অক্টোবর ১৫, ২০২৪, ১১:৩৬ পিএম
জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় পার্টি, ইসলামিক ও বাম দলগুলো এবং দেশের সুশীল-বুদ্ধিজীবীদের বড় একটি অংশ আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ পদ্ধতির পরিবর্তে আনুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচনব্যবস্থার দাবি তুলেছে। এই অংশ মনে করছে, আনুপাতিক হারে নির্বাচন করলে দেশে আর স্বৈরশাসকের ভূমিকায় কেউ দাঁড়াতে পারবে না। সংসদে সব দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে দেশের কল্যাণ ও ছাত্র-জনতার অধিকার প্রতিষ্ঠা হবে। তবে এ ক্ষেত্রে ভিন্নমত পোষণ করেছে দেশের বৃহৎ রাজনৈতিক দল, তিনবার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকা বিএনপি। সম্প্রতি দলটির মহাসচিব জানিয়েছেন, তারা আনুপাতিক নির্বাচনকে সমর্থন জানাবেন না। এটা এই দেশের সংস্কৃতিতে নেই। অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন রয়েছে। তবে দেশের বুদ্ধিজীবী অংশ থেকে বলা হচ্ছে, বাংলাদেশে আসনভিত্তিক নির্বাচন হয়। যিনি সর্বোচ্চ ভোট পান, তিনিই এমপি হন; অন্যরা কিছুই হন না। এ ক্ষেত্রে যিনি আসনভিত্তিক দ্বিতীয়-তৃতীয় হবেন, তার দলেরও অংশগ্রহণ থাকবে সংসদীয় কাঠামোতে। এতে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হবে। প্রতিটি দল যত ভোট পাবে, তার ভিত্তিতে সংসদে প্রতিনিধিত্ব করবে।
গত শনিবার রাজধানীতে একটি সেমিনারে বিএনপি, সিপিবি, জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় পার্টি, এবি পার্টি, গণসংহতি আন্দোলন ও গণঅধিকার পরিষদের প্রতিনিধিরা বক্তব্য দেন। এর মধ্যে বিএনপি ছাড়া অন্য দলগুলো আনুপাতিক পদ্ধতির পক্ষে নিজেদের মত দেয়। গত ৯ অক্টোবর হোটেল ওয়েস্টিনে রাষ্ট্র সংস্কার প্রস্তাবনায় জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের বলেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক ব্যবস্থা চালু করতে হবে এবং ইভিএম ভোটিং সিস্টেম বাতিলের প্রস্তাবও দেন তিনি। ওই দাবির পর থেকে বিভিন্ন অঙ্গন থেকে আনুপাতিক হারে ভোটের পক্ষে দাবি উঠতে থাকে। এ নিয়ে বিএনপি হাইকমান্ডের নেতারা বলছেন, নির্বাচনি সংস্কারের নামে আগামী সংসদ নির্বাচনে ভোটের আনুপাতিক হারে আসন বণ্টনের যে দাবি তোলা হয়েছে, তার পেছনে ভিনদেশি এজেন্ডা রয়েছে। অতীতেও ভিনদেশি এজেন্ডার কারণে দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ভোটের আনুপাতিক হারে আসন বণ্টনের যে দাবি, এটা আওয়ামী লীগকে রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য অন্য কারো প্রকল্প হতে পারে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলটি যাতে অংশ নিতে পারে এবং আনুপাতিক ভোটের মাধ্যমে সংসদে আসন পেতে পারে, সে ছক এঁকেই কেউ কেউ কাজ করছেন। এ ছাড়া যে দলগুলো ভোটে দাঁড়ালে জামানত হারাতে পারে, সেসব দলের ব্যক্তিরাও রাজনৈতিক কারণে সুযোগ পেয়ে যাবেন। এতে করে জনগণের কার্যত রায় বাস্তবায়ন হবে না। দাবি তোলা হচ্ছে, অনেক বাম দল আছে যারা নির্বাচনে দাঁড়িয়ে নিজেদের জামানত হারায়, সেসব নামকাওয়াস্তের দলের নেতারাও ৩০০ আসনে প্রার্থী দিয়ে দু-একটি আসনের লোভে তলে তলে নির্বাচন কমিশন সংস্কার আনুপাতিক ভোটের পক্ষে।
