Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ০৩ জানুয়ারি, ২০২৫,

ফিরে দেখা ২০২৪

ব্যাংক খাতে নজিরবিহীন এক বছর

আনোয়ার হোসাইন সোহেল

আনোয়ার হোসাইন সোহেল

ডিসেম্বর ৩১, ২০২৪, ০৫:৩৬ পিএম


ব্যাংক খাতে নজিরবিহীন এক বছর

বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের জন্য নজিরবিহীন একটি বছর ছিল ২০২৪ সাল। দেশের ৫৩ বছরের ইতিহাসে ব্যাংক খাতের জন্য কলঙ্কজনক এক অধ্যায় রচনা করেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালকুদার। ৫ আগস্ট বিপ্লবের পর থেকে গা ঢাকা দেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর। ধারণা করা হচ্ছে, তিনি পালিয়ে গেছেন। অসমর্থিত সূত্র মতে, তিনি পালিয়ে যাননি, দেশেই আছেন। 

তবে ৯ আগস্ট গভর্নর মেইলের মাধ্যমে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব বরাবর পদত্যাগপত্র পাঠিয়েছেন। ব্যাংক খাতের দুর্নীতি, অনিয়ম, খেলাপি ঋণ, অর্থপাচার রোধে ব্যর্থতা, ডলার-সংকটসহ নানা কারণে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। বছরের শুরুতে গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার সরকারি-বেসরকারি বেশ কয়েকটি ব্যাংকের (মার্জ) একীভূতকরণের বিতর্কিত উদ্যোগ নিয়েছেন। এই উদ্যোগকে ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা লুটপাটকে ব্ল্যাঙ্ক চেক বলে অভিহিত করেছেন। বছরজুড়ে আলোচনার কেন্দ্রে ছিল এস আলম শিল্পগোষ্ঠী ও দুর্বল ব্যাংকের সংবাদ প্রচারের সূত্র ধরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে প্রায় দুই মাস সাংবাদিকদের প্রবেশে নিষেধজ্ঞা আরোপ। এছাড়া গভর্নরের নেয়া পদক্ষেপের কারণে বৈদেশিক মুদ্রার সংকট বিদ্যমান দুর্বলতাকে আরও নাজুক করে তুলেছে। সাবেক গভর্নরের নেয়া সিদ্ধান্ত, সুশাসনের অভাব, অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি এবং রাজনৈতিক ব্যক্তি ও পরিচালকদের হস্তক্ষেপের কারণে আমানতকারীদের মধ্যে উদ্বেগ বেড়েছে বহুগুন। এর প্রভাব পড়েছে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স প্রবাহেও। এমনকি বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্ব নেয়ার পর মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, স্থানীয় মুদ্রার বিনিময় হারের সুরক্ষা ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সুসংহত করতে ব্যর্থ হওয়ায় আব্দুর রউফ তালুকদারকে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কভিত্তিক গ্লোবাল ফাইন্যান্স ম্যাগাজিনের র‌্যাংকিংয়ে গভর্নর হিসেবে ‘ডি’ গ্রেড দেয়। দুর্বল ব্যাংক চিহ্নিত করার জন্য তিনি যে তালিকা করেছেন সেটি ফাঁস হয়ে যাওয়া ব্যাংকের প্রতি আমানতকারীদের আস্থার সংকট চরমে উঠে। 

বছরের শেষপ্রান্তে এসে এক সংবাদ সম্মেলনে নতুন গভর্নর আহসান এইচ মনসুরের মন্তব্য ‘কয়েকটি ব্যাংক দেউলিয়া হওয়ার উপক্রম হয়েছে’। এর জেরে আস্থা সংকটে জ্বলতে থাকা ব্যাংকগুলোর সেই আগুনে ঘি ঢেলেছেন নয়া গভর্নর। তবে খাদের কিনারায় থাকা ব্যাংক খাতকে টেনে তুলতে ব্যাংক সংস্কারসহ নানা উদ্যোগ নিয়েছেন বর্তমান গভর্নর। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো এস আলমসহ বিভিন্ন গ্রুপের পাচার করা টাকা উদ্ধার, ব্যাংক খাত সংস্কারের টাস্কফোর্স গঠন, শ্বেতপত্র প্রণয়ন বিভিন্ন মহলে ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছে। 

