আনোয়ার হোসাইন সোহেল
ডিসেম্বর ২৯, ২০২৪, ০৫:৪৫ পিএম
আনোয়ার হোসাইন সোহেল
ডিসেম্বর ২৯, ২০২৪, ০৫:৪৫ পিএম
বিদায় বছরের মতো ২০২৪ সালেও ডলার সংকটে রয়েছে বাংলাদেশ। ডিসেম্বরের মধ্যে ব্যাংকগুলোকে পূর্বে আমদানি দায় পরিশোধে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চাপের পাশাপাশি নতুন পণ্য আমদানির চাপ বাড়ায় ডলারের চাহিদা বৃদ্ধিতে বেড়েছে দাম ও সংকট। এতে শিল্পের মূলধনি যন্ত্রপাতি বা ক্যাপিটাল মেশিনারি আমদানি কমিয়েছেন উদ্যোক্তারা। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির ঋণপত্র নিষ্পত্তি হয়েছে ৮৬ কোটি ৪৭ লাখ ডলার। আগের বছরের একই সময়ে নিষ্পত্তি হয়েছিল ১১০ কোটি ৭৩ লাখ ডলার। সে হিসাবে চলতি বছরের জুলাই-নভেম্বরে মূলধনি যন্ত্রপাতির এলসি নিষ্পত্তি কমেছে ২৪ কোটি ২৬ লাখ ডলার বা ২১ দশমিক ৯০ শতাংশ।
এর ফলে শিল্প স্থাপনের নতুন উদ্যোগ ও ব্যবসা বাড়ানোর উদ্যোগ ব্যাহত হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সবশেষ প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। দেশের শিল্প খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতি বেড়ে বহুলাংশে। বিশ্বে অধিকাংশ দেশ মূল্যস্ফীতিসহ অন্যান্য সংকট থেকে বেরিয়ে এলেও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে এই ধারা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি বাংলাদেশ। এখনো মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের আশেপাশে ঘুরছে। ডলার সংকটও দূর হচ্ছে না। একই সঙ্গে রাজনৈতিক অস্থিরতায় দুশ্চিন্তা বাড়ছে। পতিত সরকারের সময়ে গড়ি ওঠা অনেক প্রতিষ্ঠানের মালিকরা দেশে ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ায় বড় বড় ব্যবসায়ী গ্রুপের অনেক কারখানা তারা বন্ধ করে দিয়েছে। যেগুলো টিকে আছে সেগুলোর মধ্যে অনেকের বড় অঙ্কের ঋণ থাকায় সরকারের পক্ষে সামাল দেয়া সম্ভব হচ্ছে না।
এ পরিস্থিতিতে ব্যবসা টিকিয়ে রাখাই এখন কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) মূলধনি যন্ত্রপাতি আমাদানির এলসি খোলা হয়েছে ৭১ কোটি ২৬ লাখ ডলার। আগের বছরের একই সময়ে এলসি খোলা হয়েছিল ৯৬ কোটি ৮৯ লাখ ডলারের। অর্থাৎ চলতি বছরের আলোচ্য সময়ে এলসি খোলার পরিমাণ কমেছে ২৫ কোটি ৬৩ লাখ ডলার বা ২৬ দশমিক ৪৫ শতাংশ।
এ বিষয়ে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন আশরাফ আহমেদ আমার সংবাদকে বলেন, ডলারের সরবরাহ চাপ সারা বছর অব্যাহত ছিল এবং বছরের শেষ মাসে সেটা ঘনীভূত হয়। টাকা সুদের হার ব্যবহার করে টাকার মান বা ডলারের সরবরাহ বৃদ্ধি করতে সক্ষম হওয়ার সম্ভাবনা কম। সুদহার বাড়িয়ে আমরা ডলারের চাহিদা কমিয়েছি; কিন্তু তার প্রভাব পড়ছে বিনিয়োগে। আমাদের একমাত্র আসল বিকল্প হলো উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করে রপ্তানি বাড়ানো। আমরা আশা করি, ২০২৫ কৌশলগত পরিবর্তন দেখতে পাব।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) মূলধনি যন্ত্রপাতি আমাদানির এলসি খোলা হয়েছে ৭১২ কোটি ৬৩ লাখ ডলার। আগের বছরের একই সময়ে এলসি খোলা হয়েছিল ৯৬৮ কোটি ৯৩ লাখ ডলারের। অর্থাৎ চলতি বছরের আলোচ্য সময়ে এলসি খোলার পরিমাণ কমেছে ২৬ দশমিক ৪৫ শতাংশ। উদ্যোক্তারা বলছেন, দেশে বিনিয়োগে একধরনের স্থবিরতা বিরাজ করছে। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর নতুন করে কেউ বিনিয়োগে যাচ্ছেন না। এ কারণে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি কমে গেছে। মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির ঋণপত্রের পাশাপাশি কমেছে শিল্পের মধ্যবর্তী পণ্য আমদানির ঋণপত্র খোলাও। চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে মধ্যবর্তী পণ্যের ঋণপত্র খোলা হয়েছে ১৭০ কোটি ২৪ লাখ ডলারের। গত অর্থবছরের একই সময়ে যার পরিমাণ ছিল ১৯২ কোটি ৪০ লাখ ডলার। সেই হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে মধ্যবর্তী পণ্য আমদানির ঋণপত্র খোলা কমেছে ২২ কোটি ১৫ লাখ ডলার বা ১৫ দশমিক ৩৮ শতাংশ। অপরদিকে চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে মধ্যবর্তী পণ্যের ঋণপত্র নিষ্পত্তি হয়েছে ১৮৬ কোটি ৮২ লাখ ডলারের।
গত অর্থবছরের একই সময়ে যার পরিমাণ ছিল ২২০ কোটি ৭১ লাখ ডলারের। সেই হিসাবে ঋণপত্র নিষ্পত্তি কমেছে ৩৩ কোটি ৮৯ লাখ ডলারের বা ১২ শতাংশ। মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানিকে শিল্পের বিকাশ, কর্মসংস্থান ও মোট জাতীয় উৎপাদনে একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক হিসেবে দেখা হয়। এরসঙ্গে দেশের রপ্তানির স্বার্থও জড়িত। কয়েক বছর ধরে দেশে চলমান ডলার সংকট ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে শিল্প উদ্যোক্তারা উৎসাহ হারিয়ে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে আসছিলেন। এর প্রভাব হিসেবে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি উল্লেখ্যযোগ্য হারে হ্রাস পেয়েছে। মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি করে উদ্যোক্তারা সাধারণত নতুন শিল্পকারখানা স্থাপন বা কারখানার সম্প্রসারণ করে থাকেন।
এতে নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হয়। বাড়ে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, এতে আগামী দিনগুলোতে শিল্প খাতে বিনিয়োগ কমার আশঙ্কা রয়েছে। সামগ্রিক অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এদিকে জুলাই-নভেম্বর মাসে ভোগ্যপণ্যের আমদানি ঋণপত্র খেলা হয়েছে ২৫৬ কোটি ৯৫ লাখ ডলারের। আগের বছরের একই সময়ে এসব পণ্যের এলসি খোলা হয়েছিল ২৬৫ কোটি ৩২ লাখ ডলারের। অর্থাৎ এ সময় ভোগ্যপণ্যের এলসি খোলা কমেছে ৩ দশমিক ১৫ শতাংশ।
এছাড়া আলোচ্য সময়ে ভোগ্যপণ্যের এলসি নিষ্পত্তি হয়েছে, ২৪০ কোটি ৬৫ লাখ ডলারের। আগের বছরের একই সময়ে এলসি নিষ্পত্তি করা হয়েছিল ২৭৭ কোটি ৮৮ লাখ ডলারের। এ সময় ভোগ্যপণ্যের এলসি নিষ্পত্তি কমেছে ১৩ দশমিক ৪০ শতাংশ। তবে অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে শিল্পকারখানার কাঁচামাল আমদানি বেড়েছে। জুলাই-নভেম্বরে কাঁচামাল আমদানির ঋণপত্র খোলা হয়েছে ৯৮৯ কোটি ১০ লাখ ডলারের। আগের বছরের একই সময়ে যার পরিমাণ ছিল ৯৩৬ কোটি ৮৫ লাখ ডলার। সে হিসাবে চলতি বছরের আলোচ্য সময়ে শিল্পকারখানার কাঁচামাল আমদানি বেড়েছে ৫ দশমিক ৫৮ শতাংশ। এছাড়া কাঁচামালের ঋণপত্র নিষ্পত্তি কমেছে ৭ দশমিক ১৩ শতাংশ।