আনোয়ার হোসাইন সোহেল
নভেম্বর ৮, ২০২৪, ১২:১৮ এএম
আনোয়ার হোসাইন সোহেল
নভেম্বর ৮, ২০২৪, ১২:১৮ এএম
দলীয় সিন্ডিকেট থেকে বের হতে পারছে না দেশের সম্ভাবনাময় চারকোল শিল্প। সিন্ডিকেটের কারণে ভরা মৌসুমেও পাটকাঠি কিনতে হচ্ছে এক থেকে দেড়শ টাকা বেশিতে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, ব্যাপারীদের জিম্মি করে এমন অচলাবস্থা সৃষ্টি করা হয়েছে। গত ৫ আগস্টের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সরকার পরিবর্তনের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিভিন্ন সেক্টরে সংস্কারকাজ শুরু করেছে। তবে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতিতে নিমজ্জিত বিগত সরকারের বসানো দুর্নীতিবাজরা ভোল পালটে এখন বিএনপি সেজে বহালতবিয়তে রয়েছে চারকোল শিল্প খাতে। ফলে দেশের সম্ভাবনাময় রপ্তানি খাত চারকোল শিল্পটি এখনো বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সিন্ডিকেটের কব্জায়ই বন্দি রয়েছে। পাটকাঠি থেকে উৎপাদিত চারকোল পণ্য বাংলাদেশের একটি উদীয়মান শিল্প হলেও এই পণ্যটি রপ্তানিতে সাধারণ ব্যবসায়ীরা প্রতি পদেই সিন্ডিকেটের মুখোমুখি হচ্ছেন। যার ফলে রপ্তানি নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন চারকোল উৎপাদক ও রপ্তানিকারকরা।
বিশেষ করে সাবেক পাট ও বস্ত্র প্রতিমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগ নেতা মির্জা আজমের ছোট ভাই জিল্লুর রহমান শিপন চারকোল ব্যবসায়ীদের সংগঠন বিসিসিএমইউএকে দখলে নিয়ে সারা দেশে নিজস্ব লোকদের দিয়ে একচেটিয়া বাজার নিয়ন্ত্রণ, কতিপয় ব্যবসায়ীকে দিয়ে বায়ারদের মিসগাইড ও শিপিং লাইন নিয়ন্ত্রণ করে এই রপ্তানি খাতটিকে ঝুঁকিতে ফেলেছেন। এ অবস্থা চলতে থাকলে এ খাতের রপ্তানির পাশাপাশি ব্যবসায়ীরাও বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হবেন বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, ফরিদপুর, মাগুরা ও মাদারীপুর এলাকায় বিভিন্ন চারকোল ফ্যাক্টরির মালিক সিন্ডিকেটের কারণে পাটকাঠির উচ্চদামের ফলে এখনো ঠিকঠাক উৎপাদনে যেতে পারেননি। ফ্যাক্টরি মালিকদের অভিযোগ, একটি সিন্ডিকেট গোষ্ঠীর কারণে চলতি মৌসুমে পাটকাঠি কিনতে হচ্ছে ৩৫০-৩৭০ টাকা দামে, অথচ এখন এই পাটকাঠির সিজনে আমরা গতবারও কাঁচামাল কিনেছি ২০০-২২০ টাকা দরে। ফ্যাক্টরি মালিকদের মতে, এবার আর কোনোভাবেই বায়ার টেকানো সম্ভব হবে না।
তাদের অভিযোগ, মাঠে কাঁচামালের জোগান থাকা সত্ত্বেও পাটকাঠি ব্যাপারীদের সঙ্গে যোগসাজশ করে অ্যাসোসিয়েশন সভাপতি মির্জা শিপন ও তার সহযোগী মান্না, আজাদ, আতিক, জিয়ার একটা সিন্ডিকেট পুরো ফরিদপুর অঞ্চলের পাটকাঠি ব্যাপারীদের জিম্মি করে চারকোল উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ নিয়ে চায়নার একটি নির্দিষ্ট বায়ারকে সুবিধা দিতে মরিয়া হয়ে কাজ করছে।
চারকোল ব্যবসায়ীরা জানান, গত ৭-৮ মাস ধরেই চায়নার একটি বায়ার গোষ্ঠীর সঙ্গে বাংলাদেশের চারকোল অ্যাসোসিয়েশনকে ব্যবহার করে আওয়ামী লীগ নেতা এবং অ্যাসোসিয়েশনের বর্তমান সভাপতি মির্জা জিল্লুর রহমান (শিপন) তার পছন্দের ১০টি কোম্পানি দিয়ে ওই বায়ারের সঙ্গে চুক্তি করে বাংলাদেশের বাকি ফ্যাক্টরি মালিক এবং রপ্তানিকারকদের কোণঠাসা করতেই বর্তমান ভরা উৎপাদনের মৌসুমেও পাটকাঠির ব্যাপারীদের জিম্মি করতে এমন অচলাবস্থা সৃষ্টি করেছেন। যার ফলে চারকোল বাজার চলে যাচ্ছে একটি সিন্ডিকেটের হাতে।
