Amar Sangbad
ঢাকা বুধবার, ০৬ নভেম্বর, ২০২৪,

দেড় লাখ গায়েবি মামলায় আসামি ৬০ লাখ

আবদুর রহিম

সেপ্টেম্বর ১৯, ২০২৪, ১১:২১ পিএম


দেড় লাখ গায়েবি মামলায় আসামি ৬০ লাখ

২০০৯ সাল থেকে ২০২৪-এর চলতি সময় পর্যন্ত সাবেক তিনবারের প্রধানমন্ত্রী বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ সারা দেশে মামলার সংখ্যা প্রায় এক লাখ ৫৫ হাজার ১০০’র বেশি। আসামি নামে ও গায়েবি সংখ্যায় প্রায় ৬০ লাখের বেশি। গত ১৫ জুলাই থেকে ২০২৪-এর সাম্প্রতিক সময়ে প্রায় ১১ হাজার গ্রেপ্তার হয়েছেন। গুম হয়েছেন ৭০০ এবং খুন হয়েছেন এক হাজার ৫৫১ জন। গ্রেপ্তার তিন লাখ দুই হাজারেরও বেশি। দলের আইনজীবী ফোরাম ও মিডিয়া সেল আমার সংবাদককে এ তথ্য নিশ্চিত করেন। বিএনপিকে নিশ্চিহ্ন করতে ১৬ বছর ধরে আওয়ামী লীগ এসব বিচারবহির্ভূত হত্যা, গায়েবি মামলা ও নৃশংস নিপীড়ন করেছে বলে দলটির অভিযোগ।  

এ বিষয়ে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ড. আসাদুজ্জামান রিপন আমার সংবাদকে বলেন, আওয়ামী লীগ গত ১৬ বছরে বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দেড় লাখের অধিক যে মামলা দিয়েছে, তার একটিরও কোনো সত্যতা নেই। সবই গায়েবি মামলা।  ৫০-৬০ লাখ আসামি। এখন ওই মামলার নির্দেশদাতারা পলাতক। আওয়ামী লীগের নির্দেশে অতিউৎসাহী যেসব পুলিশ মামলা দায়ের করেছে, তারাও এখন কর্মস্থলে অনুপস্থিত। তাই আমরা বর্তমান সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কাছে আহ্বান জানাব, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলাগুলো যেন প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। গত ১৬ বছর ধরে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের ওপর দমন-নিপীড়ন চালানো হয়েছে। স্বৈরাচার সরকারের উদ্দেশ ছিল মামলা দিয়ে বিএনপি নেতাকর্মীদের দমিয়ে রাখা। তাই গায়েবি মামলাগুলো এখন প্রত্যাহার করে নেয়া উচিত বলে মনে করছি। তবে আমরা দু-একটি মামলা নিয়ে লড়তে চাই। এ মামলাগুলোর প্রকৃত হুকুমদাতা কে— তা নিশ্চিত করতে আমাদের আগ্রহ রয়েছে। 

বিএনপির দপ্তর সূত্র বলছে, ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময়ে সবশেষ গত ১৭ জুলাই বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ডিবি পুলিশের অভিযানের নামে মঞ্চায়িত হয় সাজানো নাটক, বলপূর্বক বন্ধ করা হয় কার্যালয়ের কার্যক্রম। বাসায় বাসায় অভিযান চালিয়ে বিএনপির অর্ধশত প্রথম সারির নেতাসহ তিন হাজারের বেশি নেতাকর্মীকে স্বল্পসময়ের মধ্যে গ্রেপ্তার করা হয়। এতে গ্রেপ্তার হন স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী এবং কেন্দ্রীয় নেতা রুহুল কবির রিজভী, জহিরউদ্দিন স্বপন, শহীদ উদ্দিন এ্যানী, শিমুল বিশ্বাস, আমান উল্লাহ আমান, রশিদুজ্জামান মিল্লাত, ডা. ফরহাদ হালিম ডোনার, ডা. রফিকুল ইসলাম, নাসিরউদ্দিন অসীম, সাইফুল ইসলাম নীরব, আমিনুল হক, সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, মীর নেওয়াজ, নিপুণ রায় চৌধুরী, ডা. শাখাওয়াত শায়ন্তসহ আরও অনেক সক্রিয় নেতা।  

