নিজস্ব প্রতিবেদক
নভেম্বর ৩০, ২০২৪, ১১:৪৮ পিএম
নিজস্ব প্রতিবেদক
নভেম্বর ৩০, ২০২৪, ১১:৪৮ পিএম
শিক্ষাখাতে ধারাবাহিকতা বিনষ্টের শঙ্কা
নানা কারণে শিক্ষায় যে ক্ষতি হয়েছে, এখনো তা কাটিয়ে ওঠার কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি
নানা ইস্যুতে শিক্ষার্থীরা প্রায়ই আন্দোলনে নামছেন। দাবি আদায়ে শিক্ষাঙ্গন ছেড়ে তারা সড়ক অবরোধ করছেন
শৃঙ্খলাহীনতায় শিক্ষা খাতের ধারাবাহিকতা বিনষ্টের আশঙ্কা বাড়ছে। আন্দোলনসহ নানা কারণে শিক্ষায় যে ক্ষতি হয়েছে, এখনো তা কাটিয়ে ওঠার কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এমন পরিস্থিতিতে শিক্ষার গুণগত মানে জোর না দিলে ভবিষ্যতে ভুগতে হবে। তবে সরকার দূরদর্শিতার পরিচয় দিলে শিক্ষার সব ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা সম্ভব। বর্তমানে দেশে প্রাক-প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় চার কোটি। নানা ইস্যুতে শিক্ষার্থীরা প্রায়ই আন্দোলনে নামছেন। দাবি আদায়ে শিক্ষাঙ্গন ছেড়ে তারা সড়ক অবরোধ করছেন। একাধিকবার সচিবালয় ঘেরাওয়ের মতো কর্মসূচি দিয়েছেন। কিন্তু এখনো মাঠপর্যায়ের শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় তেমন পরিবর্তন আসেনি। ফলে শিক্ষাঙ্গনের সর্বত্র অস্থিরতা বিরাজ করছে।
শিক্ষা খাত সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, শিক্ষা খাতে ধারাবাহিকতা বজায় রাখাটা জরুরি। না হলে শিক্ষার্থীরা নানা ঝামেলায় পড়বে। অন্তর্বর্তী সরকার নতুন কারিকুলাম বাতিল করে পুরনো কারিকুলামে ফিরে আসায় শিক্ষার্থীদের ওপর চাপ বাড়ছে। কারণ স্কুল-কলেজগুলোতে ধারাবাহিকতা রক্ষা না করে হুট করেই একগাদা সিলেবাস চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। তাছাড়া সরাসরি আন্দোলনে সম্পৃক্ত থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থী এখনো ট্রমার মধ্যে রয়েছে। কিন্তু কমিয়ে আনা হচ্ছে তাদের শিক্ষাবর্ষ। আর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় টিউশিন ফি পাওয়ার লক্ষ্যে দ্রুত সেমিস্টার শেষ করার উদ্যোগ নিয়েছে। ফলে আরো বাড়ছে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের ট্রমা। পাশাপাশি স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের অসহায়ত্বের সুযোগে প্রাইভেট-কোচিংয়ের দৌরাত্ম্য বেড়েছে। শিক্ষকরা সব নীতিমালা ভেঙে প্রাইভেট-কোচিংয়ে মেতেছেন। শিক্ষার্থীরাও বাধ্য হয়ে শিক্ষকদের কাছে দৌড়াচ্ছে। স্কুল, কলেজ ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের বিদ্যমান টিউশন ফি নতুন করে বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে। দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও টিউশন ফিতে ছাড় নেই। একদিকে টিউশন ফির চাপ, অন্যদিকে প্রাইভেট-কোচিংয়ের চাপে অভিভাবকরা চিড়েচ্যাপটা।
সূত্র জানায়, বিগত সরকারের পতনের পর দেশের ৫৫টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় সব উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষ ও প্রশাসনিক দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা পদত্যাগ করেন। তবে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের মূল পদ শিক্ষকতায় ফিরে গেছেন। কিন্তু এর জের ধরে বিভিন্ন স্কুল-কলেজের প্রধানদেরও পদত্যাগে বাধ্য করানো হয়। ওই পদত্যাগে বাধ্য করানোয় শিক্ষার্থীরাও অংশ নেয়। এক্ষেত্রে এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানের পদ থেকে পদত্যাগ করার পর তাদের আর চাকরিতে থাকারই কোনো সুযোগ নেই। এমনকি এ ব্যাপারে শিক্ষা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ একাধিকবার বিবৃতি দিয়ে এই বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি ঠেকাতে পারেননি। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের পদের বেশির ভাগ সরকার পূরণ করলেও স্কুল-কলেজে ভারপ্রাপ্ত দায়িত্ব দিয়ে চলছে, যা নিয়ে অন্য শিক্ষকদের মধ্যেও অসন্তোষ রয়েছে।
