অর্থনৈতিক প্রতিবেদক
জানুয়ারি ৩১, ২০২৫, ১২:০৮ এএম
অর্থনৈতিক প্রতিবেদক
জানুয়ারি ৩১, ২০২৫, ১২:০৮ এএম
৫০ কোটি টাকা বা তার বেশি ঋণে বিশেষ পুনঃতফসিল নিয়ে কাজ করতে পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এই কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে রিজার্ভ চুরির অভিযোগে নাম থাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক মো. মেজবাউল হক। বিগত সরকারের সময় ঢালাওভাবে ঋণখেলাপিদের বিশেষ সুবিধা দেয়া হয়। বিভিন্ন নীতি ছাড়ের মাধ্যমে খেলাপি ঋণ কম দেখানো হচ্ছিল। আবার প্রভাবশালীরা কিস্তি না দিলেও খেলাপি দেখানো হচ্ছিল না। তবে দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের অনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে নেয়া অনেক ঋণ এখন খেলাপি হতে শুরু করেছে। আগের মতো বিশেষ সুবিধা বন্ধ হয়েছে। এসব কারণে খেলাপি ঋণ দ্রুত বাড়ছে। ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়তে থাকায় নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও।
গত বছরের ৯ মাসে খেলাপি ঋণ বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। গত সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে দুই লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা। ব্যাংক খাতের মোট ঋণের যা প্রায় ১৭ শতাংশ।
সম্প্রতি ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইএ’র প্রশাসকের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুরের সঙ্গে এ নিয়ে দীর্ঘ বৈঠক করেন। বৈঠকে এফবিসিসিআইএ’র পক্ষ থেকে দাবি জানানো হয়, ঋণখেলাপি হওয়ার সময় ছয় মাসের পরিবর্তে ৯ মাস করতে হবে। এর মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক বিশেষ ছাড়ে পুনঃতফসিলের উদ্যোগ নিয়েছে।
জানা গেছে, বিশেষ সুবিধার মাধ্যমে ডাউন পেমেন্টের শর্ত শিথিল, সুদ মওকুফ ও ঋণের মেয়াদ বাড়ানোর সুযোগ দেয়া হবে। ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিরা এই সুযোগ পাবে না বলেও সাফ জানিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। পুরো প্রক্রিয়াটি স্বচ্ছভাবে করতে বিভিন্ন খাতের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে পাঁচ সদস্যের একটি যাচাই-বাছাই কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই কমিটি সামপ্রতিক আন্দোলন, অগ্নিকাণ্ড, করোনা, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধসহ প্রকৃত ক্ষতির মুখে পড়া ৫০ কোটি টাকা বা তার বেশি ঋণে বিশেষ পুনঃতফসিলের বিষয়গুলো কার্যপরিধির মধ্যে থাকবে।
এ কমিটিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক মেজবাউল হককে আহ্বায়ক করা হয়েছে। এছাড়া সদস্য সচিবের দায়িত্ব পালন করবেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগের (বিআরপিডি) পরিচালক মোহাম্মদ শাহরিয়ার সিদ্দিকী। অন্য তিনজন সদস্য হলেন- এফআইডির যুগ্ম সচিব ড. দেলোয়ার হোসেন, অর্থনীতিবিদ মামুন রশিদ, ব্যবসায়িক প্রতিনিধি আব্দুল হক।
