Amar Sangbad
ঢাকা রবিবার, ১৭ নভেম্বর, ২০২৪,

পোশাকশিল্পে অস্থিরতা

নিজস্ব প্রতিবেদক

নিজস্ব প্রতিবেদক

সেপ্টেম্বর ৫, ২০২৪, ১২:১০ এএম


পোশাকশিল্পে অস্থিরতা
  • শ্রমিক আন্দোলনে নিরাপত্তাজনিত কারণে সারা দেশে বন্ধ ছিল ১৬৭ কারখানা
  • নিরাপত্তার নিশ্চয়তায় কারখানা খুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত বিজিএমইএর

আন্দোলনের নামে বহিরাগতরা নৈরাজ্য করার চেষ্টা করছে। কারখানা, শ্রমিক ও দেশের অর্থনীতি বাঁচাতে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে
—এ এফ হাসান আরিফ উপদেষ্টা, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়

শ্রমিক অসন্তোষের পেছনে আওয়ামী লীগের লোকজনসহ বহিরাগতরা রয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে অ্যাকশন শুরু হবে
— আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া উপদেষ্টা, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়

গত সপ্তাহ থেকে সাভার ও আশুলিয়ার বিভিন্ন পোশাক কারখানায় নানা দাবিতে শ্রমিকরা বিক্ষোভ করে আসছেন। মালিকপক্ষ তাদের কিছু কিছু দাবি সম্প্রতি মেনেও নেয়। তবে মালিকপক্ষ বলছে, শ্রমিকদের সব দাবি এই মুহূর্তে মেনে নেয়া সম্ভব নয়। শ্রমিকদের সব দাবি মেনে নিতে গতকাল বুধবার আশুলিয়ার জিরাবো, ঘোষবাগ, সরকার মার্কেট, নরসিংহপুর, নিশ্চিন্তপুর ও পল্লীবিদ্যুৎ এলাকায় শ্রমিক বিক্ষোভ শুরু হয়। আন্দোলনের মুখে অন্তত ৬০টি পোশাক কারখানা বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এর জেরে পোশাক কারখানাগুলোতে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়। ছুটি ঘোষণার পর হট্টগোল করেছেন কয়েকটি কারখানার শ্রমিকরা। এতে বিভিন্ন কারখানার শ্রমিকরা উত্তেজিত হয়ে কারখানার সামনে ও সড়কে বিক্ষোভ করেন। জানা গেছে, গতকাল সকালে হা-মীম গার্মেন্টের কয়েক হাজার পোশাক শ্রমিক কাজে যোগ দেন। পরে তাদের কারখানায় হঠাৎ সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়। হা-মীমের শ্রমিকরা শারমিন গার্মেন্টের সামনে গেলে তাদের কারখানার শ্রমিকরাও বের হয়ে আসেন। এরপর জিরাবো, ঘোষবাগ, নরসিংহপুর, নিশ্চিন্তপুর এলাকার যতগুলো পোশাক কারখানা ছিল সেগুলোতে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়। 

আশুলিয়া শিল্প পুলিশ-১ এর পুলিশ সুপার সারোয়ার আলম বলেন, সকালে শ্রমিকরা কাজে যোগ দেন। পরে একটি বড় গার্মেন্ট ছুটি দিলে কয়েক হাজার পোশাক শ্রমিক রাস্তায় নেমে আসেন। তখন অন্তত আরও ৬০টি পোশাক কারখানা সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে। এখন পর্যন্ত কোথাও কোনো বড় ধরনের বিশৃঙ্খলার খবর পাওয়া যায়নি। পুলিশ সুপার বলেন, আমাদের এবং সেনাবাহিনীর সামনে শ্রমিকদের কিছু দাবি মেনে নিয়েছিলেন কারখানা কর্তৃপক্ষ। এখন তারা বলছেন, শ্রমিকদের দাবি মেনে নিতে পারবেন না। এতে শ্রমিকরা উত্তেজিত হয়ে পড়েন। তবে তাদের বুঝিয়ে সড়ক থেকে সরানো হয়েছে বলে জানান শিল্প পুলিশের এই কর্মকর্তা।

এদিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেয়ায় আজ বৃহস্পতিবার থেকে দেশের সব পোশাক কারখানা খোলা রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ)। গতকাল বুধবার বিজিএমইএ, গার্মেন্ট মালিক, সেনাবাহিনী, পুলিশ ও শিল্প পুলিশ ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে আলোচনা করে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিজিএমইএর সভাপতি খন্দকার রফিকুল ইসলাম। বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, ‘শ্রমিক আন্দোলনে ১৬৭টি পোশাক কারখানা বন্ধ ছিল। যদিও এ আন্দোলনে শ্রমিকদের সংশ্লিষ্টতা ছিল না। বহিরাগতদের হামলায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছে। তাই সেনা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কারখানার নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেয়ায় গার্মেন্ট চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মালিকরা। তিনি বলেন, এখন সেনাবাহিনী, শিল্প পুলিশ, গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা কঠোর অবস্থানে থাকবেন। তারা নিরাপত্তা নিশ্চিত করবেন বলে জানিয়েছেন। তাই কাল থেকে পোশাক কারখানা খোলা থাকবে।’

অন্যদিকে গতকাল শ্রমিক অসন্তোষ নিয়ে সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর সভাপতিত্বে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠক শেষে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় উপদেষ্টা এ এফ হাসান আরিফ বলেন, কারখানা, শ্রমিক ও দেশের অর্থনীতি বাঁচাতে গেলে কিছু সংখ্যক ব্যক্তির বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। তিনি বলেন, ‘চারদিকে যে শ্রমিক অসন্তোষ হচ্ছে, তা নিয়ে আজ আমরা বৈঠক করেছি। আমরা খবর পাচ্ছি যে, প্রকৃত শ্রমিক যারা, তারা কেউ নিজের বাড়ি পোড়াবে না, কারণ এখানে তার জীবিকা। এটা বহিরাগতরা এসে করেছেন। তাদের আপনারা (শ্রমিকরা) বাধা দেন, আপনারা তাদের বাধা দিলে আমরাও আপনাদের সঙ্গে থাকব। এমনভাবে তারা মিশে আছে যে তাদের আলাদা করা ডিফিকাল্ট (কঠিন) হয়ে যাচ্ছে।’ স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা বলেন, ‘প্রকৃত শ্রমিকরা এ ধরনের কোনো বিশৃঙ্খলা করছেন না। যেখানে তার জীবিকা, সেখানে তিনি (শ্রমিক) ধ্বংস করবেন না।’ 

তিনি আরও বলেন, ‘স্থানীয় কারখানা নষ্ট হয়ে যাবে, তাহলে কার লাভ হবে? কাজেই শ্রমিকরা কোনো বিশৃঙ্খলা করছেন না। যারা করছেন, তাদের অধিকাংশই বহিরাগত। তাদের কীভাবে মোকাবিলা করা যায়, সে কারণে আমাদের একটু কঠিন হতে হবে। আমরা মনে রেখেছি, সরকার কোনো সময় তার নাগরিকের বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগ করবে না, এটা স্বাভাবিক। কিন্তু এখন এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, কারখানা, শ্রমিক ও দেশের অর্থনীতি বাঁচাতে গেলে কিছু সংখ্যকের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। সে ব্যাপারে আমাদের আলোচনা হয়েছে।’ কী ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সে বিষয়ে আরও চিন্তাভাবনা করতে হবে। তারা গ্রেপ্তার কিংবা আটক হতে পারেন। ৫০ জন রাস্তায় বসে পড়লে পাঁচ লাখ মানুষের অসুবিধা হবে। কাজেই তাদের সরাতে যদি বলপ্রয়োগ করতে হয়, লাঠিপেটা করতে হয়, জলকামান ব্যবহার করতে হলে আমরা সেটা করব।’  

