Amar Sangbad
ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর, ২০২৪,

চেয়ারম্যান-মেম্বার পলাতক

ইউপিতে সেবাবঞ্চিত নাগরিকরা

নিজস্ব প্রতিবেদক

নিজস্ব প্রতিবেদক

নভেম্বর ৮, ২০২৪, ১০:৫৫ পিএম


ইউপিতে সেবাবঞ্চিত নাগরিকরা

রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর থেকে দেশের বিপুলসংখ্যক ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যান নিজ কার্যালয়ে হাজির হচ্ছেন না। ফলে নাগরিকরা সঠিক সময়ে সঠিকভাবে সেবা পাচ্ছেন না। অনেক সময় পোহাতে হচ্ছে নাগরিক দুর্ভোগ। বর্তমানে দেশে ইউনিয়ন পরিষদ রয়েছে চার হাজার ৫৮০টি। এর মধ্যে এক হাজার ৪১৬ ইউপি চেয়ারম্যান কার্যালয়ে অনুপস্থিত, যা মোট ইউনিয়ন পরিষদের এক-তৃতীয়াংশ। আর কতসংখ্যক ইউপি সদস্য বা মেম্বার অনুপস্থিত, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। অনুপস্থিত জনপ্রতিনিধিরা মূলত পলাতক। বেশিরভাগের নামে হত্যা মামলা হয়েছে। তারা গ্রেপ্তার আতঙ্কে রয়েছেন। আবার কেউ কেউ নিজেদের ওপর হামলা হবে— এমন আশঙ্কা থেকে কার্যালয়ে যাচ্ছেন না। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়-সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। 

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ইউপি চেয়ারম্যানরা বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা, মাতৃত্বকালীন ভাতা বিতরণের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত থাকেন। তাছাড়া ওয়ারিশ সনদ, চারিত্রিক সনদ, জন্মনিবন্ধন, মৃত্যুনিবন্ধনের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো ইউনিয়ন পরিষদ থেকেই নিতে হয়। গ্রামে বিভিন্ন সালিশ, নতুন রাস্তা নির্মাণ, পুরোনো রাস্তা সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণ ইউনিয়ন পরিষদ থেকে হয়ে থাকে। চেয়ারম্যান না থাকায় ইউনিয়ন পরিষদগুলোতে ওসব সেবা ব্যাহত হচ্ছে। আর সেবাপ্রার্থী সাধারণ মানুষের এতে দুর্ভোগ বাড়ছে। 

সূত্র জানায়, দেশের বিভিন্ন জেলায় বিপুলসংখ্যক ইউপি চেয়ারম্যানের অনুপস্থিতিতে স্থানীয় সরকার প্রশাসন ৭৮৬টি ইউনিয়ন পরিষদে এরই মধ্যে প্যানেল চেয়ারম্যান নিয়োগ দিয়েছে। তাছাড়া ইউনিয়নে প্রশাসক হিসেবে হয় ইউএনও, নয়তো এসি ল্যান্ড (অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার, ভূমি) দায়িত্ব পালন করছেন। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সব ইউপি চেয়ারম্যান ও মেম্বারকেই অপসারণের চিন্তাভাব?না করছে। তবে তৃণমূলের ওসব জনপ্রতিনিধিকে অপসারণ করার পর সেখানে বিপুলসংখ্যক প্রশাসক নিয়োগ দিতে হবে। আর এত কর্মকর্তা কোথায় পাওয়া যাবে কিংবা ওই প্রশাসকরা আদৌ কাজ করতে পারবেন কি না, তা নিয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে আলোচনা চলছে। তবে সিদ্ধান্ত এখনো চূড়ান্ত হয়নি। অবশ্য স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞদের মতে, ইউনিয়ন পরিষদ ভেঙে না দিয়ে প্যানেল চেয়ারম্যান দিয়ে পরিষদ পরিচালনা করলেই বেশি কার্যকর হবে। 