দলটি বলছে, গণগ্রেপ্তার প্রমাণ করে যে, স্বৈরাচারের পতন ঠেকাতে আওয়ামী লীগ বরাবরের মতোই বিএনপিকে প্রধান প্রতিপক্ষ হিসেবে চিহ্নিত করে এবং আন্দোলনকে দমন করতে নিপীড়নের মাত্রা বাড়ায়। বহুমাত্রিক নিপীড়ন মোকাবিলা করেই বিএনপি নিরবচ্ছিন্নভাবে রাজপথের অগ্রভাগে ছিল। বিশেষত আগস্টের ৪ ও ৫ তারিখে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করে শেখ হাসিনাকে পদত্যাগে বাধ্য করার সংগ্রামে জীবন দেন ঢাকা মহানগর পূর্ব ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুর রহমান রাসেল, জালাল উদ্দিন ডিগ্রি কলেজের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আসিফ হোসেন, সোনারগাঁ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদল নেতা রাসেল মাহমুদ, যশোর জেলা ছাত্রদল নেতা সাকিবুল হাসান মাহি প্রমুখ। এভাবে শুধু ছাত্রদল থেকেই একে একে কমপক্ষে ১১৩টি তাজা প্রাণ ঝরে পড়ে ছাত্র-জনতার সফল অভ্যুত্থানে।

সাভারের আশুলিয়ায় গুলি করে হত্যার পর লাশগুলো ভ্যানে স্তূপ করে গানপাউডার দিয়ে পুড়িয়ে ফেলে পুলিশ, যার মধ্যে জাতীয়তাবাদী টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার্স অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য সাজ্জাদ হোসেন সজলও ছিলেন। ক্ষমতা কুক্ষিগত রাখতে এ ধরনের বর্বরতা কেবল কিছু জীবনকে নিঃশেষ করা নয়, বরং মানবতার ওপর একটি গভীর আঘাতও। শুধু তা-ই নয়, গণঅভ্যুত্থানের সময় পুলিশের গুলিতে শতাধিক বিএনপি নেতাকর্মী দৃষ্টিশক্তি হারান, যার মধ্যে রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলাতেই তুষার, হারেস, শাহজালালসহ ছয়জন ছিলেন।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, জুলাই-আগস্ট মাসে সমগ্র বাংলাদেশের এক দফা দাবি আর বিএনপির ত্যাগের পটভূমি সৃষ্টি হয়েছে এক যুগেরও বেশি সময় ধরে। উত্তাল রাজপথে এ পুরোটা সময় গুম-খুন, হামলা-মামলা, দমন-দুর্বৃত্তায়নের শিকার হয়েও জনগণের প্রতিবাদের প্রতিনিধি হিসেবে রক্তস্নাত সংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়ে এসেছে বিএনপি। রাজনৈতিক হয়রানির অংশ হিসেবে, গায়েবি মামলায় সর্বস্তরের নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদোহিতা, হত্যা, নাশকতা, জঙ্গিবাদ, দুর্নীতিসহ নানা বানোয়াট ও মিথ্যা অভিযোগ দেয়া হয়।  

প্রহসনের মামলা ও সাজানো রায়ের মাধ্যমে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে আটক করে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা। অন্যায়ভাবে তার বাড়ি কেড়ে নিয়ে ভেঙে দেয়া হয় এবং নির্জন-পরিত্যক্ত কারাগারে একমাত্র বন্দি হিসেবে রেখে তাকে প্রাপ্য চিকিৎসা থেকেও বঞ্চিত করা হয়। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধে ৫০টিরও বেশি বানোয়াট মামলা করা হয়। তার নির্বাসিত জীবনে বাকস্বাধীনতা হরণের পাশাপাশি অবৈধভাবে চাকরিচ্যুত করা হয় তার চিকিৎসক স্ত্রীকেও। একজন অরাজনৈতিক ব্যক্তি হওয়া সত্ত্বেও তার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলায় পাতানো সাজা ঘোষণা করা হয়।

