মো. ইমরান খাঁন
জানুয়ারি ৬, ২০২৫, ১২:৩৯ পিএম
মো. ইমরান খাঁন
জানুয়ারি ৬, ২০২৫, ১২:৩৯ পিএম
লুটেরাদের খপ্পরে ধ্বংসের পথে দেশের বিমা খাত। বিগত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে এ খাতকে লুটেপুটে খেয়েছেন ওই সরকারের আশির্বাদপুষ্টরা। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার পতনের পাঁচ মাস ইতোমধ্যেই পার হয়েছে, কিন্তু ধ্বংসস্তূপ থেকে বেরোতে পারেনি খাতটি। অব্যাহত দুর্নীতি আর অনিয়মের নরকরাজ্যে পরিণত হয় প্রতিষ্ঠিত বেশিরভাগ বিমা কোম্পানি। অর্থ লোপাটসহ বিভিন্ন অনিয়ম পরিণত হয় নিয়মে। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর দেশের বিভিন্ন খাত সংস্কার হলেও সেই সংস্কারের ছোঁয়া লাগেনি বিমা খাতে। চিহ্নিত দুর্নীতিবাজদের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে বসানোয় অনিয়ম আর দুর্নীতির আতুড়ঘরে পরিণত হয় বিগত দিনে সুনাম কুড়ানো অনেক বিমা কোম্পানি। কোম্পানিগুলোতে সুশাসনের বালাই নেই। এফডিআরের নামে প্রতারণা করে গ্রাহকের অর্থ আত্মসাৎ, গ্রাহক ভোগান্তি, সময় মতো বিমা দাবি পরিশোধ না করাসহ হাজারো অনিয়ম হচ্ছে এ খাতে। কোম্পানিগুলোর এসব অনিয়ম-দুর্নীতি চালাতে বাধা দেয়ার পরিবর্তে নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএর অনেক কর্তা-ব্যক্তিরাই ছিলেন সহায়কের ভূমিকায়। এতে তারাও সুবিধাভোগী হয়েছেন। গত ৫ আগস্ট গণঅভুত্থ্যানে দুর্নীতি-অনিয়মের দায়ে সরকারের পতন হলেও আইডিআরএর দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা রয়েছেন বহাল তবিয়তে।
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতেও বিমা গ্রাহকদের নীরব কান্না দেখার কেউ নেই, পলিসির মেয়াদপূর্ণ হলেও বিমা দাবি পাচ্ছে না কয়েক হাজার গ্রাহক। বিমা দাবির জন্য স্থানীয় কার্যালয়ে সাড়া না পেয়ে অনেকেই প্রতিনিয়তই ভিড় করছেন কোম্পানির হেড অফিসে। তাতেও মিলছে না কাঙ্ক্ষিত সাড়া। ফলে বিমা দাবি পরিশোধে অভিযোগ করছেন বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) কাছে। আইডিআরএতে দরখাস্ত করেও লাভ হয় না বলে জানিয়েছেন অনেক গ্রাহক। বিমা দাবির জন্য আইডিআরএতে অভিযোগ করতে আসা কয়েকজন গ্রাহকের সঙ্গে কথা হয় আমার সংবাদের এ প্রতিবেদকের। তারা জানান, কারো পলিসি পরিপক্ক হয়েছে পাঁচ বছর আগে আবার কারো ৮ থেকে ১০ বছর আগে। কেউ কেউ কোম্পানির দ্বারে দ্বারে ঘুরে কোনো সাড়া না পেয়ে টাকা পাওয়ার আশাই ছেড়ে দিয়েছেন।
কয়েকজন গ্রাহক বলেন, ভেবেছিলাম দেশের পরিস্থিতি পরিবর্তন হলে হয়তো আমাদের টাকাগুলো পাব কিন্তু তা আর হলো কই! এখন ভোগান্তি আরও বাড়ছে। আইডিআরএও আমাদের অভিযোগে কোনো সাড়া দিচ্ছে না। ক্ষুব্ধ গ্রাহকদের অনেকে বলেন, আমরা হাঁস, মুরগি, ডিম বিক্রি করে ভবিষ্যতে একটু নিশ্চয়তার আশায় বিমা করেছি কিন্তু তা আর হলো কই।
পঞ্চগড় থেকে আসা নাসরিন নামের গৃহিণী আমার সংবাদকে বলেন, ‘জামাইর রিকশা চালানোর ট্যাকায়, মাইয়্যা বিয়া দিবার লাগি বিমা কইরেছি, অখনে দেখি সবই খোয়া গেলো’।
বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) থেকে পাওয়া তথ্য অনুসারে, ৩৬টি জীবন বিমা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৩১টি কোম্পানির প্রায় ১১ লাখ বিমাকারীর তিন হাজার ৬৪৩ কোটি টাকার দাবি নিষ্পত্তি করতে হবে। গ্রাহকরা তাদের টাকা ফেরত পাবেন কিনা তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।
গেল বছর অর্থাৎ ২০২৪ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত পাঁচ বছরে জমে থাকা অমীমাংসিত দাবি এই সময়ের মোট দাবির ৬৬ দশমিক ২১ শতাংশ। আইডিআরএর তথ্য বলছে, সামপ্রতিক বছরগুলোয় জীবন বিমাকারীদের দাবি নিষ্পত্তির হার কমেছে। ২০২০ সালে যা ছিল ৮৫ শতাংশ, ২০২৩ সালে তা ৭২ শতাংশে নেমে এসেছে।