গ্রাম ও শহরের ব্যাংকে কমেছে আমানকারীর সংখ্যা : আস্থার সংকট থাকায় বছরজুড়েই ব্যাংকের আমানতকারীর সংখ্যা কমেছে। তবে সেই সংখ্যা আরো উসকে দেয় ৫ আগস্টের বিপ্লবের পর। দেশ থেকে পালিয়ে যায় পতিত সরকারের সুবিধাভোগী ব্যবসায়ী শ্রেণির একটি বড় অংশ। পালিয়ে যাওয়ার সময় তারা নানা কৌশলে ব্যাংক থেকে নগদ টাকা তুলে নেয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্যে দেখা যায়, জুনে ব্যাংকে আমানত ছিল ১৮ লাখ ৩৯ হাজার কোটি টাকা। সেপ্টেম্বরে তা কমে দাঁড়িয়েছে ১৮ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা। উল্লিখিত সময়ে আমানত কমেছে দশমিক ৭৩ শতাংশ। জুনে আমানত বেড়েছিল ৪ দশমিক ৩৪ দশমিক শতাংশ। একই সময়ে গ্রাম ও শহরেও আমানত প্রবাহ কমেছে। শহরে কমেছে দশমিক ৭৪ শতাংশ এবং গ্রামে কমেছে দশমিক ৭০ শতাংশ। আগে মোট আমানতে গ্রামের অবদান ছিল ১৮ শতাংশ, বাকি ৮২ শতাংশ ছিল শহরের অবদান। এখন গ্রামের আমানতের অংশ কমে সাড়ে ১৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। শহরের অবদান বেড়ে সাড়ে ৮৪ শতাংশে। 

এ সময় সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে আমানত কমেছে। তবে বিদেশি ও সরকারি খাতের বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোতে আমানত বেড়েছে। সরকারি ব্যাংকে কমেছে ২ দশমিক ৫৯ শতাংশ, বেসরকারি ব্যাংকে দশমিক ৩৩ শতাংশ ও ইসলামি ব্যাংকগুলোতে ২ দশমিক ৭৯ শতাংশ কমছে। বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোতে বেড়েছে দশমিক ৪৩ শতাংশ এবং বিদেশি ব্যাংকে বেড়েছে ২ দশমিক ৪১ শতাংশ। জুনের তুলনায় সেপ্টেম্বরে ব্যাংকগুলোতে কোটিপতি আমানতকারীর সংখ্যা কমেছে এক হাজার ৬৫৭ জন। জুনে ব্যাংকে কোটিপতি আমানতকারী ছিলেন এক লাখ ১৮ হাজার ৭৮৪ জন। সেপ্টেম্বরে তা কমে দাঁড়িয়েছে এক লাখ ১৭ হাজার ১২৭ জনে। আলোচ্য সময়ে কোটিপতিদের আমানতও কমেছে। 

কারণ রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বিশেষ করে কোটিপতিরাই বেশি অর্থ তুলে নিয়েছেন। বর্তমানে এক কোটির বেশি থেকে পাঁচ কোটি টাকা আমানত রয়েছে ৯২ হাজার ৫৬৩ জন গ্রাহকের। পাঁচ কোটির বেশি থেকে ১০ কোটি টাকা পর্যন্ত আমানত রয়েছে ১২ হাজার ৬৫৮ জন গ্রাহকের। ১০ কোটি টাকার বেশি থেকে ১৫ কোটি টাকার আমানতকারী চার হাজার ২৫০ জন। ১৫ কোটি টাকার বেশি থেকে ২০ কোটি টাকার আমানত রয়েছে দুই হাজার ছয়জন গ্রাহকের। ২০ কোটির বেশি থেকে ২৫ কোটি টাকার আমানত রয়েছে এক হাজার ৩১২ জন গ্রাহকের। ২৫ কোটি টাকার বেশি থেকে ৩০ কোটি টাকা পর্যন্ত আমানত রয়েছে ৯৬৮ জনের। ৩০ কোটি থেকে ৩৫ কোটি টাকার আমানতকারী ৪৫০ জন। ৩৫ কোটি বেশি থেকে ৪০ কোটি টাকার আমানতকারী ৩৫৮ জন। ৪০ কোটির বেশি থেকে ৫০ কোটি টাকার আমানতকারী ৭৬২ জন এবং ৫০ কোটি টাকার বেশি আমানতকারী রয়েছেন এক হাজার ৮০০ জন। 