বিদ্যমান ঋণ পুনঃতফসিল নীতিমালার বাইরে ৫০ কোটি টাকা বা তার বেশি ঋণ নিয়মিত করার ক্ষেত্রে কী সুবিধা দেয়া যায়, তা কমিটি যাচাই করবে। আর এ জন্য প্রথমে ব্যাংক গ্রাহকের কাছ থেকে আবেদন নিয়ে তা কেন্দ্রীয় ব্যাংকে পাঠাবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রাথমিক বাছাই শেষে কমিটিতে পাঠাবে। কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে বিআরপিডির অনাপত্তি নিয়ে বিশেষ সুবিধা কার্যকর হবে।
ইতোমধ্যে যেসব বড় ঋণখেলাপি হয়েছে, পুনঃতফসিলের পরও কেন আদায় হচ্ছে না, তার কারণ পর্যালোচনা করবে কমিটি। এর বাইরে বিগত সরকারের সময় জারি করা সুদ মওকুফ, ঋণ পুনঃতফসিল, পুনর্গঠন, অবলোপন নীতিমালা পর্যালোচনা করে সম্ভাব্য পরিবর্তনের বিষয়ে প্রতিবেদন দেবে। সরকার পরিবর্তনের পর গত ২৭ নভেম্বর জারি করা ঋণ শ্রেণীকরণ ও প্রভিশন নীতিমালা পরিবর্তনের প্রয়োজন হলে সে বিষয়েও সুপারিশ করবে এই কমিটি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলের সাধারণ নীতিমালা রয়েছে। সাম্প্রতিক আন্দোলন, করোনা, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধসহ বিভিন্ন কারণে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের ঋণ পুনঃতফসিলে বিশেষ ছাড়ের প্রয়োজন হলে যাচাই-বাছাই করার জন্য এ কমিটি গঠন করা হয়েছে। পাশাপাশি সুদ মওকুফ, ঋণ পুনঃতফসিল, শ্রেণীকরণসহ বিভিন্ন নীতি পর্যালোচনা করবে এই কমিটি।
তারা আরও বলেন, খেলাপি ঋণ দ্রুত বেড়ে যাওয়ায় ব্যবসা-বাণিজ্যের খরচ বাড়ছে। আগামীতে খেলাপি আরও বাড়লে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে এবং বিদেশি বিনিয়োগে প্রভাব পড়তে পারে। এ অবস্থায় প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য বিশেষ সুবিধায় ঋণ পুনঃতফসিলের নীতিমালা করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম মেনে নির্ধারিত ডাউনপেমেন্ট দিয়ে ব্যাংক যে কোনো সর্বোচ্চ চারবার ঋণ পুনঃতফসিল করতে পারে। আব্দুর রউফ তালুকদার গভর্নরের দায়িত্ব নিয়ে ২০২২ সালে ঋণ পুনঃতফসিলের নীতিমালায় ব্যাপক শিথিলতা আনেন। আগে যেখানে ঋণ পুনঃতফসিলে ১০ থেকে ৩০ শতাংশ ডাউনপেমেন্ট দিতে হতো, তা কমিয়ে আড়াই থেকে সাড়ে ৪ শতাংশ করা হয়। পটপরিবর্তনের পর এখন আবার বিশেষ বিবেচনায় পুনঃতফসিলের উদ্যোগ নেয়া হলো। এর মাধ্যমে ২০২২ সালে জারি করা নীতিমালার চেয়েও বাড়তি সুবিধা পাবেন ব্যবসায়ীরা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ঋণ শ্রেণীকরণ ও প্রভিশনিংয়ের নীতিমালা ছিল আন্তর্জাতিক মানের। ২০১৪ সালের নির্বাচনের ঠিক আগে রাজনৈতিক বিবেচনায় ২০১৩ সালে নিয়ম শিথিল করা হয়। নামমাত্র ডাউনপেমেন্ট দিয়ে বিশেষ বিবেচনায় ঋণ পুনঃতফসিলের সুযোগ চালু করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এরপর ২০১৫ এবং ২০১৮ সালে আবার ২ শতাংশ ডাউনপেমেন্ট দিয়ে ঋণ নিয়মিত এবং পুনর্গঠনসহ বিভিন্ন সুবিধা দেয়া হয়। করোনা শুরুর পর ২০২০ সালে এক টাকা না দিলেও ঋণ নিয়মিত দেখানোর সুযোগ দেয়া হয়।
এরপর ২০২১ সালে কিস্তির ১৫ শতাংশ এবং ২০২২ ও ২০২৩ সালে অর্ধেক দিলেই নিয়মিত দেখানো যেত। অবশ্য এত সুযোগেও খেলাপি ঋণ আটকানো যায়নি। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা নেয়ার সময় ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার কোটি টাকা। গত ১৬ বছরে তা ১৩ গুণ বেড়ে এখন দুই লাখ ৮৩ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।