মির্জা ফখরুল আরও বলেন, আমার বিরুদ্ধে ৯৩টি মামলা দায়ের করা হয়। মির্জা আব্বাস ও গয়েশ্বর চন্দ্র রায়সহ বিএনপির স্থায়ী কমিটির সব সদস্যের বিরুদ্ধেও গণহারে গায়েবি মামলা করা হয়। এমনকি সালাহউদ্দিন আহমেদকে গুম করে দেশের সীমানা পেরিয়ে ভারতের মেঘালয়ে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখানেই অসুস্থ অবস্থায় উদ্ধার হন তিনি। বিগত ১৭ বছরে বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্যসহ অসংখ্য নেতাকর্মী বিভিন্ন মেয়াদে কারাবরণ করেন।  

দলটির নেতাকর্মীরা বলছেন, হাজার হাজার বিএনপি নেতা আছেন, যারা একেকজন শতাধিক মামলার বেড়াজালে আবদ্ধ। মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, এসএম জাহাঙ্গীর, রাজীব আহসানের মতো অনেকের বিরুদ্ধে রয়েছে ২০০-এর অধিক মামলা। সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, রফিকুল ইসলাম মজনু, সাইফুল আলম নীরব, ইসহাক সরকারসহ অনেকের বিরুদ্ধে রয়েছে ৩০০’রও বেশি মামলা। হাবিব উন নবী সোহেলের বিরুদ্ধে রয়েছে রেকর্ড ৪৫১টি মামলা। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও বিচার বিভাগকে ব্যবহার করে এমন অবিচার বিশ্বের অন্য কোথাও হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই। গত এক দশক ধরে বিএনপি নেতাকর্মীরা সপ্তাহের পাঁচ কার্যদিবস বিভিন্ন আদালতে হাজিরা দিয়ে এক অস্বাভাবিক জীবন কাটিয়েছেন। সব অত্যাচার-নির্যাতন সত্ত্বেও নিজেদের জীবন উৎসর্গ করে তারা দেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের জন্য অবিচল সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন। 

এমনকি বিএনপির সেসব নবীন কর্মী, যারা এখনো কোনো পদে আসেননি, শুধু বিএনপির আদর্শে বিশ্বাসী বলে তারাও রাজনৈতিক জিঘাংসার শিকার হয়েছেন। তারুণ্যকে স্বপ্ন দেখানো এসব উদীয়মান নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে বানোয়াট মামলা দায়ের করে তাদের শিক্ষা ও কর্মজীবনকে ধ্বংস করে দিয়েছে আওয়ামী সরকার। তাদের রিমান্ডে নিয়ে বীভৎস নির্যাতন করা হয়েছে। 

অস্বাভাবিক নিপীড়নের শিকার হয়ে ইলিয়াস আলী, সাইফুল ইসলাম হিরু, চৌধুরী আলম, হুমায়ুন পারভেজ, সাজেদুল ইসলাম সুমন, জাকিরসহ কেবল বিএনপির ৪২৩ নেতাকর্মী এবং সব রাজনৈতিক দল ও সাধারণ মানুষ মিলিয়ে প্রায় ৭০০ জন গুম হয়েছেন। রাজধানীর খিলগাঁওয়ে ছাত্রদল নেতা নুরুজ্জামান জনিকে পুলিশ ১৫টি গুলি করে হত্যা করা হয়। তার বুকে ও পেটে থাকা ক্ষতচিহ্নগুলো সেই নির্মমতার নীরব সাক্ষী হয়ে ছিল। চট্টগ্রামে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সহসাধারণ সম্পাদক নুরুল আলমের চোখ, হাত-পা বাঁধা লাশ পাওয়া যায় কর্ণফুলী নদীর তীরে। বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের সফল সংগঠকদের রাতের আঁধারে যেভাবে হত্যা করা হয়, তা বর্বরতার কালো অধ্যায় হিসেবে ইতিহাসে থেকে যাবে।