প্রতিবেদনে দেখা যায়, ফাইন্যান্স কোম্পানিতেও আমানত প্রবাহ কমে গেছে। জুনে আমানত ছিল ৪৭ হাজার ৯০৬ কোটি টাকা, সেপ্টেম্বরে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৪৭ হাজার ৮৩৮ কোটি টাকা। ওই সময়ে আমানত কমেছে দশমিক ১৪ শতাংশ। জুনে আমানত বেড়েছিল ১ দশমিক ৮৬ শতাংশ। আমানত কমার পাশাপাশি ঋণও প্রত্যাশিত হারে বাড়েনি। তবে সুদ যোগ করে মোট ঋণের স্থিতি বেড়েছে। কিন্তু নতুন ঋণ বাড়েনি। সামগ্রিক মন্দার ফলে ব্যাংকের ঋণ পরিশোধও কমে গেছে আশঙ্কাজনক হারে। ব্যাংক খাতের এ দুর্দশার কারণে ভুগছে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি।

ডলার সংকট : আগের বছরের ধারাবাহিকতায় ২০২৪ শুরু হয় দেশে বৈদেশিক মুদ্রার সংকট নিয়েই। বছরের প্রথম দিন ডলারের দাম বাড়ানোর বার্তা দেয় ব্যাংকগুলো। এক টাকা বাড়ানো হয় রপ্তানি আয়ে ডলারের দাম। বছরের প্রথম মাস জানুয়ারিতে রপ্তানি আয় সংগ্রহের দাম বেঁধে দেয়া হয় ১০২ টাকায়। আর প্রবাসী আয়ে ডলারের দাম নির্ধারণ করা হয় ১০৭ টাকা। রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়ে ডলারের দামের মধ্যে পার্থক্য দূর করে বাজারভিত্তিক করার দিকে জোর দেয় ব্যাংকগুলো। ফলে ডলারের আনুষ্ঠানিক দাম গিয়ে ঠেকে ১১১ টাকায়। সংকটে থাকা কিছু ব্যাংক চাহিদা মেটাতে গিয়ে প্রয়োজনীয় ডলার কেনে ১২৪-১২৫ টাকা দাম দিয়ে। এতে করে বেঁধে দেয়া দামের চেয়ে বেশি মূল্য দিয়ে ডলার কিনতে হয় আমদানিকারকদের। খোলাবাজার বা কার্ব মার্কেটে ডলারের দাম ওঠে ১২৬ টাকা পর্যন্ত। গত ৫ আগস্ট বিপ্লবের পর থেকে দেশে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স আসার পরিমাণ বেড়েছে। তবে বছরের শেষপ্রান্তে আমদানির দায় মোটানোর ও ব্যাংকগুলোর বকেয়া দায় ডিসেম্বরের মধ্যে পরিশোধের বাধ্যবাধকতার চাপে প্রতি ডলারের দাম ৮ থেকে ৯ টাকা পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। যার ফলে খোলাবাজারে ডলারের চড়া দামের পাশাপাশি সংকট দেখা দিয়েছে। 

রিজার্ভ ২৬ বিলিয়ন ছাড়িয়েছে : অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে বিনিয়োগের চাপ কম থাকায় দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ইতিবাচক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সবশেষ হিসেবে দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়ে ২৬.০৯ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। গত রোববার বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক হুসনে আরা শিখা এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) নিয়ম মেনে বিপিএম-৬ অনুযায়ী রিজার্ভের পরিমাণ এখন ২১.৩৩ বিলিয়ন ডলার। এই হিসাবেও আগের চেয়ে বেড়েছে রিজার্ভ। নিট রিজার্ভ গণনা করা হয় আইএমএফের ‘বিপিএম-৬’ পরিমাপ অনুসারে। মোট রিজার্ভ থেকে স্বল্পমেয়াদি দায় বিয়োগ করলে নিট বা প্রকৃত রিজার্ভের পরিমাণ পাওয়া যায়। তবে এর বাইরে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের আরেকটি হিসাব রয়েছে, তা হলো ব্যয়যোগ্য রিজার্ভ। 