সূত্র আরও জানায়, শিক্ষার্থীরা অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর এইচএসসির স্থগিত পরীক্ষা বাতিলের দাবিতে আন্দোলনে নামে। তারা সচিবালয় ঘেরাও করে দাবি আদায় করে। এরপর একই পথে অনেকে হাঁটতে থাকে। দাবি আদায়ে নেমে আসে সড়কে, করে সচিবালয় ঘেরাও। এমনকি এইচএসসিতে অকৃতকার্য শিক্ষার্থীরাও অটোপাসের দাবিতে সচিবালয় ঘেরাও করে। তাছাড়া সমপ্রতি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা পাঁচ দফা দাবিতে সচিবালয় ঘেরাও করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত রাজধানীর সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা পৃথক বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবিতে একাধিকবার গুরুত্বপূর্ণ সড়ক অবরোধ করেছে। শিক্ষার্থীদের ঘন ঘন রাস্তায় নেমে আসার ঘটনায় শিক্ষাঙ্গনের শৃঙ্খলা ব্যাহত হচ্ছে। শিক্ষাবিদদের মতে, অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানকে সরিয়ে দেয়া একটা অরাজকতা। এতে ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ক নষ্ট হয়েছে। তাদের পরস্পরের প্রতি আস্থা নেই। এতে শিক্ষকের প্রতি ছাত্রের সম্মানবোধও থাকবে না।
এ ছাড়া করোনা, আন্দোলনসহ নানা কারণে পড়ালেখার যে ক্ষতি হয়েছে, তা কাটিয়ে ওঠার ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। অটোপ্রমোশন, সংক্ষিপ্ত সিলেবাস সমাধান নয়, সমস্যা। শিক্ষার গুণগত মানে জোর না দিলে ভবিষ্যতে ভুগতে হবে। এদিকে জানুয়ারিতে নতুন বই পাওয়া স্কুলের শিক্ষার্থীদের জন্য একটি উৎসব হলেও এবার বছরের প্রথম দিনে বা প্রথম মাসেও সব বই পাওয়ার সুযোগ নেই। কারণ এনসিটিবি এখনো পাঠ্য বই ছাপার কাজ পুরোপুরি শুরু করতে পারেনি। তাছাড়া শিক্ষকদের বেতন-ভাতা নিয়েও চরম অসন্তোষ রয়েছে। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকরা দশম গ্রেডে বেতন দাবিতে নানা কর্মসূচি পালন করছে। নন-এমপিও শিক্ষকরাও এমপিওভুক্তির দাবিতে একাধিকবার আন্দোলনে নেমেছেন। বিশেষ করে নন-এমপিও অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষক, স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি শিক্ষক, বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক, সরকারি প্রাথমিক স্কুলের দপ্তরিসহ একাধিক গ্রুপের শিক্ষক-কর্মচারীদের মধ্যে বেশ ক্ষোভ রয়েছে। তাছাড়া নতুন পরিস্থিতিতে শিক্ষা খাতের ঘুষ-দুর্নীতিও সেভাবে কমেনি। আগে কর্মকর্তারা সরাসরিই ঘুষ নিতো। এখন ঘুরপথে নেন। এখনো টাকা ছাড়া শিক্ষক-কর্মচারীদের এমপিওভুক্ত হওয়ার সুযোগ নেই। আগের মতো ধাপে ধাপে টাকা দিয়ে এমপিও পেতে হয়। স্কুল-কলেজে প্রতিষ্ঠানপ্রধান ও কর্মচারী নিয়োগে এখনো চলে বড় লেনদেন।
অন্যদিকে বিগত সরকারের কর্মকর্তারা শিক্ষা প্রশাসনে ১৫ বছর ধরে জেঁকে বসে আছে। এখনো সেসব জায়গায় বড় পরিবর্তন আনা সম্ভব হয়নি। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালকের চুক্তি বাতিল করলেও এখন যিনি দায়িত্বে রয়েছেন, তিনিও বিগত সরকারের সুবিধাভোগী একজন কর্মকর্তা। শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরে প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে বসানো হয়েছে ঢাকা অঞ্চলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীকে, যিনি বঙ্গবন্ধু প্রকৌশল পরিষদের অন্যতম নেতা। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনে (ইউজিসি) এখনো আওয়ামী লীগপন্থি কর্মকর্তারা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে। আওয়ামী লীগপন্থি এক শিক্ষক নেতার ভাই ইউজিসিতে পরিচালক হিসেবে আছেন। জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমির (নায়েম) পরিচালক (প্রশাসন ও অর্থ), জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) সচিবসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরে দাপটের সঙ্গে আছেন আওয়ামী লীগপন্থিরা। এভাবে প্রশাসনের বেশির ভাগই এখনো ফ্যাসিস্টদের দখলে। তারা নিজেরাও শিক্ষার শৃঙ্খলা চান না।
এ প্রসঙ্গে ডিআইএ পরিচালক অধ্যাপক কাজী মো. আবু কাইয়ুম জানান, একজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার পর তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। অন্য যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, তার বিরুদ্ধেই তদন্ত করা হবে। তবে তদন্ত টিমের প্রায় বেশির ভাগ সদস্যই নতুন। এ অবস্থায় আরও কিছুদিন যাওয়ার পর আগের সঙ্গে বর্তমানের পার্থক্যটা বোঝা যাবে।