সূত্র আরও জানায়, একতরফা বিগত স্থানীয় নির্বাচন নিয়ে অনেকের মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে। ওই নির্বাচনে প্রতিযোগিতায় বিরোধীরা সুযোগ পায়নি। যে কারণে অনেকেই ওই নির্বাচন বাতিল করে জনপ্রতিনিধিদের অপসারণ চান। সব ইউপির জনপ্রতিনিধিকে অপসারণ করলে বিকল্প হিসেবে ৫৪ হাজার ৯৬০ জন প্রশাসক নিয়োগ দিতে হবে। কিন্তু সরকারি দপ্তরের কর্মকর্তাদের দিয়ে দীর্ঘমেয়াদে ইউনিয়ন পরিষদ চালানো মুশকিল হবে। তাদের নিজেদের কাজ রয়েছে। ফলে কাজের কাজ কিছুই হবে না। তারচেয়ে প্যানেল চেয়ারম্যান দিয়ে পরিচালনা করাই ভালো হবে। সরকার গত আগস্টে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানদের পাশাপাশি সব পৌরসভার মেয়রকে অপসারণ করেছে। ১২টি সিটি কর্পোরেশনের মেয়র-কাউন্সিলরদের পাশাপাশি পৌরসভার কাউন্সিলরদেরও অপসারণ করা হয়।

এদিকে ইউপি চেয়ারম্যানরা বলছেন, ইউনিয়ন পরিষদ ভেঙে দিলে কিংবা চেয়ারম্যানদের অপসারণ করলে প্রান্তিক পর্যায়ে সরকারি সেবা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে। গ্রামে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হবে। চুরি-ডাকাতি বেড়ে যাবে। নির্বাচিত চেয়ারম্যান ও সদস্যদের (মেম্বার) অপসারণ না করার দাবি জানিয়েছেন তারা। তারা মেয়াদ শেষ করতে চান; এর আগে অপসারণ চান না। অন্যদিকে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞদের মতে, ইউনিয়ন পরিষদ ভেঙে দেয়া ভালো সিদ্ধান্ত হবে না। এতে নাগরিক সেবা ব্যাহত হবে। চেয়ারম্যানদের পরিবর্তে যাদের দায়িত্ব দেয়া হবে, তারা নাগরিকদের সেবা দিতে পারবেন না। তবে যারা পলাতক, সরকার চাইলে শুধু তাদের অপসারণ করতে পারে। যেসব ইউপিতে চেয়ারম্যানরা আসছেন না, সেখানে প্যানেল চেয়ারম্যান দিয়ে কাজ করা যেতে পারে। তবুও প্রশাসক নিয়োগ নয়। ইউপিতে সরকারি কোনো কর্মকর্তাকে নিয়োগ দিলে কাজের কাজ কিছুই হবে না।

দেশের অনেক উপজেলায়ই এখন একই অবস্থা। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, গণঅভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর নারায়ণগঞ্জের এমপি, উপজেলা চেয়ারম্যানদের পাশাপাশি আত্মগোপনে রয়েছেন ইউপি চেয়ারম্যানরাও। নারায়ণগঞ্জ জেলার ৩৯ ইউনিয়ন পরিষদের ২২ ইউপি চেয়ারম্যান নিজ কার্যালয়ে যাচ্ছেন না। তারা পলাতক বলে জানা গেছে। নাগরিক সেবা অব্যাহত রাখতে তাদের অনুপস্থিতিতে প্রশাসক ও ইউপি সদস্যদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর জনরোষ এড়াতে এসব ইউনিয়ন চেয়ারম্যান আত্মগোপনে রয়েছেন। তারা সবাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে হতাহতের ঘটনায় দায়ের করা মামলাগুলোয় আসামি হয়েছেন। এর মধ্যে একটি হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছেন রূপগঞ্জ উপজেলার কায়েতপাড়া ইউপির চেয়ারম্যান জাহেদ আলী। তিনি বর্তমানে কারাগারে। প্রায় একই অবস্থা দেশের সর্বত্র।  ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর দেশের প্রায় দেড় হাজার ইউপি চেয়ারম্যান ও মেম্বার গাঢাকা দিয়েছেন। তারা প্রায় সবাই আওয়ামী লীগ সমর্থিত চেয়ারম্যান-মেম্বার। 

জনপ্রতিনিধি না থাকায় সেবাপ্রার্থী মানুষের দুর্ভোগ কমাতে কিছু ইউপিতে ইতোমধ্যে প্রশাসক নিয়োগ দিয়েছে সরকার। আর সহস্রাধিক ইউপিতে প্যানেল চেয়ারম্যানদের দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দিয়েছে স্থানীয় সরকার বিভাগ। সেবাগৃহীতারা বলছেন, নতুন নির্বাচন না দিলে নির্বাচিতদের মধ্য থেকে দায়িত্ব নির্ধারণ করে দেয়া হলে ভোগান্তি কিছুটা হলেও কমে যাবে। তবে পালিয়ে থাকা চেয়ারম্যান ও সদস্যদের বিষয়ে আইনসম্মত স্থায়ী ব্যবস্থা নিলে সেবায় গতি ফিরবে।
 

Link copied!