এ তথ্য আনুষ্ঠানিকভাবে খুব একটা প্রকাশ করে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সেখানে আইএমএফের এসডিআর খাতে থাকা ডলার, ব্যাংকগুলোর বৈদেশিক মুদ্রা ক্লিয়ারিং হিসাবে থাকা বৈদেশিক মুদ্রা এবং আকুর বিল বাদ দিয়ে ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভের হিসাব করা হয়। আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে একটি দেশের ব্যয়যোগ্য প্রকৃত রিজার্ভ থাকা দরকার ১৫ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ তিনমাসের ব্যয়যোগ্য ডলার থাকতে হবে।  সে হিসাবে মাসে  প্রতি মাসে ৫ বিলিয়ন ডলার। এই হিসাবে বর্তমানে রিজার্ভ ইতিবাচক ধারায় আছে। ডিসেম্বর মাসের ২৮ দিনে দেশে বৈধ পথে ২৪২ কোটি মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ রেমিট্যান্স এসেছে, দেশীয় মুদ্রায় যার পরিমাণ ২৯ হাজার ৪০ কোটি টাকা (প্রতি ডলার ১২০ টাকা ধরে)। দৈনিক গড়ে রেমিট্যান্স এসেছে আট কোটি ৬৪ লাখ ডলার। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর বাজারের চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখায় বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার স্থিতিশীল ছিল। বিশেষ করে ডলারের দাম ১২০ টাকায় ছিল দীর্ঘদিন ধরে। তবে গত সপ্তাহে ডলারের চাহিদা বাড়ায় বর্তমানে খোলাবাজার বা কর্ব মার্কেটে প্রতি ডলার ১২৮-১২৯ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। এই রেট কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বেঁধে দেয়া দামের চাইতেও প্রায় ৮-৯ টাকা বেশি। তবে রেমিট্যান্স ১২৫ টাকার বেশি দরে না কিনতে ব্যাংকগুলোকে মৌখিকভাবে কঠোর নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। 

খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩৫ শতাংশ : কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য মতে, ২০২৪ সালের জুন মাস শেষে ব্যাংকিং খাতের মোট বিতরণে ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৬ লাখ ৮৩ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা। এক বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৫৫ হাজার ৩৫২ কোটি টাকা বা ৩৫ শতাংশ। ২০২৩ সালের জুন শেষে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ ছিল এক লাখ ৫৬ হাজার ৩৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে দুই লাখ ১১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশ। যা তিন মাস আগে মার্চ প্রান্তিকে ব্যাংকিং খাতের মোট বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ছিল ১৬ লাখ ৪০ হাজার ৮৫৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ছিল এক লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা, যা ওই সময়ের মোট বিতরণ করা ঋণের ১১.১১ শতাংশ। সেই হিসেবে তিন মাসের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২৯ হাজার ৯৬ কোটি টাকা। ২০০৯ সালে যখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছিল, তখন ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। সেই খেলাপি ঋণ এখন দুই লাখ ১১ হাজার কোটি টাকারও বেশি। অর্থাৎ শেখ হাসিনার সরকারের ১৬ বছরের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে এক লাখ ৮৮ হাজার ৯১০ কোটি টাকা।

