Amar Sangbad
ঢাকা মঙ্গলবার, ২২ এপ্রিল, ২০২৫,

পুরান ঢাকার ঐতিহ্য বাকরখানি

মনির হোসেন

মনির হোসেন

জানুয়ারি ৩০, ২০২৫, ১২:১৩ এএম


পুরান ঢাকার ঐতিহ্য বাকরখানি

পুরান ঢাকার মানুষের কাছে সকালের হালকা নাস্তা হিসেবে বাকরখানির চাহিদা এখনো অনেক বেশি। প্রায় আড়াই শতাব্দীর ঐতিহ্যের ধারক এ বাকরখানি আর মগ ভর্তি চা না হলে যেন সকালটাই চাঙ্গা হয় না। এর চাহিদাও কম নয়। এ দেশ থেকে বাকরখানি এখন বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। পুরান ঢাকা থেকেই বাকরখানি যাচ্ছে পাকিস্তান, শ্রীলংকা, ভারত, নেপাল, যুক্তরাজ্য, সৌদি আরবসহ আরও বেশ কয়েকটি দেশে। প্রবাসী বাঙালিদের কাছে বাকরখানির বিশেষ চাহিদা রয়েছে।

পুরান ঢাকার নবাবদের বাকরখানি তৈরি হতো মালাই-মাখন মিশিয়ে। জানা যায়, অতীতে ময়দার সাথে দুধের মালাই ও মাখন মিশিয়ে খামির তৈরি করে বাকরখানি বানানো হতো। এটি ছিল নবাব আর আমির-ওমরাদের প্রিয় খাবার। মালাই-মাখনের বাকরখানি এখন আর তৈরি হয় না। তবে ঢাকার অনেক পুরনো খানদানি পরিবার বিয়ে বা সামাজিক অনুষ্ঠানের জন্য আগাম অর্ডার দিলে মালাই-মাখনের বাকরখানি এখনো সরবরাহ করা হয়ে থাকে। আগে ঢাকার বনেদি পরিবার নিজেদের বাড়িতেই বাকরখানি তৈরির আয়োজন করতেন। পরে দুধের মালাইয়ের পরিবর্তে বাকরখানিতে ডালডা ও তেল ব্যবহারের প্রচলন হয়। সাধারণ রুটি-পরোটার সাথে বাকরখানি তৈরি ও এর স্বাদের অনেক তফাৎ রয়েছে।

বাকরখানির রকমফের আছে। চকবাজারের বাসিন্দা হাজী আনোয়ার মিয়া বলেন, তার দোকানে আট রকমের বাকরখানি তৈরি হয়। এর মধ্যে রয়েছে ছানা, পনির, চিনি, নোনতা, কাবাব, কিমা ও নারিকেলের সংমিশ্রণে তৈরি বাকরখানি, যা অত্যন্ত সুস্বাদু। ডায়াবেটিক রোগীদের জন্য তৈরি করা হয় নোনতা বাকরখানি। এটি তৈরি করতে হলে ময়দার সাথে সামান্য খাবার সোডা, ডালডা, একটি তন্দুর দিতে হয় এরপর এর মাঝে উত্তাপ ছড়ানো জ্বলন্ত কয়লা। প্রথমে একটি বিশেষ প্রক্রিয়ায় ময়দা, সামান্য পানি এবং ডালডার সমন্বয়ে খামির তৈরি করা হয়। এবার তৈরিকৃত খামির থেকে কেটে ছোট ছোট গোলাকার কোয়া তৈরি করা হয়। এবার বেলন দিয়ে কাঠের পিঁড়িতে কোয়াটি দিয়ে গোলাকার কাঁচা রুটি তৈরি করা হয়। কাঁচা রুটির মাঝখানে ছুরি দিয়ে লম্বা করে তিনটি দাগ কেটে দেয়া হয়। এবার এর এক পাশে পানির সামান্য প্রলেপ দিয়ে তন্দুরের দেয়ালে আটকিয়ে দেয়া হয়। ঘড়ির কাঁটায় ৫ থেকে ৭ মিনিটে তৈরি হয়ে যায় বাকরখানি। আবার ঘি দিয়ে বিশেষ যত্নের সাথে এই বাকরখানি তৈরি করা হয়। পনির দিয়েও এই রুটি বিশেষ কায়দায় তৈরি করা হয়ে থাকে। 

পুরান ঢাকার নাজিমুদ্দিন রোডের দুই পাশে রয়েছে সারি সারি বাকরখানির দোকান। এসব দোকানের বাকরখানি স্বচ্ছ প্যাকেটে ভরে ধানমন্ডি, গুলশান, বনারী, উত্তরাসহ রাজধানীর এলাকার সাধারণ দোকানে সরবরাহ করা হয়। ব্যবসায়ীরা জানান, লালবাগ কেল্লার কাছেই প্রথম বাকরখানির দোকান গড়ে ওঠেছিল। এরপর সেখান থেকে ধীরে ধীরে পুরান ঢাকার চানখাঁরপুল, আগা নবাব দেউড়ি, কোতোয়ালি, বংশাল, চকবাজার, হাজারীবাগ, শ্যামপুর, গেন্ডারিয়া ও সূত্রাপুর এলাকায় এর প্রসার ঘটে। 

বর্তমানে বাসাবো, মাদারটেক, রায়েরবাজার, যাত্রাবাড়ী, মুগদাসহ বিভিন্ন জায়গায় কারেন্টের মেশিনের সাহায্যে বিশেষ ব্যবস্থায় অল্প সময়ে তৈরি করে বাজারে বিক্রি করা হচ্ছে। তাতে সময়ও কম লাগে। তাছাড়া আমলীগোলা, ইসলামাবাদ, লালবাগ, আবুল হাসনাত রোড, আগা সাদেক রোড, নাজিরাবাজার, সিদ্দিকবাজার, ওয়ারী, বনগ্রাম, মৈশুন্ডি, লক্ষ্মীবাজার, একরামপুর, নারিন্দা, দয়াগঞ্জ সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায়। 

পুরান ঢাকার শ্রেণির লোকজন বাসায় অতিথি এলে চায়ের সাথে বাকরখানি দিয়ে আপ্যায়ন করেন। রাজধানী ঢাকা ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলোতে অনেক লোক বাকরখানি তৈরিতে কাজ করে থাকেন। এর বেশির ভাগই সিলেট অঞ্চলের। হবিগঞ্জের আবুল কাসেম বাকরখানি তৈরির কারিগর হিসেবে অনেক দিন ধরে কাজ করেন চকবাজারের শাহী বাকরখানি কারখানায়। তিনি জানান, প্রতিদিন তিন-চার মণ বাকরখানি বিক্রি করেন তারা। বাকরখানি চায়ের সাথে খাওয়ার প্রচলন বেশি। এছাড়াও গরু, খাসির অথবা মুরগির মাংসের সাথেও বাকরখানির স্বাদও তুলনাহীন। ক্ষীর ও পায়েসের সাথেও পরিবেশন করা হয় এটি।

রুটি বা পরোটার সাথে বাকরখানির স্বাদের ব্যবধান হলো ঠাণ্ডা হলেই রুটি কিংবা পরোটার স্বাদ তেমন থাকে না। কিন্তু বাকরখানি ঠাণ্ডা হলেও স্বাদ থাকে একই রকম। এক সপ্তাহ কিংবা ১০-১২ দিন পর্যন্ত সংরক্ষণ করে বাকরখানি খাওয়া যায়।

Link copied!