দলটির দপ্তরের দাবি, কুমিল্লায় ছাত্রদল নেতা পারভেজ হোসেনকে হত্যা করে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা আর ছাত্রলীগ-যুবলীগের গুলিতে শেরপুরে পাকুরিয়া ইউনিয়ন ছাত্রদল নেতা মাহবুব আলম নিহত হন। কারাবন্দি নাসিরুদ্দিন পিন্টু ও বিএম বাকির হোসেনকে হত্যার মাধ্যমে যে নৃশংস সংস্কৃতি সূচনা করে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা, তারই ধারাবাহিকতায় রংপুরের লক্ষ্মীটারী ইউনিয়নের বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক মনোয়ারুল ইসলামসহ অন্তত আরও ২০ বিএনপি নেতাকে নির্যাতনের মাধ্যমে কারাগারে খুন করা হয়। এসব হূদয়বিদারক ঘটনায় ২০১৩ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হন বিএনপির এক হাজার ৫৫১ নেতাকর্মী। 

নেতাকর্মীরা বলছেন, ফ্যাসিবাদের সময়জুড়েই বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা মধ্যযুগীয় নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। গাজীপুরের বোয়ালী ইউনিয়ন বিএনপি সভাপতি আলী আজম, যিনি মায়ের জানাজায় অংশ নিতে গিয়েছিলেন, তাঁকে হাতকড়া ও ডাণ্ডাবেড়ি বেঁধে ইমামতি করতে বাধ্য করা হয়। পটুয়াখালীর ছাত্রদল নেতা নাজমুল মৃধাকে বাবার জানাজায় ডাণ্ডাবেড়ি পরিয়ে অংশগ্রহণ করানো হয়। একজন সন্তানের জন্য এরচেয়ে বড় গ্লানি আর কী হতে পারে!
জাতীয় হূদরোগ ইনস্টিটিউটে যশোর যুবদলের সহসভাপতি আমিনুর রহমান চিকিৎসাধীন অবস্থায় দুই পায়ে ডাণ্ডাবেড়ি পরে মেঝেতে কাতরাচ্ছেন— এ দৃশ্য আজও জাতির বিবেককে তাড়িয়ে বেড়ায়। চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রদলের সহ-সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলামকে তুলে নিয়ে তার বাম পায়ে শটগান ঠেকিয়ে গুলি করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, যার ফলে তার পুরো পা কেটে ফেলতে হয়। ফ্যাসিবাদের দোসরদের অজস্র নৃশংসতা বিএনপির তৃণমূল কর্মীদের এভাবেই পঙ্গুত্বের দিকে ঠেলে দেয়া হয়; এর ফলে ধ্বংস করে দেয়া হয় একেকটি পরিবারের স্বপ্ন।

শুধু বিএনপির রাজনীতি করার অপরাধে  কিশোরগঞ্জে পৌর বিএনপির সভাপতি আমিনুল ইসলাম আশফাককে না পেয়ে পুলিশ তার নিষ্পাপ যমজ দুই ছেলেকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়। সিরাজগঞ্জে ছাত্রদল নেতা হারুনর রশিদকে না পেয়ে পুলিশ তার অসুস্থ বাবাকে তুলে নিয়ে যায়। পঞ্চগড়ে জেলা যুবদলের সাধারণ সম্পাদক নুরুজ্জামান বাবুকে না পেয়ে পুলিশ তার পরিবারের সঙ্গে অশালীন ও অসদাচরণ করে। নোয়াখালীর সুবর্ণচরে বিএনপির পক্ষে ভোট দেয়ায় আ.লীগ কর্মীদের হাতে গণধর্ষণের শিকার হন এক নারী। এগুলো বর্বরতার কয়েকটি উদাহরণ মাত্র, যা বিএনপি নেতাকর্মী-সমর্থকদের ওপর বছরের পর বছর ধরে চলে আসা অগণিত নির্যাতনের ভয়াবহ চিত্রই প্রকাশ পায়।
 

Link copied!