চারকোল ব্যবসায়ী মাসউদ বলেন, অক্টোবর থেকে মার্চ পর্যন্ত আমাদের প্রডাকশন টাইম। এ সময়টি চারকোল ব্যবসায়ীদের জন্য একটি ভালো সময়ও। এ সময়েই আমরা বেশি পণ্য বিদেশে রপ্তানে করে থাকি। কিন্তু সংগঠনের সভাপতি নিয়ন্ত্রিত সিন্ডিকেটের কারণে আমরা ঠিকমতো রপ্তানি করতে পারছি না।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে বিসিসিএমইউএর সভাপতি জিল্লুর রহমান শিপনের মোবাইলে একাধিকবার কল করলেও তা বন্ধ পাওয়া গেছে। তার হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে রিং হলেও তিনি রিসিভ করেননি। পরে এসএমএস পাঠালেও তিনি এই অভিযোগের বিষয়ে কোনো উত্তর দেননি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাংলাদেশ থেকে চারকোলের প্রধান আমদানিকারক দেশ হলো চীন। এছাড়া তাইওয়ান, ব্রাজিল, মেক্সিকো, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, জাপান, তুরস্ক, দক্ষিণ কোরিয়া, জার্মানিসহ ইউরোপের শিল্পোন্নত দেশগুলোতে রপ্তানির বাজার রয়েছে। চারকোল থেকে মূলত কার্বন পেপার, কম্পিউটার ও ফটোকপির কালি, আতশবাজি এবং ফেসওয়াশের উপকরণ, মোবাইলের ব্যাটারি, প্রসাধন পণ্য, দাঁত পরিষ্কারের ওষুধ ইত্যাদি পণ্য তৈরিতে প্রধান উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত বছর প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকার চারকোল পণ্য রপ্তানি হয়েছে, যা ভবিষ্যতে পাঁচ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত করা সম্ভব।
কিন্তু এ খাতের ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ চারকোল উৎপাদনকারী ও রপ্তারিকারক সমিতির (বিসিসিএমইএ) সভাপতি সাবেক পাট ও বস্ত্র প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজমের ছোট ভাই জিল্লুর রহমান শিপন ও আওয়ামীপন্থি ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের কারণে সম্ভাবনাময় খাতটি নিয়ে রপ্তানিকারকদের সব স্বপ্নই চুরমার হয়ে যাচ্ছে।
ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, অ্যাসোসিয়েশনে আওয়ামীপন্থি ব্যবসায়ীরা ছাড়া কাউকেই শিপিং লাইনে যোগাযোগ করতে দিচ্ছে না শিপন সিন্ডিকেট। এমনকি আওয়ামীপন্থি ব্যবসায়ীদের বাইরে অন্য কোনো ব্যবসায়ীকে পণ্য শিপিংয়ের ছাড়পত্রও দেয়া হয় না। এতে করে পণ্য রপ্তানি নিয়ে তারা চরম দুর্ভোগে পড়েছেন। গত ২৪ অক্টোবর জিল্লুর রহমান শিপনের সিন্ডিকেট একটি শিপিং কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করেছেন। এখন সেই শিপিং ছাড়া অন্য কোনো শিপিংয়ে রপ্তানিকারকরা পণ্য রপ্তানি করতে পারছেন না।
আবার কমিশনবাণিজ্যের মাধ্যমে দেশের রপ্তানিকারকদের কম দামে পণ্য রপ্তানি করতে বাধ্য করতেন তিনি। সভাপতি তার নিজস্ব কিছু লোক দিয়ে একচেটিয়া ফ্যাক্টরি ও বাজার নিয়ন্ত্রণ করছেন। এ ছাড়া চাইনিজ ফ্যাক্টরির মালিক ও বায়ারদের বাংলাদেশ থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। সেখানে নিজের পছন্দের ব্যবসায়ীদের দিয়ে সেসব ফ্যাক্টরির মালিকানা পাইয়ে দেয়া হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ফরিদপুরের একজন ফ্যাক্টরি মালিক বলেন, সিন্ডিকেটের জন্য কথাও বলা যায় না। খুবই বিপাকে আছি ব্যবসা নিয়ে। আগে যারা আওয়ামী লীগে ছিলো, রাতারাতি তারা খোলস পালটে বিএনপি নামধারী হয়ে পাটকাঠি থেকে শিপিং ও বায়ার সব নিয়ন্ত্রণ করছে। এভাবে চললে এই ব্যবসা টেকানো অসম্ভব হয়ে পড়বে।
ব্যবসায়ীরা জানান, বিসিসিএমইএ সদস্যসংখ্যা ৫৬ হলেও অনেকেই সিন্ডিকেটের কারণে ব্যবসা গুটিয়ে নেয়ায় বর্তমানে ৪০ ব্যবসায়ী এখনো টিকে রয়েছেন। তারা এখনই দলীয় রাজনীতিমুক্ত করে চারকোল শিল্পকে দেশের রপ্তানি খাতে আরও বেশি অবদানের জন্য দ্রুত শিল্প মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপ কামনা করেন।