একই বৈঠক শেষে শ্রম ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেন, বিভিন্ন স্থানে শ্রমিক অসন্তোষের পেছনে আওয়ামী লীগের লোকজনসহ বহিরাগতরা রয়েছে। আজ থেকে তাদের বিরুদ্ধে অ্যাকশন শুরু হবে। শ্রমিক অসন্তোষ নিয়ে আমরা মালিক ও শ্রমিকপক্ষের সঙ্গে একাধিক সভা করেছি। আমাদের শিল্প উপদেষ্টা তিনিও কথা বলছেন। সব শ্রমিক নেতার কাছ থেকে আমরা এটাই জানতে পেরেছি, এখন যে আন্দোলনগুলো হচ্ছে, শ্রমিক নেতারা এ আন্দোলনের প্রকৃতিটা নিজেরাও বুঝে উঠতে পারছেন না। কারণ এখানে কোনো নির্দিষ্ট দাবি উঠে আসছে না। কোনো নির্দিষ্ট দফা পাওয়া যাচ্ছে না। ‘যারা সাধারণত শ্রমিক আন্দোলন করেন, তারাও সেখানে সেভাবে নেই। বহিরাগত লোকজনের আধিক্য দেখা যাচ্ছে। কিছু কিছু জায়গায় মালিকপক্ষ বেতন দিতে দেরি করছে, এজন্য আন্দোলন হচ্ছে। কয়েকটি স্পেসিফিক ফ্যাক্টরি আছে সেখানে মালিকপক্ষ পালিয়ে গেছে। সেখানে কিছুটা অসন্তোষ হয়েছে। সেগুলো আমরা অ্যাড্রেস করছি, সেগুলোর জন্য সরকার সফট লোন ঘোষণা দিয়েছে। সেটার পরিধি আরও বাড়ানো হবে।’ তিনি আরও বলেন, তবে এই ছোট ছোট কয়েকটি সুনির্দিষ্ট জায়গায় অসন্তোষকে কেন্দ্র করে যে জায়গাগুলোতে ফ্যাক্টরি ক্লাস্টারগুলো আছে, সেখানে দেখা গেছে বহিরাগতরা এসে এবং বেকার যুব সংঘ নামে যারা কখনো শ্রম এরিয়ার মধ্যে কখনো আন্দোলন করেনি, গাড়ি ভাঙচুরের মতো ঘটনা ঘটেছে। 

আসিফ মাহমুদ বলেন, শ্রমিক নেতারাই আমাকে বললেন যে তারা সেখানে হেঁটে এসেছেন এবং তারা দেখেছেন যে, হেলমেট ও হাফপ্যান্ট পরা যারা টোকাই, যাদের টাকা দিয়ে বিভিন্ন প্রোগ্রামের জন্য ভাড়া করা হয়। তাদের সেখানে দেখা গেছে। যারা ঝুট ব্যবসা নিয়ে সন্ত্রাস করছে, আওয়ামী লীগের লোকেরা যে সিন্ডিকেটগুলো সামলাতো তারা তো সেগুলো ছেড়ে চলে গেছে। এখন যারা সেগুলো দখলের পাঁয়তারা করছে এবং সেখানে সন্ত্রাস করছে, তাদের এবং যারা বহিরাগত তাদের বিরুদ্ধে সরকার কঠোর ব্যবস্থা নেবে, সেটা গতকাল বলেছি। ‘স্থানীয়ভাবে আওয়ামী লীগও আছে কিছু জায়গায়। কিছু স্থানীয় বিএনপি নেতাও রয়েছেন বলে আমরা সংশ্লিষ্টতা পেয়েছি। বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে আমাদের এ বিষয়ে কথা হচ্ছে। তারা যাতে তাদের নিবৃত রাখেন। স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী যেসব আওয়ামী লীগ নেতা এখনো রয়ে গেছেন তাদের বিরুদ্ধে আমরা কঠোর অবস্থানে যাব।’ 

উপদেষ্টা বলেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে যে তথ্য রয়েছে, সেটার ভিত্তিতে তাদের গ্রেপ্তার করা হবে। সেখানে যে জনদুর্ভোগ তৈরি হয়েছে, সেটার জন্য পুলিশ ব্যবস্থা নেবে। পরিস্থিতি কতদিনের মধ্যে স্বাভাবিক হবে বলে মনে করছেন, জানতে চাইলে উপদেষ্টা বলেন, আজ থেকে অ্যাকশন শুরু হবে, সেখানে ক্ষতি হয় এমন কোনো অ্যাকশন পুলিশ নেবে না। রাস্তাগুলো খালি করার জন্য যথাযথ অ্যাকশন নেবে। যারা ইন্ধন জোগাচ্ছে তাদের গ্রেপ্তার করা হবে। আজকের পর থেকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে জানিয়ে আসিফ মাহমুদ বলেন, আমাদের শ্রমিক নেতারা আশ্বস্ত করেছেন, যে শ্রমিকরা আন্দোলন করছে তাদের বোঝাবেন। তাদের সমস্যার সমাধানে আরও বৈঠক করব। সমস্যা সমাধানে মালিক এবং শ্রমিকপক্ষ মিলে এগিয়ে যাব।
 

Link copied!