১২ দুর্বল ব্যাংক চিহ্নিত : গত জুলাই থেকে ব্যাংক ঋণের সুদহারের নতুন নিয়ম চালু করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সুদহারের সীমা তুলে নেয়ার পর ঋণের সুদহার ৯ শতাংশ থেকে বেড়ে সাড়ে ১১ শতাংশে উঠেছে। আমানতের সুদ হারও বাড়িয়েছে ব্যাংকগুলো। যদিও উচ্চ মূল্যস্ফীতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে তা করা সম্ভব হয়নি। ২০২২ সালের ওপর এ প্রতিবেদন প্রকাশ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২২ সাল শেষে ব্যাংকিং খাতের ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে তিন লাখ ৭৭ হাজার ৯২২ কোটি টাকায়। খেলাপি ঋণ (এনপিএল), পুনঃতফসিল ঋণ ও অবলোপন ঋণ বিবেচনা করে ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের হিসাব করা হয়। উদ্বেগজনক এসব তথ্যে এ খাতে শঙ্কা তৈরি হয়। যে পদ্ধতির ওপর ভিত্তি করে এখন ঋণের সুদহার নির্ধারিত হচ্ছে, তা হলো ‘স্মার্ট’ বা ‘সিক্স মান্থ মুভিং অ্যাভারেজ রেট অব ট্রেজারি’ বিল। প্রতি মাসের শুরুতে এ হার জানিয়ে দিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ বছরের জুলাইয়ে ১৮২ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের ছয় মাসের গড় সুদ (স্মার্ট রেট) ছিল ৭ দশমিক ১০ শতাংশ, আগস্টে ৭ দশমিক ১৪ শতাংশ; সেপ্টেম্বরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৭ দশমিক ২০ শতাংশ। এছাড়া, অক্টোবরে ৭ দশমিক ৪৩ শতাংশ ও সর্বশেষ নভেম্বর মাসে স্মার্ট রেট বেড়ে দাঁড়ায় ৭ দশমিক ৭২ শতাংশ। এ হিসেবে ডিসেম্বরে ব্যাংকগুলোর সর্বোচ্চ ঋণের সুদহার দাঁড়ায় ১১ দশমিক ৪৭ শতাংশ। কারণ, ব্যাংকগুলো এখন ঋণ দেয়ার জন্য মার্জিন হিসেবে স্মার্ট রেটের সঙ্গে ৩ দশমিক ৭৫ ভিত্তি পয়েন্ট যুক্ত করতে পারে। তবে ডিসেম্বরে ব্যক্তিগত ও গাড়ি কেনার ব্যাংক ঋণের সুদ ছিল ১২ দশমিক ৪৭ শতাংশ। কারণ, সিএমএসএমই, ব্যক্তিগত ও গাড়ি কেনার ঋণে অতিরিক্ত ১ শতাংশ তদারকি বা সুপারভিশন চার্জ নেয়ার সুযোগ রয়েছে। 

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বলছে, গত জুন ও জুলাই মাসে দেশে মূল্যস্ফীতি সামান্য কমার পর আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে তা আবার বেড়েছে। অক্টোবর মাসে খাদ্যে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশ, যা গত ১১ বছর ৯ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। বিবিএসের মূল্যস্ফীতির হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, অক্টোবরে সার্বিক মূল্যস্ফীতিও কিছুটা বেড়ে ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ হয়েছে।

দুর্বল ব্যাংকগুলোকে তারল্য সহায়তা প্রদান : নানা অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার কারণে এখনো নগদ অর্থ সংকটে ভুগছে দেশের শরিয়াভিত্তিক পাঁচ ইসলামি ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উল্লেখযোগ্য সহায়তা সত্ত্বেও তারা তারল্য সংকট এখনো কাটাতে পারেনি। ব্যাংকগুলো হচ্ছে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক। এসব ব্যাংকের আমানত বাড়লেও তা বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে থাকা চলতি হিসাবে জমা করেনি। তাই বছরজুড়ে ক্যাশ রিজার্ভ রেশিও (সিআরআর) ও সংবিধিবদ্ধ তারল্য অনুপাত (এসএলআর) ঘাটতিতে ভুগছে ব্যাংকগুলো। এসব ব্যাংকের বেনামি ঋণ ও ঋণ অনিয়মের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, দেশের দুর্বল ব্যাংকগুলোর প্রায় সব সূচকে অবনতি ঘটেছে। আমানত কমেছে, তারল্য কমেছে আগের চেয়ে বেশি। গত তিন মাসে ব্যাংকগুলোর তারল্য কমেছে ৯৮ শতাংশ। 

