্ন কাজের সঙ্গে তিনি জড়িত ছিলেন, যা ব্যাংকপাড়ায় আলোচনার বিষয়। পেমেন্ট সিস্টেমস ডিপার্টমেন্টের দায়িত্ব পালনের সময় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাপুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ের বেনামি প্রতিষ্ঠান নগদকে মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস (এমএফএস) লাইসেন্স প্রদানের ক্ষেত্রে নীতিমালার কোনো তোয়াক্কা করেননি। এ দীর্ঘ সময়ে নগদ জালিয়াতির মাধ্যমে ই-মানি তৈরি করেছে— যা গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর সম্প্রতি স্বীকার করেছেন। নগদ এমএফএসের বিরুদ্ধে কোনোরূপ তদন্ত যাতে না হয়, তা তিনি নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেছেন। ফলস্বরূপ গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের আমলে নির্বাহী পরিচালক হিসেবে পদোন্নতির পর একই বিভাগের দায়িত্বও পান। এ সময়ে অবৈধ নগদকে বৈধতা দেয়ার জন্য প্রাথমিকভাবে দেয়া হয় আর্থিক প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স। জালিয়াতির ষোলকলা পূর্ণ হয় নগদকে দেশের প্রথম ডিজিটাল ব্যাংকিং লাইসেন্স প্রদানের মাধ্যমে। ডিজিটাল ব্যাংকিং লাইসেন্সের জন্য আবেদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে প্রাথমিক বাছাই কমিটির প্রতিবেদন তালিকার অনেক পেছনে থাকা সত্ত্বেও চূড়ান্ত বাছাইয়ে নগদকে সর্বোচ্চ নম্বর প্রদানের ক্ষেত্রে তিনি ভূমিকা রেখেছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের সিআইবি থাকা সত্ত্বেও সম্প্রতি একটি বিশেষ প্রতিষ্ঠানকে ক্রেডিট ব্যুরো লাইসেন্স দেয়ার উদ্দেশ্যে তার নেতৃত্বেই জারি করা হয়েছে নীতিমালা। মেজবাউল হকের নৈতিক অবক্ষয়ের চূড়ান্ত নজির দেখা যায় নগদ এমএফএসের প্রশাসক নিয়োগের আদেশে, যেখানে প্রশাসক দল সাজানো হয়েছে তার অধীন আস্থাভাজন কর্মকর্তাদের নিয়ে। নগদ এমএফএসে সংঘটিত তাদের দুর্নীতি ধামাচাপা দেয়ার জন্য প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের চট্টগ্রাম অফিসের পরিচালক মুহম্মদ বদিউজ্জামান দিদারকে। নগদ এমএফএসের লাইসেন্স প্রদানের সঙ্গে ?অতিরিক্ত পরিচালক হিসেবে জড়িত ছিলেন এই বদিউজ্জামান দিদার।
এছাড়া প্রশাসক দলের একজন বাদে অন্যান্য কর্মকর্তাও পেমেন্ট সিস্টেমস ডিপার্টমেন্টের। যারা কি-না নগদকে লাইসেন্স প্রদান ও অবৈধ কার্যক্রম চালিয়ে যেতে সহায়তা করেছেন। নগদ এমএফএসের সংঘটিত দুর্নীতি ও জালিয়াতি উদ্ঘাটন করা বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্দেশ্য, নাকি ধামাচাপা দেয়া— সে বিষয়ে বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তিদের মধ্যে প্রশ্ন ওঠাটাই স্বাভাবিক। এ পুরো প্রক্রিয়া গোপনীয়তার সঙ্গে সম্পন্ন করেছেন নির্বাহী পরিচালক মেজবাউল হক। এর ফলে নতুন গভর্নরের ব্যাংক খাত সংস্কারের মতো একটি ভালো উদ্যোগকেও প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে।
গত ৬ আগস্টের পর বাংলাদেশ ব্যাংকে এস আলম-ঘনিষ্ঠ গভর্নর ও ডেপুটি গভর্নরদের পদত্যাগ দাবিতে নজিরবিহীন বিক্ষোভ শুরু করেন বৈষম্যের শিকার কর্মকর্তারা। এরপর সাবেক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার পলাতক অবস্থায় পদত্যাগ করেন। পরে ডেপুটি গভর্নর কাজী ছাইদুর রহমান, খুরশীদ আলম, বিএফআইইউ প্রধান মাসুদ বিশ্বাস ও নীতি উপদেষ্টা আবু ফারাহ মো. নাছের পদত্যাগে বাধ্য হন। এরপর অর্থ মন্ত্রণালয় বাংলাদেশ ব্যাংকের চারজন ডেপুটি গভর্নর পদে নিয়োগ দেয়ার জন্য তিন সদস্যের সার্চ কমিটি গঠন করে। গঠিত সার্চ কমিটির কাছে কয়েকজন নির্বাহী পরিচালক ইতোমধ্যে তাদের সিভি জমা দিয়েছেন। যেখানে নির্বাহী পরিচালক মেজবাউল হক, সাইফুল ইসলাম, নির্বাহী পরিচালক আনোয়ারুল ইসলাম, নির্বাহী পরিচালক কাজী রফিকুল হাসান ও বাংলাদেশ ব্যাংকের চট্টগ্রাম শাখার নির্বাহী পরিচালকের দায়িত্বে থাকা আরেফ হোসাইন খানের নাম রয়েছে।
সোহেল/ইএইচ