সীমাহীন অনিয়মে জড়িয়েছে যেসব কোম্পানি তাদের মধ্যে ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স, পদ্মা ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স, প্রগ্রেসিভ লাইফ ইন্স্যুরেন্স, সানফ্লাওয়ার লাইফ ইন্স্যুরেন্স, বায়রা লাইফ ইনন্স্যুরেন্সের ও স্বদেশ ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিসহ আরও বেশ কিছু কোম্পানি। এছাড়া নন লাইফ বিমা কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে অভিযোগেরও শেষ নেই।
বিমা বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স একাডেমির সাবেক পরিচালক কাজী মোহাম্মদ মর্তুজা আলী আমার সংবাদকে বলেন, বিমা সংস্কারে ইদরা (আইডিআরএর) কোনো উদ্যোগ নিয়েছে কিনা এবং সরকার কোনো নির্দেশনা দিয়েছে কিনা আমার জানা নেই। বিমা আইনে যে যে সমস্যাগুলো রয়েছে সেগুলো অতিদ্রুত সংশোধন করা উচিত, এ জন্য স্টেক হোল্ডারদের পরামর্শ নেয়া যেতে পারে। বিমার প্রতি মানুষের আস্থা ফেরাতে গ্রাহকের বিমা দাবি পরিশোধের ব্যাপারে মনযোগী হওয়া প্রয়োজন।
বিমা কোম্পানিগুলোর দুর্নীতি আর অনিয়মের জন্য আইডিআরএকে দায়ী করেন বিমা সংশ্লিষ্টরা। নিরাপত্তার স্বার্থে নাম প্রকাশে অনিচ্ছু কয়েকজন বিমা কর্মকর্তা আমার সংবাদকে বলেন, আইডিআরএ কর্মকর্তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়েই এমন অনিয়মের সুযোগ পায় কোম্পানিগুলো। মোটা অংকের আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে দুর্নীতি আর অনিয়মগুলো আড়াল করার চেষ্টা করেন তারা। নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরের সাবেক চেয়ারম্যান জয়নুল বারী সহ কয়েকজন কর্মকর্তা এই অনিয়মের মূল হোতা বলে মনে করেন তারা।
বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) বর্তমান চেয়ারম্যান এম আসলাম আলমের কর্মকাণ্ড নিয়েও অভিযোগের শেষ নেই মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তাদের (সিইও)। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন কর্মকর্তা আমার সংবাদকে বলেন, আইডিআরএর চেয়ারম্যান মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তাদের সাথে দেখা করেন না, কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে তার সঙ্গে দেখা করতে চাইলে ই-মইেলের মাধ্যমে অনুমতি নিতে বলা হয়, কিন্তু পরবর্তীতে মেইল করা হলেও তার কোনো প্রতিউত্তর পাওয়া যায় না।
এদিকে ব্যবসায় অসফল, গ্রাহক বিমা দাবি পরিশোধ ও নিজ কোম্পানিতে সুশাসন ফেরাতে ব্যর্থ কর্মকর্তাদের পদায়ন করা হয়েছে আইডিআরএতে। এছাড়াও আইডিআরএর যাচাই-বাছাই সক্ষমতা নিয়েও উঠেছে প্রশ্ন! কোম্পানির সিইও হিসেবে নিয়োগ পেতে অনেকে আশ্রয় নিচ্ছেন জাল জালিয়াতির, ভুয়া সনদপত্র, অভিজ্ঞতার মিথ্যা তথ্য। এসব যাচাই-বাছাই না করেই অনুমোদন করা হয় বলে অভিযোগ বিমা সংশ্লিষ্টদের।
জানা যায়, বিগত আওয়ামী সরকারের শাসনামলে দলীয় ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে অনেক বিমা কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করে। এদিকে বিমা আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে পরিবারতন্ত্র চলছে অনেক কোম্পানিতে সেদিকেও নজর নেই আইডিআরএর। বিমা আইন অনুযায়ী কোনো কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদে একই পরিবারের দুজনের বেশি লোক থাকার নিয়ম নেই। কিন্তু বিমা আইনের তোয়াক্কা না করে অনেক কোম্পানিতে এখনও বিরাজ করছে পরিবারতন্ত্র।
বিমা সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, পরিবারকেন্দ্রিক কোনো কোম্পানি পরিচালিত হলে সেখানে অর্থ আত্মসাতসহ দুর্নীতি করার বড় সুযোগ বেড়ে যায়। এসব বিষয় নিয়ে জানতে বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) চেয়ারম্যান এম আসলাম আলমকে বারবার ফোন করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।