এ অবস্থার জন্য ব্যাংকগুলোতে সুশাসনের অভাব ও অনিয়মকে দায়ী করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত জুনে দুর্বল ছয়টি ব্যাংক, যেগুলোকে তারল্য সহায়তা দেয়া হয়েছিল তাদের আমানতের স্থিতি ছিল ৪৪ হাজার ৩১ কোটি টাকা। গত সেপ্টেম্বর তা কমে দাঁড়িয়েছে ৪৩ হাজার ৬৬৭ কোটি টাকা। তিন মাসের ব্যবধানে আমানত কমেছে ৮ হাজার ৪২ কোটি টাকা কিংবা প্রায় ২ শতাংশ। বিনিয়োগের স্থিতি বেড়েছে মাত্র দশমিক ৪২ শতাংশ। বিনিয়োগ কমায় আমানত ও বিনিয়োগের অনুপাত কমে দাঁড়িয়েছে ৩ দশমিক ৬৭ শতাংশ। এই ছয় ব্যাংকে গত জুনে অতিরিক্ত তারল্য ছিল ১০ হাজার ৩৯০ কোটি টাকা। সেপ্টেম্বর তা কমে দাঁড়িয়েছে ১৬১ কোটি টাকা। তিন মাসে অতিরিক্ত তারল্য কমেছে ১০ হাজার ২২৯ কোটি টাকা কিংবা সাড়ে ৯৮ শতাংশ। 

তবে রপ্তানি আয়, রেমিট্যান্স ও আমদানি বেড়েছে। ফলে ব্যাংকগুলো বৈদেশিক বাণিজ্যে ভালো করছে। বাড়তি দামে ডলার কেনায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কঠোর তদারকির আওতায় পড়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি সবল ব্যাংকও রয়েছে। এদিকে আর্থিক দুর্বলতার কারণে শরিয়াহভিত্তিতে পরিচালিত ব্যাংকগুলো প্রচলিত ব্যাংকগুলোর তুলনায় পিছিয়ে পড়ছে। এসব ব্যাংকের বেশির ভাগই দুর্বল ব্যাংকের আওতায় পড়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ছয়টি অতি দুর্বল ব্যাংককে সরবরাহ করা টাকায় সহায়তা দিয়েছে সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকা। এসব ব্যাংক চড়া সুদে আমানত সংগ্রহ করছে, তারপরও সংকট মেটাতে পারছে না। এখন ব্যাংকগুলো ঋণ আদায়ে বেশি জোর দিয়েছে। আগামী বছরের শুরু থেকে দুর্বল ব্যাংকগুলোর জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক চালু করতে যাচ্ছে ‘প্রমোট কারেকটু অ্যাকশন প্ল্যান’।

ঋণের কিস্তি পরিশোধ না করলে ৩ মাস পার হলেই ঋণখেলাপি : আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী ঋণ কার্যক্রমের নিয়মনীতি ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। নতুন নিয়ম অনুযায়ী ঋণের কিস্তি পরিশোধের নির্ধারিত সময় শেষ হওয়ার তিন মাস পার হলেই ঋণখেলাপির খাতায় চলে যাবে। এ ছাড়া অনাদায়ি ঋণের বকেয়ার সময়সীমা অনুযায়ী খেলাপির স্তর এবং আনুপাতিক হারে প্রভিশন সংরক্ষণ করতে নির্দেশনাও জারি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ ক্ষেত্রে ঋণ মেয়াদোত্তীর্ণের পর ৩ থেকে ৬ মাসের মধ্যে ‘নিম্নমান’, ৬ থেকে ১২ মাসের মধ্যে ‘সন্দেহজনক’ ও ১২ মাসের অধিক হলে ‘মন্দ’ ক্যাটাগরিতে পড়বে। নিয়মিত ঋণের জন্য ১ শতাংশ এবং খেলাপির বিপরীতে সর্বোচ্চ ১০০ শতাংশ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে বলা হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের গতকাল প্রকাশিত এক প্রজ্ঞাপনে। ২০২৫ সালের ১ এপ্রিল থেকে নতুন এ নির্দেশনা কার্যকর হবে। 

এক সঙ্গে ৬ ব্যাংকের এমডিকে অপসারণ : ব্যাংক খাতের সংস্কারের অংশ হিসেবে একই দিনে রাষ্ট্রায়ত্ত ছয় বাণিজ্যক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচলককে অপসারণ করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী, বেসিক ও বিডিবিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের নিয়োগ বাতিল করে পৃথক পৃথক প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে গত ১৯ সেপ্টেম্বর বিকালে। তিন বছর মেয়াদে নিয়োগ পাওয়াদের মধ্যে তিন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাত্র এক বছর অতিক্রম করেছেন দায়িত্ব। এরপর বিশেষায়িত ব্যাংকের এমডিদেরও অপসারণ করে একসঙ্গে ১০ ব্যাংকে এমডি নিয়োগ দেয় সরকার।
 

Link copied!