সম্প্রতি এ নিয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, বিরাজমান নির্বাচন পদ্ধতির পরিবর্তে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বভিত্তিক নির্বাচনের চর্চা বাংলাদেশে কখনো হয়নি। এটা এই দেশে কাজে দেবে না। এটা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন রয়েছে। আমরা এটাকে সমর্থন করব না। সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর সংলাপে আবারও সামনে এসেছে সংসদে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থার বিষয়টি। সম্প্রতি কয়েকটি দল প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে বিষয়টি উপস্থাপন করায় রাজনীতিতে নতুন করে আলোচনায় এসেছে। নব্বই দশক থেকে, বিশেষ করে ১৯৯৪ সালের পর তৎকালীন বাম গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের আলোচনায় জাতীয় সংসদে আনুপাতিক পদ্ধতির নির্বাচনের কথা আছে। তখন থেকেই বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) ও বামজোট আনুপাতিক নির্বাচনের কথা তুলে ধরে।
জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের (এনডিএম) চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজ বলেন, নির্বাচনি ব্যবস্থা সংস্কারের দাবি সবার। এ দাবির মধ্যে রয়েছে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্ট প্রতিষ্ঠা করা। এ দাবি বিএনপিরও। এর বাইরে ভোটের আনুপাতিক হারে আসন বণ্টনের যে কথা হচ্ছে, এটা সঠিক হবে না। বর্তমানে যে পদ্ধতিতে নির্বাচন হয়, যার যার আসনে যে বেশি ভোট পাবেন, তিনিই নির্বাচিত হবেন— এটাই সঠিক পদ্ধতি। তবে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্ট চালু হওয়ার পর উচ্চকক্ষের জন্য এ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হতে পারে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ লেবার পার্টির চেয়ারম্যান ডা. মোস্তাফিজুর রহমান ইরান বলেন, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা চলে যাওয়ার পর থেকে বাংলাদেশকে নিয়ে দেশি-বিদেশি নানান চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র চলছে। আওয়ামী লীগকে এ দেশের রাজনীতিতে পুনর্বাসন করতে দেশি কিছু দালাল যেমন কাজ করছে, তেমনি ভারতও তাদের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। শ্রমিক আন্দোলন, পার্বত্য চট্টগ্রাম অস্থিতিশীল করাসহ আরও নানামুখী ষড়যন্ত্র ভারত করে যাচ্ছে। এখন তাদের এ দেশীয় দালালদের মাধ্যমে নির্বাচনি ব্যবস্থা সংস্কারের নামে ভোটের আনুপাতিক হারে আসন বণ্টনের দাবি তুলছে। এটা পতিত আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের একটি মিশন। আমাদের আশেপাশের কোনো দেশেই এমন নির্বাচনি ব্যবস্থা নেই। এমনকি যে ভারত এ দেশে এমন ব্যবস্থা চালু করার ষড়যন্ত্র করছে, তাদের দেশেও এমন ব্যবস্থা নেই। তাই আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের জন্য যে সূক্ষ্ম এজেন্ডা বাস্তবায়নের প্রক্রিয়ার কথা বলা হচ্ছে, তা আমরা চাই না। এদেশের ছাত্র-জনতা যে প্রত্যাশা নিয়ে বিপ্লব করেছে, তাদের সে প্রত্যাশা হলো একটি গণতান্ত্রিক সাম্যের দেশ প্রতিষ্ঠা। আর সেটার জন্য দ্রুত একটি নির্বাচন প্রয়োজন।
নির্বাচনি গবেষক অধ্যাপক ড. নজরুল ইসলাম বলেন, দেশে যাতে একনায়কত্বের পুনরাবৃত্তি না ঘটে, তা নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সবাই একমত। সে লক্ষ্যে বিভিন্ন প্রস্তাবও উত্থাপিত হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে যে সংস্কারটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ, তা হলো বর্তমান ‘উইনার টেকস অল’ (বিজয়ীর সব পাওয়া-বিসপা) ভিত্তিক নির্বাচন ব্যবস্থার পরিবর্তে আনুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থার প্রবর্তন। আনুপাতিক নির্বাচনে কোনো দলের পক্ষে সামান্য কয়েক শতাংশ ভোট বেশি পাওয়ার কারণে সংসদের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে একনায়কতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে না। অন্যদিকে কোনো দল কিছু শতাংশ কম ভোট পেলেও সংসদে তার ভোট-অনুপাত অনুযায়ী উপস্থিতি থাকবে।