ডিসেম্বর ৫, ২০২৪, ১২:০২ এএম
- সিকিউরিটি ও পলিটিক্যাল কাউন্সিল করার প্রস্তাব
- কাল্পনিক গল্প ও প্রোপাগান্ডা রোধে সম্মিলিত প্রচেষ্টা
- সংস্কার শেষে নির্বাচনি রোডম্যাপ ঘোষণার তাগিদ
- দু-একদিনের মধ্যে সুখবরের আশ্বাস জামায়াত আমিরের
দেশে জাতীয় ঐক্যের প্রশ্নে গতকাল বুধবার রাজনীতিকদের মেলবন্ধন সৃষ্টি হয়েছে ঢাকার বেইলি রোডে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে। যেখানে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও তার মিত্র রাজনৈতিক দলগুলো ছাড়া দেশের বাকি প্রায় সব রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতারা উপস্থিত ছিলেন। ‘ত্রিপুরার আগরতলায় বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনে হামলা, বাংলাদেশের পতাকার অবমাননা এবং দেশে সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণের বিষয়ে আন্তর্জাতিকভাবে যে প্রোপাগান্ডা বা কাল্পনিক গল্প শোনানো হচ্ছে, সে বিষয়ে করণীয় নির্ধারণে একসঙ্গে আলোচনায় বসেন রাজনীতিকরা। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারপ্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আহ্বানে ঐক্যবদ্ধ হন জাতীয় নেতারা।
তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে ঐকমত্যে পৌঁছান এবং যে কোনো পরিস্থিতিতে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের পাশে থাকার বিষয়ে আশ্বস্ত করেন। পাশাপাশি প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষ করে দ্রুত নির্বাচন দিতে সরকারপ্রধানকে তাগিদ দেন নেতারা।
ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে গতকাল অনুষ্ঠিত রাজনীতিকদের সঙ্গে বৈঠকে ঠিক কী কী বিষয়ে কথা হয়েছে, সেখানে রাজনৈতিক দলের নেতারা কোন কোন এজেন্ডা নিয়ে কথা বলেছেন, তা জানিয়েছেন সরকারের আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল। তিনি জানান, বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব, অস্তিত্ব, স্বাধীনতা ও মর্যাদা রক্ষার প্রশ্নে সবাই ঐকমত্যে পৌঁছেছেন। রাজনৈতিক দলগুলোর শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের আইন উপদেষ্টা জানান, বাংলাদেশের সবগুলো রাজনৈতিক দল সংলাপে উপস্থিত ছিল। এ বৈঠকে সবাই বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব, অস্তিত্ব, স্বাধীনতা ও মর্যাদা রক্ষার প্রশ্নে ঐকমত্যে পৌঁছেছেন।
তিনি বলেন, সভায় সব সম্প্রদায়ের মানুষের ভূমিকার প্রশংসা করা হয়েছে এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় যে কোনো উসকানির মুখে অটুট রাখার কথা বলা হয়েছে। আইন উপদেষ্টা বলেন, যে কোনো ধরনের অপপ্রচার ও উসকানির বিরুদ্ধে আমরা সাহসী, অটুট ও ঐক্যবদ্ধ থাকব। ভবিষ্যতে যে কোনো ধরনের উসকানি এলে আমরা আমাদের ঐক্য আরও বেগবান করব। আমরা গোটা জাতি ভারতের অপপ্রচারের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ রয়েছি; আমরা সবাই মিলে একটি সমাবেশ করতে পারি কী না, পলিটিক্যাল কাউন্সিল করতে পারি কী না, এমনকি নিরাপত্তা কাউন্সিল করতে পারি কী না— এসব প্রস্তাব আনা হয়েছে। এই সভার মূল সুর ছিল আমাদের মধ্যে মত-পথ-আদর্শের ভিন্নতা থাকবে কিন্তু দেশ, সার্বভৌমত্ব, অস্তিত্ব রক্ষার প্রশ্নে আমরা সবাই এক। সবার ওপরে দেশ এবং এটা থেকে আমরা কখনো বিচ্যুত হব না। বাংলাদেশকে দুর্বল, শক্তিহীন, নতজানু ভাবার কোনো অবকাশ নেই— এই বার্তা প্রকাশ করতে, এই বার্তা জানিয়ে দিতে বলা হয়েছে।
গতকালের বৈঠকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস রাজনীতিকদের সঙ্গে বৈঠকের কারণ ও চলমান পরিস্থিতিতে করণীয় নিয়ে নিজের অবস্থান তুলে ধরেন। তিনি বাংলাদেশ নিয়ে সম্প্রতি ভারতের বিভিন্ন প্রোপাগান্ডার ইঙ্গিত করে বলেন, আমরা যে মুক্ত-স্বাধীন বাংলাদেশ তৈরি করলাম, তারা এটাকে মুছে দিয়ে আগেরটায় ফিরে যেতে চায়। মুখে বলছে না যে আগেরটা; কিন্তু ভঙ্গী হলো আগেরটা ভালো ছিল। তাদের শক্তি এত বেশি যে, তারা মানুষকে এর ভেতরে ভেড়াতে পারছে। তাদের কল্পকাহিনির কারণে মানুষ সন্দেহ প্রকাশ করছে যে, এটা কী ধরনের সরকার হলো! ড. ইউনূস বলেন, আমরা বারবার তাদের বলছি আপনারা আসুন এখানে, দেখেন, এখানে কোনো বাধা নেই। কিন্তু না, তারা ওখান থেকেই কল্পকাহিনি বানিয়ে যাচ্ছে। এখন আমাদের সারা দুনিয়াকে বলতে হবে যে, আমরা এক, আমরা যেটা পেয়েছি— সেটা একজোট হয়ে পেয়েছি, কোনো মতবাদের কারণে পাইনি, ধাক্কাধাক্কি করে পাইনি। যারা আমাদের ওপর চেপে ছিল, তাদের উপড়ে ফেলেছি। এটাই সবার সামনে তুলে ধরতে হবে, সবাই মিলে যেন এটা করতে পারি।
আমাদের নতুন বাংলাদেশের যাত্রাপথে এটা মস্ত বড় একটা বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, অস্তিত্বের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি বলেন, দেশের বর্তমান বাস্তবতা বিশ্বের কাছে প্রতিষ্ঠিত করতে সবাইকে একজোট থাকতে হবে। আমাদের এই স্বাধীনতা অনেকের কাছে পছন্দ হচ্ছে না। নানাভাবে এটাকে উল্টে দেয়ার চেষ্টা চলছে। ৫ আগস্টের পর থেকে নানাভাবে এটা চলছে। সম্প্রতি সারা দেশে শান্তিপূর্ণভাবে দুর্গাপূজা পালিত হয়েছে। আমরাও পূজার আনন্দে শরিক হয়েছিলাম। কোথাও কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা হয়নি। সেটাও অনেকের পছন্দ হয়নি। দেশকে নতুন করে অস্থির করার চেষ্টা চলছে। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘যে বাংলাদেশ আমরা গড়ে তোলার চেষ্টা করছি, সেটাকে ধামাচাপা দিয়ে আরেক বাংলাদেশের কাহিনি রচনা করে যাচ্ছে। সারাক্ষণ নানা রূপে তারা এটা করে যাচ্ছে। এটা যে এখন এক দেশের মধ্যে আছে তা নয়, বিশেষ বিশেষ বড় দেশের মধ্যে ছড়িয়ে গেছে।’
‘আমাদের এই অভ্যুত্থান যাদের পছন্দ হয়নি, তারা এটাকে মুছে দিতে চায়, এটাকে নতুন ভঙ্গীতে দুনিয়ার সামনে পেশ করতে চায়। আমাদের এখানে নাকি ভয়ঙ্কর কাণ্ড ঘটছে, তা থেকে বাংলাদেশকে রক্ষা করতে হবে। রক্ষার জন্য তারা এগিয়ে আসতে চায়। এখন সেগুলোকে মিথ্যা প্রমাণ করা বা বাস্তবতাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য আমাদের সবাইকে একজোট হতে হবে। এটা কোনো বিশেষ রাজনৈতিক মতবাদের বিষয় নয়। জাতি হিসেবে আমাদের অস্তিত্বের বিষয়’— যোগ করেন তিনি। রাজনৈতিক দলের নেতাদের উদ্দেশে ড. ইউনূস বলেন, ‘আপনারা সবাই ভালো বোঝেন। সবাই মিলে আমরা একজোট হয়ে যেন কাজটা করতে পারি, সবাই একত্র হয়ে বললে একটা সমবেত শক্তি তৈরি হয়, এই সমবেত শক্তির জন্যই আপনাদের সঙ্গে বসা।
গতকাল প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকের পর স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ ও তাদের দোসরদের সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করতে সরকারের জাতীয় ঐক্যের আহ্বানে পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বিএনপি। একইসঙ্গে সার্বিক সংস্কারের পর রোডম্যাপ ঘোষণা করে দ্রুত নির্বাচন দিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে দলটি। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকের পর বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন এ কথা জানান। জাতীয় স্বার্থে ঐকমত্য ও নির্বাচনি রোডম্যাপ চায় বিএনপি— এ কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘পতিত সরকার আজকে বিদেশে গিয়ে ষড়যন্ত্র করছে। বিদেশের যেসব দেশ পতিত ফ্যাসিস্ট সরকারের সহযোগিতা করছে, বৈঠকে তাদের বিরুদ্ধে সবাই ঐকমত্য প্রকাশ করেছে। এই ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে তারা দেশের জনগণের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির অপচেষ্টা করছে। এখন প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে নির্বাচনি রোডম্যাপ ঘোষণা করা হলে আর কেউ ষড়যন্ত্রের সাহস পাবে না।’ বিএনপি স্থায়ী কমিটির এই সদস্য আরও বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা জাতীয় ঐক্য সৃষ্টি করতে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের আশ্বাস দিয়েছেন। এই সরকার জনগণের অধিকার ফিরিয়ে দিতে ওয়াদাবদ্ধ। তাই আমরা অতিদ্রুত সংস্কারকাজ শেষ করে নির্বাচনের জন্য রোডম্যাপ দিতে বলেছি। যাতে জনগণ রোডম্যাপ পেলে নির্বাচনমুখী হয়।’ ডিসেম্বরে লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে আমরা বিজয় লাভ করেছি উল্লেখ করে খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘রাজনৈতিক দলের নেতা ছাড়াও আমরা বিএনপির পাঁচজন বৈঠকে উপস্থিত ছিলাম। অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে আমরা ঐকমত্য প্রকাশ করেছি। যেভাবে সবাই মিলে জুলাই-আগস্টে ফ্যাসিস্ট সরকারকে বিদায় করেছি, সেভাবেই ছাত্র-জনতা মিলে ফ্যাসিস্টদের ষড়যন্ত্রও মোকাবিলা করব।’
বৈঠক শেষে জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। সংলাপের বিষয়ে তিনি বলেন, অপপ্রচার মোকাবিলায় আমরা সরকারের সঙ্গে কাজ করব। তিনি বলেন, আমরা কারো পাতা ফাঁদে পা দেব না। কারো কাছে মাথানত করব না, আবার সীমা লঙ্ঘনও করব না। দু-একদিনের মধ্যে সুখবর পাবেন আশা করি।
ডা. শফিকুর রহমান বলেন, দেশের সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে কোনো ছাড় নয়। সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করতে আজ আমরা ঐক্যবদ্ধ।
প্রসঙ্গত, গতকাল বিকাল সোয়া ৪টার দিকে রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে দেশের চলমান পরিস্থিতি নিয়ে বিএনপি-জামায়াতসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতার সঙ্গে সংলাপে বসেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বেলা সাড়ে ৩টা থেকে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আসতে থাকেন রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা। বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের প্রতিনিধিদল সংলাপে অংশ নেয়। অন্য সদস্যরা হলেন ড. আব্দুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও অধ্যাপক ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন।
অন্যদিকে জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমানের নেতৃত্বে চার সদস্যের প্রতিনিধিদল সংলাপে অংশ নেয়। দলটির নায়েবে আমির অধ্যাপক মজিবুর রহমান ও সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরোয়ার এ সময় উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া এবি পার্টি, এলডিপি, জাতীয় নাগরিক কমিটি, গণঅধিকার পরিষদ, জনসংহতি, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টিসহ অন্য কয়েকটি রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিও সংলাপে অংশ নেন। তবে সংলাপে জাতীয় পার্টিকে সরকারের পক্ষ থেকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি বলে জানা গেছে। এর আগে সাম্প্রতিক বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে গত ৩ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় যমুনায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্রআন্দোলনের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন প্রধান উপদেষ্টা। আজ বৃহস্পতিবার বিভিন্ন ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করার কথা রয়েছে।